Nakshi kantha traditional craft in Bangladesh x bfa x bipul hossain x fxyz (2)

নকশি কাঁথা: বাংলাদেশের লোকশিল্পের একটা অংশ

একটি নকশী কাথাঁ সেলাইয়ের পিছনে থাকে আনেক হাসি-কান্নার কাহিনী। জীবনের গল্প। বিচ্ছেদের গল্প।

Nakshi
kantha

ব্যবহৃত জিনিসপত্র পুনরায় প্রক্রিয়াজাত করে নতুন উপযোগী রূপ দেওয়া—এই মূল ধারণাকেই বলে রিসাইক্লিং। রিসাইক্লিং আজ শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই নয়, বরং আধুনিক ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে জীবনের নানা ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ চর্চা হিসেবে বিবেচিত। রিসাইক্লিংয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি আরেকটি ধারণা হলো আপসাইক্লিং। এর মাধ্যমে পুরোনো জিনিসকে এমনভাবে নতুন জীবনের দিকে নিয়ে আসা হয়, যা পূর্বের তুলনায় আরও ব্যবহারিক, সুন্দর ও মূল্যবান হয়ে ওঠে। এই রিসাইক্লিং ও আপসাইক্লিং ধারণাগুলো একত্রে সাসটেইনেবল ফ্যাশন আন্দোলনের মূল অংশ, যেখানে আমাদের পরিবেশবান্ধব ঐতিহ্যের প্রভাব স্পষ্ট।

এই টেকসই চর্চার সাথে আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথার কি মিল খুঁজে পাওয়া যায় না? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের গ্রামীণ নারীরা তাঁদের মমতা ও সৃজনশীলতায় ব্যবহৃত কাপড়কে পুনরায় সেলাই করে রূপান্তরিত করেছেন নকশি কাঁথায়। নকশি কাঁথা শুধু একটি শৈল্পিক অভিব্যক্তি নয়, বরং এটি বাংলার নারীদের প্রকৃতিবান্ধব চিন্তা ও টেকসই ফ্যাশনের এক অমূল্য নিদর্শন। আজকের রিসাইক্লিং এবং আপসাইক্লিং ধারণার বহু আগেই তাঁরা আমাদের সংস্কৃতির এই টেকসই শিল্পকে চালিয়ে গেছেন।

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে নকশি কাঁথা তৈরি হলেও ময়মনসিংহকে নকশি কাঁথার শহর হিসেবে বিশেষভাবে গণ্য করা হয়। এছাড়া রাজশাহী, যশোর এবং ফরিদপুরের নকশি কাঁথাও বেশ জনপ্রিয়। তবে, আমাদের এই মূল্যবান ঐতিহ্যের প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্র কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে যায়, কারণ ২০০৮ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নকশি কাঁথার ভৌগোলিক স্বীকৃতি লাভ করে।

নকশি কাঁথার প্রতিটি সেলাই, প্রতিটি নকশা শুধু বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গল্পই বলে না, বরং টেকসই ও পরিবেশবান্ধব একটি জীবনধারারও প্রকাশ। এই শিল্পের সাথে গ্রামীণ নারীরা যে সংযোগ গড়ে তুলেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে আধুনিক সাসটেইনেবল ফ্যাশন আন্দোলনের সাথে আমাদের দেশের শতবর্ষের পুরনো ঐতিহ্যের মেলবন্ধন তৈরি করেছে।

Nakshi kantha

Difference between
Kantha and Nakshi Kantha

কাঁথা এবং নকশি কাঁথার পার্থক্য

কাঁথা এবং নকশি কাঁথা উভয়ই পুরনো কাপড় পুনরায় ব্যবহার করে তৈরি হয়, তবে এদের উদ্দেশ্য এবং শৈল্পিকতা একে অপরের থেকে ভিন্ন।

কাঁথা:

সাধারণ কাঁথা হলো পুরনো শাড়ি বা অন্যান্য কাপড়ের ছোট ছোট টুকরো জোড়া লাগিয়ে তৈরি একটি সহজ আচ্ছাদন। এতে শুধুমাত্র সোজাসুজি ফোঁড় দিয়ে সেলাই করা হয়, এবং এটি দেখতে সরল এবং নিরলঙ্কার। কাঁথা তৈরিতে ব্যবহৃত সুতা সাধারণত পুরনো কাপড়ের পাড় থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই ধরনের কাঁথা সাধারণত বর্ষাকালে অথবা হালকা শীতে শরীর গরম রাখতে ব্যবহার করা হয়। এটি মূলত প্রয়োজনের তাগিদে তৈরি, শৈল্পিকতার চেয়ে ব্যবহারিক দিকটাই এতে মুখ্য।

