আজ নয়ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ১৯২৩ সালে জন্ম নেয়া এ মানুষটি এ দিনে ১০১ পেরুতেন। বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অঙ্গনে দেখেছে। তাদের কাছে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ছিলেন প্রতিভাদীপ্ত প্রজ্ঞাবান একজন মানুষ, সর্বপ্রকার জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির একজন উপাসক, উদারমত ও পথের এক পথিক এবং নীতির প্রশ্নে সাহসী আপোষহীন একজন পুরুষ। তিনি ছিলেন মননশীল বুদ্ধিজীবিদের অগ্রগণ্য, সভার অলঙ্কার, ও মানবিক আন্দোলনের পুরোধা। লোকে তাঁকে জানত সদা হাস্যময়, মিতবাক, শ্রদ্ধাউদ্রেককারী এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে।
কিন্তু এ সব কিছুই অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বাইরের পরিচয়। পারিবারিক সূত্রে আমরা যারা তাঁকে ঘরোয়া পরিবেশে দেখেছি, সেখানে তাঁর ভিন্নরূপ। ঘরের মধ্যে তিনি যে স্বাচ্ছন্দ্যে ঠাট্টা করতে পারতেন ভাই-বোনদের সঙ্গে, সেই একই ভাবে হাসি-ঠাট্টা করতে পারতেন ভ্রাতুস্পুত্র পুত্রী, ভগ্নীপুত্র পুত্রী ও কন্যা জামাতাদের সঙ্গে। যে বিষয় নিয়ে তিনি সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতেন, সে একই বিষয় নিয়ে তিনি তুমুল তর্কে মাততে পারতেন তাঁর দৌহিত্র ও দৌহিত্রীদের সঙ্গে।
পরিবারের বাইরে ক’জন জানেন যে অধ্যীপক কবীর চৌধুরী যে আগ্রহ নিয়ে শেকসপীয়ার পড়তেন, সেই একই আগ্রহ নিয়ে পড়তেন দৌহিত্রীদের কাছ থেকে ধার করা ‘কাকাবাবু সমগ্র’? বিশ্বনাটকে তাঁর জ্ঞান যতখানি প্রশস্ত ছিল, তার চেয়ে নিতান্ত কম ছিল না তাঁর জানাশোনা হিন্দি চলচ্চিত্রের হাল হকিকত সম্পর্কে। বাইরের মানুষ কি জানতো যে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ঘন্টার পর ঘন্টা টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখতে ভালোবাসতেন, ক’জনার মনে আছে যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হকি ব্লু ছিলেন, কে বিশ্বাস করবে যে ঘরের বহু কাজ তিনি নিজ হাতে করতেন? আমি জানি যে তিনি রুটি দেয়া পুডিং খেতে ভালোবাসতেন, বিশ্বের বিভিন্ন চিত্রশালা ঘোরা আর চিত্রকর্ম দেখা তাঁর নেশা ছিল, আর সামাজিক দেখাশোনার ক্ষেত্রে এক চক্করে ৩০ মিনিটে ৩ বাড়ী ঘুরে আসতে তিনি প্রানপণ চেষ্টা করতেন।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বাইরের পরিচয়ের মতো তাঁর ঘরের পরিচয়টিও তাঁর ব্যক্তিত্বের একটি বড় অংশ। তাঁর আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্ব্রের কাছে যেমন অনেক কিছু শেখার আছে, তেমনি শেখার আছে তাঁর ঘরোয়া ব্যক্তিত্বের কাছেও। জীবনের বহু বোধ আমরা – তাঁর নিকটজনেরা – তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি এবং জগতের বহু জ্ঞান তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। আদর্শ মানুষ কাকে বলে তা আমার জানা নেই, কিন্তু মানুষের আদর্শ বলতে আমরা তাঁকেই বুঝতাম। মানুষের পূর্ণতা সম্পর্কেও আমার ধারনা বড় কম, কিন্তু পূর্ণ মানুষ বলতেও আমরা তাঁর দিকেই তাকাই।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সংবেদনশীলতা ছিল সার্বক্ষনিক, তাঁর স্নেহদৃষ্টি সবার প্রতি সমভাবে বিকশিত ছিল, তিনি মানুষকে সম্মান ও বিশ্বাস করতেন। তিনি জীবনকে ভালোবাসতেন, কিন্তু জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হন নি। ক্ষমতার কাছে, অর্থের কাছে, ভীতির কাছে তাঁর স্খলন ঘটেনি। সত্যের প্রতি, বিশ্বাসের প্রতি তিনি অবিচল থেকেছেন এবং নীতির প্রশ্নে কখনো আপোষ করেন নি – এমন কি মৃত্যু আশঙ্কা থাকলেও। বাংলাদেশের মানুষ এ কথা জানে।
