পহেলা-বৈশাখ-PAHELA-BAISHAKH-বাঙালির-অন্যতম-বড়-উৎসব-x-bfa-x-fxyz

পহেলা বৈশাখ । বাঙালির অন্যতম বড় উৎসব

পয়লা বৈশাখ এখন সব বাঙালির সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায়নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব। এর মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয় বাঙালির স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়।

বাঙালির অন্যতম বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ, এলেই ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যায় উৎসবের মাতন আর সুরের আন্দোলন, বাসন্তী রং শাড়ি পড়ে সুন্দরী ললনাদের মেলায় ঘুরতে যাওয়ার উপক্রম, রমনা বটমূলের গান আর প্রখর রোদ উপেক্ষা করে রাজপথ জুড়ে প্রাণবন্ত সব তরুণ-তরুণীদের ভিড়; ধুলো পড়া অতীত পেছনে ফেলে নতুন বছরকে বরণ করে নেবে বাঙালি। নতুন স্বপ্ন বুনবে বাংলার কৃষক। নতুন হালখাতা খুলবে ব্যবসায়ীরা। 

বাংলা নববর্ষ-১৪৩১

ঈদের পরপরই আগামী ১৪ এপ্রিল উদযাপিত হবে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ-১৪৩১। সেদিন সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা : ’তিমিরহননের গান’ থেকে নেয়া ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’ প্রতিপাদ্য নিয়ে এবছর মঙ্গল শোভাযাত্রা, চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু করে শাহবাগ মোড় হয়ে শিশুপার্কের সামনে থেকে ঘুরে শাহবাগ হয়ে টিএসসিতে শেষ হবে।

গত বছরের মতো এবারও বর্ষবরণের আয়োজন বিকেল ৫টার মধ্যে শেষ করতে বলেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেদিন বিকেল ৫টার পর ক্যাম্পাসে ঢোকা যাবে না, শুধু বের হওয়া যাবে।

এবারে চারুকলার বর্ষবরনের প্রতিপাদ্য কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা : ’তিমিরহননের গান’ থেকে নেয়া ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’।

জীবনানন্দ দাশ

কবিতা : তিমির হননের গান

( রচনাকাল : পৌষ ১৩৫০, কাব্যগ্রন্থ : সাতটি তারার তিমির, প্রকাশকাল : প্রথম সংস্করণ ১৩৫৫ )



❝ জীবিত বা মৃত রমণীর মতো ভেবে—অন্ধকারে—

মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি।

তিমিরহননে তবু অগ্রসর হয়ে

আমরা কি তিমিরবিলাসী?

আমরা তো চাই তিমিরবিনাশী

হতে চাই।

আমরা তো তিমিরবিনাশী। ❞

বর্ষবরণে আগমনকারীদের জন্য বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ।

পহেলা বৈশাখে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মুখোশ পরা এবং ব্যাগ বহন করা যাবে না। তবে চারুকলা অনুষদের প্রস্তুত করা মুখোশ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভুভুজিলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এছাড়া নববর্ষের আগের দিন ১৩ এপ্রিল (শনিবার) সন্ধ্যা ৭টার পর ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না। নববর্ষের দিন ক্যাম্পাসে যানবাহন চালানো যাবে না। মোটরসাইকেল চালানোও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।


নববর্ষের দিন টিএসসির সামনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট বন্ধ থাকবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকতে চারুকলা অনুষদের সামনের ছবির হাটের গেট, বাংলা একাডেমির সামনের গেট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের পাশের গেট ব্যবহার করা যাবে।

chaitra sankranti

চৈত্রসংক্রান্তি আজ

বাংলা বছরের সর্বশেষ দিনটিকে চৈত্র সংক্রান্তি বলা হয়। বাংলার বিশেষ লোকজ উৎসব চৈত্র সংক্রান্তি। চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক বাঙালির কাছে চৈত্র সংক্রান্তি পরিণত হয়েছে এক বৃহত্তর লোকজ উৎসবে। এর মাধ্যমে পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে সফলতা ও সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় দেখা দেবে নতুন ভোর। বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ।

মনে করা হয়, চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের শুরু। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাংলা বছরের শেষ এ দিনটিকে পুণ্য দিন বলে মনে করেন। স্নান, দান, ব্রত ও উপবাসের মধ্যদিয়ে অন্যরকমভাবে দিনটি পালন করেন তারা। ব্যবসায়ীরা আগের পুরনো সব জঞ্জাল পরিষ্কার করেন, প্রস্তুতি নেন পুরনো সব হিসাব চুকিয়ে নতুন হালখাতা খোলার। নতুন বছরের প্রথম দিনে খোলা হয় এ হালখাতা। শুচি-শুদ্ধ হয়ে তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নতুন করে সাজিয়ে তোলেন।

চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে নানা ধরনের মেলা ও উৎসব হয়। হালখাতার জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সাজানো, লাঠিখেলা, গান, সংযাত্রা, রায়বেশে নৃত্য,চড়কের পুজো, শোভাযাত্রাসহ নানা অনুষ্ঠান ও ভূত তাড়ানোর মধ্যদিয়ে উদযাপিত হয় চৈত্র সংক্রান্তি।

Charak puja

চড়ক পুজো

সংক্রান্তিতে পালিত হয় চড়কের পুজো। চড়ক পূজা বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু হয়ে নববর্ষের প্রথম দু-তিন দিন ধরে চড়ক পুজোর উৎসব চলে।  এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের একটি অংশ। জনশ্রতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেন। এ পূজার অপর নাম নীল পূজা।


পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পোগোজ ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে প্রতি বছর চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।


একটি লম্বা কাঠকে চড়ক গাছ হিসেবে পুজো করা হয়। এই চড়কগাছে একজন ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর পিঠে, হাতে, পায়ে এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে জ্বলন্ত বাণ শলাকা ঢুকিয়ে দেওয়ার রীতিও প্রচলিত রয়েছে। তবে এখনকার দিনে এই প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে এসেছে। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই নিয়ম বন্ধ করে দেয়। তবে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে কোথাও কোথাও এখনও তা প্রচলিত আছে।

বাংলা সাহিত্যে বৈশাখ ও নববর্ষ
.

 নববর্ষ আদিম মানবগোষ্ঠীর কাছে ছিল সিজন্যাল ফেস্টিভ্যাল এবং নববর্ষ হিসেবে ‘পয়লা বৈশাখ’ সভ্য মানুষের কৃষি উৎসব বা এগ্রিকালচারাল ফেস্টিভ্যাল হিসেবে বিবেচিত হতো। তখন সৃষ্টি হয়েছিল অসংখ্য গুহাচিত্র। পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি ঐতিহ্য। আর বাংলা নববর্ষ বাঙালির ঐতিহ্যের স্মারক। যা জীবন-সাহিত্য ও বাঙালি  জীবনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। যেমন –

ছন্দের গীতিতে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন—

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর…

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩০ সনের পহেলা বৈশাখে শান্তিনিকেতনে নববর্ষের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন—

‘…নতুন যুগের বাণী এই যে,
তোমার অবলোকের আবরণ খোলো, হে মানব,
আপন উদার রূপ প্রকাশ কর। ’
[রবীন্দ্র রচনাবলি, চতুর্দশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬১]

কিংবা
নব আনন্দে জাগো আজি নবরবিকিরণে
শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে…


কিংবা

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপসনিশ্বসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।

মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশ রাশি    শুষ্ক করে দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাখ
মায়ার কুজ্ঝটিকাজাল যাক দূরে যাক। ’

বাংলা ব্যান্ড-এ মাকসুদ এর গাওয়া-

বছর ঘুরে এলো আরেক প্রভাতী ফিরে,
এলো সুরেরই মঞ্জরিপলাশ শিমুল গাছে লেগেছে আগুন।
এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি…

মেলায় যাইরে, মেলায় যাইরে
বাসন্তী রঙ শাড়ী পরে ললনারা হেটে যায় ”

নতুন হালখাতা

Pohela Boishakh

বাংলা নববর্ষ | পহেলা বৈশাখ

তবে বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কৃষির। এ সম্পর্কের সূত্রেই বাংলা সন প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর। তার আমলেই প্রবর্তন হয় বাংলা সন। এখন তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত। বৈশাখ নামটি নেওয়া হয়েছিল নক্ষত্র বিশাখার নাম থেকে। কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরনো আচার অনুষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটেছে। আবার যুক্ত হয়েছে অনেক নতুন আয়োজন। 

পয়লা বৈশাখের উৎসব শুধু গ্রামাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, শহরাঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে। এখন শহুরে মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব পয়লা বৈশাখ। গ্রাম-শহর মিলিয়ে পয়লা বৈশাখ এখন সব বাঙালির সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায়নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব। এর মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয় বাঙালির স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়।


বাঙালির নববর্ষ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যময় উৎসব। কেননা, পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন, পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। দিনে দিনে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায়নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব পহেলা  বৈশাখ।

ঢাকায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে সূচিত বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়াও মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়, মেলা বসে। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, ব্যবসায়ীরা খুলে বসেন হালখাতা। তরুণ-তরুণীরা বৈশাখী উৎসবের রঙিন পোশাক পরে বেরিয়ে আসে . . . 

বৈশাখের সাজ কেমন হওয়া চাই
.