নকশি কাঁথা:

নকশি কাঁথা মূলত কাঁথার এক উন্নত সংস্করণ। এটি শুধু একটি আচ্ছাদন নয়; বরং এটি একটি শিল্পকর্ম। সাধারণ কাঁথার মতোই পুরনো কাপড় ব্যবহার করে তৈরি হলেও নকশি কাঁথার মূল আকর্ষণ হলো এর নকশা। বিভিন্ন ধরনের ফুল, লতাপাতা, পাখি, মাছ, ময়ূর ইত্যাদি নকশার মাধ্যমে এটি একটি সৃজনশীল চেহারা পায়।

nakshi kantha zainul mela 1
Nakshi Kantha:
A Part of Bangladesh’s Folk Art

নকশি কাঁথা: বাংলাদেশের লোকশিল্পের একটা অংশ

লোকশিল্প কী—এই প্রশ্নের সহজ এবং সাধারণ উত্তর হলো, লোকশিল্প হলো সাধারণ মানুষের জন্য এবং তাদের দ্বারাই সৃষ্ট সেই শিল্প, যা সমাজের বৃহৎ অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং তাদের সংস্কৃতির মূলে প্রোথিত। এটি সমাজের মৌলিক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ও বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে এবং বংশপরম্পরায় সংরক্ষিত থাকে। লোকশিল্পের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর সহজ সরলতা ও নান্দনিকতা, যা জীবনের দৈনন্দিনতা এবং প্রকৃতির উপাদানগুলোকে ফুটিয়ে তোলে।

বাংলাদেশের লোকশিল্প অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বয়ন ও বুননশিল্প, মৃৎশিল্প, দারুশিল্প, সূচিশিল্প, পটশিল্প, শঙ্খশিল্প, পাটশিল্প, এবং অন্যান্য আরো বহু লোকশিল্প। প্রতিটি শিল্পই দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি বিশেষ দিককে তুলে ধরে।

নকশি কাঁথা এই লোকশিল্পের সূচিশিল্পের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কেবল সাধারণ একটি কাপড় নয়; বরং এটি বাংলার মানুষের আবেগ, তাদের জীবনের গল্প এবং তাদের পরম্পরাগত শিল্পকৌশলকে ধারণ করে। পুরনো কাপড়ে সূচিশিল্পের মাধ্যমে নানা নকশা ও চিত্র ফুটিয়ে তুলে একটি নকশি কাঁথা তৈরি করা হয়, যেখানে প্রকৃতির দৃশ্য, জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, এবং শিল্পীর ব্যক্তিগত অনুভূতির ছাপ থাকে।

এই নকশি কাঁথা আমাদের লোকশিল্পকে জীবন্ত রেখেছে এবং এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গৌরবময় একটি প্রতীক হিসেবে বিশ্বে পরিচিত।

History of nakshi kantha

কাঁথার আদি কথা

কাঁথা শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও ধারণা করা হয় যে এটি সংস্কৃত শব্দ ‘কন্থা’ থেকে এসেছে। নকশি কাঁথা বাংলাদেশ এবং ভারতের লোকশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এই কারুশিল্পটি ঐতিহ্যবাহী ও অবস্থানগত সীমারেখার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে নিজস্ব রূপ লাভ করেছে।

প্রাচীনকাল থেকেই গ্রামীণ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কাঁথার ব্যবহার শুরু হয়। গ্রামাঞ্চলের গৃহিণীরা পুরনো শাড়িগুলো পরতে পরতে নরম ও ছেঁড়া হয়ে গেলে সেগুলো জমিয়ে রাখতেন, যা পরে কাঁথা তৈরির কাজে আসতো। এই কাঁথা কখনো থাকতো সরল সেলাইয়ের মধ্যেই, আর কখনো নিখুঁত নকশার মাধ্যমে রূপ নিতো নকশি কাঁথায়।