তিনটি কথা তিনি প্রায়শ:ই পারিবারিক বলয়ে আমাদের বলতেন। তিনি সবসময়েই বলেছেন, ‘যখন কেউ তোমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, তখন বুঝতে চেষ্টা করবে, কেন সে তা করছে। সেটা করলে দেখবে যে আর তোমাদের খারাপ লাগছে না’। কখনো-সখনো উচ্চারন করতেন, ‘দু:খ, কষ্ট, আনন্দ, বেদনায় জীবনের যে অবস্হাতেই থাকো না কেন, সবসময় তা থেকে ভালো দিকটা খুঁজে নেবে’। সতর্ক করতেন আমাদের এটা বলে যে, ‘মানুষের দোষগুন নিয়েই তাদের গ্রহন করবে, তাদের বিচারে বোস না’।
জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী
শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
জন্ম : ১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়।
পিতা-মাতা: ছিলেন খান বাহাদুর আব্দুল হালিম চৌধুরী এবং মাতা উম্মে কবীর আফিয়া চৌধুরী।
পৈতৃক নিবাস: ছিল নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানার গোপাইরবাগ গ্রামে।
স্ত্রী: মেহের কবীর একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী।
কবীর চৌধুরী ১৯৫৭-৫৮ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমেরিকান সাহিত্য বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
জাতীয় অধ্যাপক: ১৯৯৮ সালে জাতীয় অধ্যাপক অভিধায় ভূষিত হন
মৃত্যুবরণ: কবীর চৌধুরী ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে দাফন করা হয়।
জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর উক্তি
আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা
নিত্যদিনের গ্লানি ও কালিমার উর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। জগতের তুচ্ছতা ও তিক্ততাকে তিনি জয় করতে পেরেছিলেন। নিজেকে কখনো বিক্রি করেন নি, অন্যকেও কখনো কিনতে চান নি। ক’জন মানুষের ক্ষেত্রে এ’কথা বলা যায়? নিজে অন্যায় করা থেকে বিরত থেকেছেন এবং সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। সত্যিকারের সাহসী মানুষের তো পরিচয় এখানেই।
বুদ্ধির মুক্তিতে তাঁর অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর আস্হা সর্বজনবিদিত। সকল গোঁড়ামি আর কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অনলস সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তচিন্তা বিষয়ে আমাদের বহু শিক্ষাই তাঁর কাছে পাওয়া।
আমাদের আজকের ‘দুর্বৃত্ত সময়ে’ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মত ‘সঙ্গী, পার্শ্বে পথচারীর’ বড় প্রয়োজন ছিল। আমাদের মধ্যে তিনি আজ নেই সত্যি, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর লেখা-বক্তব্য, ধ্যান-ধারণা, আদর্শ-মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা। সেগুলে থেকেই আমরা উদ্দীপ্ত হবো, উজ্জীবিত হবো, উৎসাহিত হবো।
‘পাবে প্রান লখিন্দর, ফিরে পাবে বেহুলা সংসার।
মাটির গভীর থেকে শুনি কার বীজকন্ঠ ওই?
এমন করাল কালে হিন্তালের উচ্চারন কার?
কবীর চৌধুরী তিনি, তিনি চাঁদ বণিক নিশ্চয়ই’।
– ( সৈয়দ শামসুল হক: হিন্তালের বীজকণ্ঠ কবীর চৌধুরী)
লেখক Selim Jahan এর ফেসবুক থেকে নেয়া