কেমন ভাবে সাজাব নিজেকে- বৈশাখের প্রথম দিনটিতে সবার এ নিয়ে আগাম প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু কাপড়ের রংটা কী হবে? সাদা-লালের চিরায়ত ফ্যাশন তো রয়েছেই। পাশাপাশি চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মূলত হালখাতার রংটা লাল ও সাদা। ধরে নেয়া হয়, ওই রং থেকেই এসেছে বৈশাখের লাল-সাদার ফ্যাশন। তবে এখন সেই ধারাবাহিকতায় লালের বিভিন্ন শেডও চলে এসেছে ফ্যাশনে। বৈশাখে বাঙালী মেয়েরা শাড়ি পরেন। এটা এখন অনেকটা অনিবার্য বিষয় হয়ে গেছে। অনেকেই এর জন্য পহেলা বৈশাখের অপেক্ষায় থাকেন। আর বৈশাখ এলেই গায়ে ওঠে পাটভাঙ্গা তাঁতের শাড়ি। সেই শাড়িতে লাল-সাদার সীমাবদ্ধতায় থাকতে রাজি নয় এখন কেউই। লাল ও সাদা তো থাকবেই, সঙ্গে থাকতে হবে অন্যান্য রং। কিংবা অন্য কোন রঙের শাড়িতে সেজে কপালের টিপ আর হাতের চুড়িটা সবাই লাল পরবেন। অথবা শাড়িতে চাই কোন বাঙালী মোটিফ।

প্রিন্ট ছাড়াও অ্যামব্রয়ডারি, সুতার কাজ, হ্যান্ডপেইন্ট নকশায় ব্যবহার শুরু হয়। বৈচিত্র্যময় মোটিফগুলো ফুটিয়ে তুলতে লাল-সাদাকে কেন্দ্রীয় রং হিসেবে রেখে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কয়েকটি রঙ।

রং এর সাথে সাথে  কাট এসেছে। একটু ঘেরওয়ালা ফ্রক-কাট কামিজ, লম্বা কুর্তা বা কামিজের হেমে ভি-কাট, পাশাপাশি আনারকলি কামিজ, এ্যালাইন কামিজের চল রয়েছে। হাতায়, গলায় ও হেমে পাইপিং, লেইস ব্যবহার বেড়েছে । যে পোশাকই পরুন না কেন, মাথায় রাখতে হবে, সেই পোশাকে আপনি কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য।

পহেলা বৈশাখের ইতিহাস

হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হত গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন বাংলা শুভ নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত।

তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।

তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে।

প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উৎযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা।

হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই  পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের প্রথম সূত্র পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে।

প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।

বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উৎযাপন | শুভ নববর্ষ

নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পড়ে এবং আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।

চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলা । ছবি : সংগ্রহ

চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলা

jobbarer boli khela

এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তির। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রাম-এর লালদিঘী ময়দান-এ। এটি জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত। ছবি : সংগ্রহ

ছায়ানটের বর্ষবরণ

ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ

borsho boron

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃত পক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ । ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।

মঙ্গল শোভাযাত্রা, ছবি

মঙ্গল শোভাযাত্রা

mongol shovajatra

ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবণ এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো নয় রং- বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ যা শুরুতে আনন্দ শোভাযাত্র নামে ছিলো। এই শোভাযাত্রা ২০১৬ সাল থেকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায়৷ 

নারায়ণগঞ্জে শতাব্দী প্রাচীন বউমেলা

বউমেলা

bou mela

ঈশা খাঁর সোনারগাঁয় ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম বউমেল। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পয়লা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজো হিসেবে এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি- ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা। পাঁঠাবলির রেওয়াজও পুরনো। বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে।নারায়ণগঞ্জে শতাব্দী প্রাচীন বউমেলা | ছবি : সংগ্রহ 

ঘোড়ামেলা ছবি : সংগ্রহ

ঘোড়ামেলা

Ghora mela

 ছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ঘোড়ামেলা। লোকমুখে প্রচলিত জামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ওই স্থানেই তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে প্রচলিত মেলাটির নাম ঘোড়ামেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল- বৃদ্ধ-বনিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। ঘোড়ামেলা  ছবি : সংগ্রহীত

বৈশাখি মেলা

ঐতিহ্যবাহী  বৈশাখী মেলা

boishakhi mela

 সকাল থেকেই এ স্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। এক দিনের এ মেলাটি জমে ওঠে দুপুরের পর থেকে। হাজারো লোকের সমাগম ঘটে। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারণে এ মেলার আয়োজন করা হয়। তথাপি সর্ব ধর্মের লোকজনেরই প্রাধান্য থাকে এ মেলায়। এ মেলায় শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি থাকে। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নানারকম আনন্দ-উৎসব করে পশ্চিমের আকাশ যখন রক্তিম আলোয় সজ্জিত উৎসবে, যখন লোকজন অনেকটাই ক্লান্ত, তখনই এ মেলার ক্লান্তি দূর করার জন্য নতুন মাত্রায় যোগ হয় কীর্তন। এ কীর্তন হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এভাবেই শেষ হয় বৈশাখের এই ঐতিহ্যবাহী মেলা।


আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা


তথ্যসূত্র : 
১. banglatelegraph 

২. eibela

৩. bn.wikipedia.org

৪. .dw.com

৫. dailyjanakantha.com

৬.jugantor.com


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!
Skip to content