নকশা করা কাঁথার প্রচলন সম্ভবত ১৮শ শতকের দিকে শুরু হয়। গ্রামের মহিলারা তাদের অবসর সময়ে কাঁথা সেলাই করতেন। বিকেল বা রাতের খাবারের পরে তারা একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে সেলাই করতেন। এসব গল্পের প্রতিফলন হতো কাঁথার প্রতিটি সেলাইয়ে—জীবনের গল্প, প্রেমের গল্প, বিচ্ছেদের গল্প। তাদের আশপাশে দেখা ফুল, লতা-পাতা, পাখি কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রতিফলনও কাঁথায় ফুটিয়ে তুলতেন নিজেদের সৃজনশীলতা দিয়ে। এভাবেই প্রতিটি কাঁথা হয়ে উঠতো একটি শিল্পকর্ম, যা গ্রামীণ নারীদের জীবন ও আবেগের প্রতিচ্ছবি বহন করে।

Kantha Making

কাথাঁ যে ভাবে তৈরী হয় এবং তার উপকরণ

এখন বাণিজ্যিক ভাবে নতুন কাপড়, সুতা দিয়ে কাঁথা তৈরি করা হলেও, আগে কি ভাবে টুকড়ো কাপড় বা পুরানো শাড়ি দিয়ে একটা কাঁথা তৈরি করা হতো, এখানে তার বর্ননা করা হবে।

একটি স্ট্যান্ডার্ড সাইজের কাঁথা তৈরি করতে ৫ থেকে ৭টি পুরনো শাড়ি প্রয়োজন হয়। শাড়ির পরিমাণ নির্ভর করে কাঁথার পুরুত্বের উপর। প্রথমে মাটির উপর একটি পাটি বিছিয়ে, তার উপর শাড়িগুলো স্তরে স্তরে সাজানো হয়। এরপর কাঁথার চার কোণে পেরেক বা খেজুর কাঁটা গেঁথে কাপড়গুলোকে টানটান করে আটকে রাখা হয়, যাতে সেলাই করার সময় কাপড়গুলো সঠিকভাবে স্থির থাকে।

প্রথম ধাপে, সুতা দিয়ে বড় বড় ফোঁড়ে শাড়ির সব স্তর একসাথে সেলাই করা হয়, যা ‘টাক দেওয়া’ নামে পরিচিত। টাক দেওয়া হয়ে গেলে চারপাশে বড় ফোঁড় দিয়ে মুড়ি ভেঙে সেলাই করা হয়, যাতে পরবর্তী সেলাইয়ের সময় সুতা উঠে না আসে।

আগের দিনে কাঁথা সেলাইয়ের জন্য শাড়ির পাড় থেকে সুতা বের করে সেটিই ব্যবহার করা হতো। কারণ পুরাতন কাপড়ের সাথে নতুন সুতার কাজ করলে শাড়ির জমিন ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পাশাপাশি, শাড়ির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হতো।

প্রাথমিক কাজ শেষে, কাঁথার চার কোণ থেকে পেরেক বা খেজুর কাঁটা সরিয়ে ফেলা হয় এবং একজন সূচি শিল্পী কাপড়টি হাতে নিয়ে চারপাশ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেলাই করা শুরু করেন। প্রয়োজন অনুযায়ী, একটি কাঁথা একসাথে কয়েকজন মিলে সেলাই করতে পারেন।

যদি এটি একটি নকশি কাঁথা হয়, তাহলে বড় ফোঁড় দিয়ে কাঁথার প্রাথমিক কাঠামো তৈরি হওয়ার পর সূচি শিল্পী নিজস্ব নকশা আঁকেন। প্রাচীনকালে পেন্সিল দিয়ে হাতে নকশা আঁকা হতো। পরবর্তীতে কাঠের ব্লকের সাহায্যে নকশা ছাপানোর প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে ট্রেসিং পেপার কিংবা স্ক্রিন প্রিন্ট ব্যবহার করে নকশা আঁকা হয় এবং সেই ছাপের উপর সেলাই করে শিল্পসম্মতভাবে একটি নকশি কাঁথা তৈরি করা হয়। এভাবেই সূচি শিল্পী তার দক্ষতা দিয়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথা নির্মাণ করেন, যা আমাদের লোকশিল্পের অন্যতম পরিচায়ক।

কাথাঁ তৈরিতে উপকরন

১. পুরনো শাড়ি, ধুতি কিংবা লুঙ্গি
২. সূচ
৩. সেলাই করবার সুতা
৪. কাচি ( সুতা কাটার জন্য)
৫. পেরেক কিংবা খেজুর কাটা
৬. পাটি
৭. নকশা তোলার জন্য পেনছিল বা ট্রেসিং পেপার

Kantha-making duration

কাঁথা সেলাই এর সময়কাল

একটা কাঁথা সেলাই করতে কতটা সময় সাপেক্ষ তা নির্ভর করে কাঁথার সাইজ কিংবা কাঁথার নকশার উপর। তবে একটা সাধারন কাঁথা সেলাই করতে৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে।
আর নকশী কাঁথার ক্ষেত্রে কাঁথার নকশা, কাঁথার সাইজ, কতজন সূচিশিল্পী এক সাথে সেলাই করছে তার উপর নির্ভর করে। কোনো কোনো কাঁথা এক বছর এর বেশি সময় লেগে যায়।

Types of Nakshi Kantha

নকশি কাঁথার ধরন বা নামকরন

সাধারন কাঁথার উপর নকশা করা থাকলেই আমরা সাধারন ভাবে নকশি কাঁথা বলে আক্ষ্যায়িত করতে পারি। তবে এসব নকশি কাঁথার ব্যাবহার ভেদে কিংবা স্থান ভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে।

গায়ের দেয়ার নকশি কাঁথা, বিছানার সৌন্দর্য বর্ধনের কাঁথা, সুজনী কাঁথা, বর্তনী রুমাল কাথা, পালিকির কাঁথা, বালিশের ঢাকনি, দস্তরথানা, পান পেঁচানী, আরশীলতা ইত্যাদি।

nakshi kantha lohori kantha

সেলাইয়ের ধরন অনুযায়ী
কাঁথার নামকরন

লহরী কাঁথা : সাধারণত রাজশাহীতে এই কাঁথা বিখ্যাত। এই কাঁথার নামকরন করা হযেছে সেলাইয়ের ঢং এর উপর নির্ভর করে। পারস্য শব্দ লহর থেকে লহরী কাঁথা নামের উদ্ভব। লহর মানে হলো ঢেউ। এই কাঁথার সেলাই গুলো সরল সোজা ভাবে আগালেও, সেলাই শেষ হলে পুরো কাঁথার নকশায় ঢেউ এর মত দেখায়। লহরী কাঁথা আরো দুই ধরনের নকশা দেখা যায়। কৈতর খুপি ( কবুতরের বাসার মত বা ত্রিভুজ টাইপ ) অন্যটি হলো বরফি যা হীরে আকৃতির।

Nakshi kantha নকশি কাঁথা x aarong x bfa x fxyz (37)

আনারসি: আনরসি কাঁথা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোরে পাওয়া যায়। আনারস টান, আনারস টাইল, আনারস ঝুমকা ও আনারস লহরী এর বিভিন্ন প্রকারভেদে পাওয়া যায়।

সুজনি কাঁথা: এটি শুধু রাজশাহী এলাকায় পাওয়া যায়। সাধারণত এই কাঁথায় ঢেউ খেলানো ফুল ও লতাপাতার নকশা থাকে।

শেলাবুনিয়ার নকশিকাঁথা | স্থানের নাম অনুযায়ী কাথাঁর নামকরন

দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার শেলাবুনিয়া গ্রাম, যেখানে একটি সেলাইকেন্দ্রের নামে “শেলাবুনিয়ার নকশিকাঁথা” র নামকরন করা হয়েছে।

অসহায়, দুস্থ, স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা বিধবা এরকম প্রায় শতাধিক নারী কর্মী নিয়ে এ সেলাইকেন্দ্রটি গড়ে ওঠে ১৯৮২ সালে। মংলার সেন্ট পলস গির্জার পুরোহিত, ইতালিয়ান ফাদার মারিনো রিগন গির্জার আঙিনায় এই সেলাইকেন্দ্রটি গড়ে তুলেন।

এখানকার নকশিকাঁথায় ফুটিয়ে তোলা হয় আমাদের আবহমান সবুজ-শ্যামল গ্রামবাংলার ফুল, ফল, পাখি, কবিতা, পালকি, গ্রামের বধূ, কিষান-কিষানি কিংবা কাঁচা-পাকা ধানখেত, হাতি, ঘোড়া, বাঘসহ বিভিন্ন পশুপাখি, রাখাল-গরু, নদী, নদীর ঘাট, পালতোলা নৌকা, নৌকা পারাপার, গ্রামীণ নারীদের ধান ভানা, ধান শুকানো, আয়না দেখা, চুল বাঁধা, ঢেঁকি, ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া, বধূসাজে পালকি, কনে দেখা, বিয়েতে হলদি বাটা, মেহেদি বাটা, বিয়ের কনে বরণ, দইওয়ালা, নাগরদোলা, বৈশাখী মেলা অথবা বাংলাদেশের রূপবৈচিত্র্য কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে।

NAKSHI KANTHA MAP OF BANGALDESH

কোন কোন জেলায় নকশী কাঁথা
পাওয়া যায় তার একটি ম্যাপ


নকশি কাঁথা nakshi kantha map of bangladesh


NAKSHI KANTHA STITCH

কাঁথার ফোঁড় বা নকশি
সেলাইয়ের নাম

কাঁথা সেলাইয়ের ফোঁড়ই প্রধান। একটা কাঁথা কতটা সুন্দর তা নির্ভর করে নিখুঁত ফোড়ের উপর। আর নকশী কাঁথার সৌন্দর্যর প্রধান হলো ফোড়েঁ বৈচিত্রতা।

NAKSHI KANTHA STITCH

কাঁথার ফোঁড় বা
নকশি কাঁথা পাড়

পাড় হলো কাঁথার চারপাশে সীমানা বরাবর যে অংশ। নকশী কাঁথার চেনার আরেকটি উপকরন হলো চারপাশে নকশা সেলাই করে কাঁথার ফিনিসিং দেয়া হয়। এই সেলাই এর নাম হলো নকশী পাড়। এই পাড়ের নকশা অনুযায়ী নামকরনও করা হয়েছে যাতে বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্পিরা নাম দিয়ে নকশাগুলো ফোঁড় দিয়ে উঠাতে পারে।

NAKSHI KANTHA MOTIF

নকশি কাঁথার নকশা বা মটিফ

যদিও নকশী কাথাঁর নকশা গুলো একজন সূচি শিল্পী তার নিজের জীবনের গল্প, বিচ্ছেদের গল্প কিংবা আশেপাশে দেখা সুন্দর জিনিস পত্র তাদের নিজস্ব শৈল্পিক মন দিয়ে একেঁ তার উপর সেলাই করতেন। যা হয়ে উঠতো এক একটা শিল্প। তবুও কোথাও কোথাও একটা মিলবন্ধন পাওয়া যেতো। নকশার ভিতর দিয়ে গ্রামীন নারীরা রুপকথার গল্প, ধর্মের উপাখ্যান, পৌরাণিক কাহিনী কিংবা নিজের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের কথকতা; তাদের স্বপ্ন, আশা এবং প্রতিদিনের গ্রামীণ জীবন ফুটিয়ে তুলেছেন এক একটা সেলাইয়ের ফোঁড়ের ভিতর দিয়ে। নকশায় পাওয়া যায় ধর্মীয় বিশ্বাস ও নিজস্ব সংস্কৃতির প্রভাব। যদিও কোনো ধরা বাধা নিয়মের মধ্যে না থাকলেও সবার নকশায় সামঞ্জস্যতা দেখা যেতো।

যেহেতেু কাথাঁ মুলত স্কয়ার সেইপ এর তাই মোটামুটি কাথাগুলোতে মাঝখানে একটা কেন্দ্র ধরেই নকশা গুলো এগিয়ে যেতো। বেশিরভাগ কাঁথার কেন্দ্রে থাকতো পদ্ম ফুল বা সূর্য নকশা এবং পদ্ম ফুলের আশে পাশে নানা রকম আকাঁবাকাঁ লতার নকশা থাকতো। এছাড়া ফুল, পাতা পাখি, মাছ, প্রানির নিজস্ব অঙ্কনে নকশা গুলো তোলা হতো।

উল্লেখযোগ্য নকশা গুলো হলো

ফ্যাশন হাউস আড়ং “স্টোরি অফ স্টিচস” | STORY OF STITCHES শীর্ষক একটি নকশি কাঁথা প্রদর্শনীর থেকে সংগৃহীত

Kantha in literature

সাহিত্যে কাঁথা

বাংলায় “ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা” বাগধারার মাধ্যমে মানুষের অমিত স্বপ্ন আর প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে। একইভাবে, পল্লীকবি জসীম উদদীনের আখ্যানকাব্য নকশী কাঁথার মাঠ বাংলা সাহিত্যে কাঁথার শিল্পকে আরও গভীরতর ব্যঞ্জনায় তুলে ধরে। এই কাহিনী কাব্যের মাধ্যমে সূচের প্রতিটি ফোঁড়ে ফুটে ওঠে ভালোবাসা, বেদনা, আর মানবিক আবেগের সূক্ষ্ম কাহিনী। প্রেমিক রুপাই ও প্রেমিকা সাজুর ভালোবাসার অমর আখ্যানকে কেন্দ্র করে, এই কাব্য মানব জীবনের গভীর সত্য ও অনুভূতির প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।

“বিয়ের পরে রুপাই আর সাজুর ভালোবাসায় আখ্যান বেশি দূর যেতে পারেনি। ফেরারি হয়ে যায় রুপাই। স্বামীর অপেক্ষায় স্ত্রী সাজু বাকি জীবন নকশী কাঁথা বুনতে শুরু করে, দিন-মাস-বছর যায়। সাজু নকশী কাঁথায় সুঁইয়ের আচড় দিয়ে যায়, কাঁথায় লেখে কত গল্প, রুপাই ফিরে আসে না। সারা জীবন সাজুর এভাবেই কেটে যায়। সাজুর নকশী কাঁথা বোনা যেদিন শেষ হয়ে যায় সেদিন সে মাকে অনুরোধ করে, তার মৃত্যুর পর যেন তার কবরের উপরে নকশী কাঁথাটি বিছিয়ে দেওয়া হয়।”

নকশী কাঁথার মাঠ


মূলত বাংলাদেশে নকশি কাঁথা শব্দটির বহুল ব্যবহার শুরু হয় জসীমউদ্দীনের “নক্সী কাঁথার মাঠ” (১৯২৯) কাব্য গ্রন্থ থেকে।

Nakshi Kantha gallery

নকশি কাঁথা সংগ্রহশালা

কর্মাশিয়াল পারপাস ব্যাবহারে হাই রেজুলেশন ছবির জন্য যোগাযোগ করতে পারেন আমাদের সাথে। নকশি কাঁথার আরো ছবি দেখতে পাবেন আমাদের পিন্টারেস্ট এর লিংকে।

NAKSHI KANTHA । নকশিকাঁথা | PINTEREST

১৯৩৯ সালের দিকে কিশোরগঞ্জ এর সম্ভ্রান্ত মিল্কি পরিবারের মরহুম আশরাফউদ্দিন খান মিল্কি সাহেবের স্ত্রী র নকশা করা রুমাল। মাসুদুর রহমান রনি ফেসবুক প্রফাইল থেকে নেয়া।

নকশি কাঁথার বিভিন্ন মাত্রা

নকশি কাঁথা শুধু বস্ত্রশিল্পে সীমাবদ্ধ নয়; এটি শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বহুমাত্রিকতা তুলে ধরে। বাংলাদেশে নকশি কাঁথার মোটিফ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও পণ্যে কাজ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:

অনেক ফ্যাশন ডিজাইনার পোশাকে এই মোটিফ ব্যবহার করে তাৎপর্যপূর্ণ ডিজাইন তৈরি করেছেন।


নকশি কাঁথার মোটিফে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু গহনা, ডিজাইন করা হয়। এতে প্রাচীন নকশাগুলোকে আধুনিক অলংকারে রূপান্তরিত করা হয়।


নকশি কাঁথার মোটিফ ও গল্প নিয়ে শিল্পীরা পেইন্টিং ও ভাস্কর্যে কাজ করেছেন। এতে বাংলার লোককথা ও ঐতিহ্য শিল্পের মাধ্যমে চিত্রায়িত হয়।

Nakshi Kantha on STAMP

বাংলাদেশ ডাকটিকিটে নকশি কাঁথা

মিডিয়া জগতে নকশি কাঁথার ব্যাবহার

‘মৃধা বনাম মৃধা’ সিনেমার জন্য ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২১’-এ সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন নায়ক সিয়াম আহমেদ

NAKSHI KANTHA EXHIBITION

নকশিকাঁথার প্রদর্শনী

বিস্তারিত : An EXHIBITION OF NAKSHI KANTHA BY AARONG 


শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সংগ্রীহত নকশিকাঁথার প্রদর্শনী

আরও পডুন : শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সংগ্রীহত নকশিকাঁথার প্রদর্শনী


EXHIBITION SYMPHONY OF NEEDLEWORK 2015

contributor needed for bfa


তথ্যসূত্র

শিলা বসাক; নকশি কাঁথা অফ বেঙ্গল

বাংলাপিডিয়ায় নকশি কাঁথা

আড়ং

The Art of Kantha Embroidery by Niaz Zaman

সামহোয়্যার ইন ব্লগ


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!