VAKURTA-TRADITIONAL-JEWELRY-MAKING-VILLAGE-IN-BANGLADESH-ভাকুর্তার-গয়নাশিল্প-x-bfa-x-fxyz

শত বছরের ঐতিহ্য ভাকুর্তার গয়নাশিল্প

এই গ্রামকে এখন সবাই গয়নার গ্রাম নামেই চিনে।

শত বছরের ঐতিহ্য পিতৃপুরুষের পেশাকে আগলে রাখা একটি জনপদের নাম ভাকুর্তা। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত এই ভাকুর্তা জনপদ। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার পেরোলেই তুরাগ নদের ওপর ছোট্ট একটি লোহার সেতু। সেখান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার যেতেই ভাকুর্তা গ্রাম। সবুজে ঘেরা এই গ্রামে ঢুকতেই কানে আসবে হাতুরের ঠুংঠাং শব্দ। দেখা যায় বেশিরভাগ বাড়ির বারান্দায় উজ্জ্বল আলোয় উঁকি দিচ্ছে আগুনের ফুলকি। পুরো গ্রামেই চলছে যেন কর্মযজ্ঞ। প্রতিটি ঘরের উঠোন, দরজা, ঘরের ভিতরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অলঙ্কার তৈরির সরঞ্জাম। এই সরঞ্জাম দিয়ে তৈরি হয় অন্যকে অলঙ্কাকৃত করার গহনা। আর এটাই হলো ভাকুর্তা গ্রাম। শত বছরের ঐতিহ্য ভাকুর্তার গয়নাশিল্প ।

এই গ্রামকে এখন সবাই গয়নার গ্রাম নামেই চিনে। তবে ঐ গ্রামের গল্পটা বেশ পুরনো। সেখানকার কারিগররা প্রায় ৩০০ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় গয়না তৈরির পেশায় যুক্ত। এ গ্রামের অসংখ্য পরিবার স্বর্ণের গয়না তৈরি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। ১৯৯০ সালের দিকে স্বর্ণের দাম বাড়ায় এ ধাতুর চাহিদা কমে যায়। সেই জায়গাটা দখল করে নেয় রূপার গয়না। রূপার দামও বেড়ে গেলে লোকসানে পড়েন কারিগররা। এরপর তারা তৈরি করতে শুরু করেন পিতল ও তামার গয়না।

VAKURTA, TRADITIONAL JEWELRY ভাকুর্তার গয়নাশিল্প x bfa x fxyz 8
Vakurta, traditional jewelry-making village in Bangladesh

ভাকুর্তা বাজার

১৫০ বছরের পুরোনো গ্রাম ভাকুর্তা বাজার। সাভার উপজেলার ইউনিয়ন এটি। এই ইউনিয়নভুক্ত গ্রামের সংখ্যা ৩৬। গ্রামগুলোর মধ্যে চুনারচর, ডোমরাকান্দা, সোলারমার্কেট, খাগুড়িয়া, নলাগুড়িয়া, মোগরাকান্দা, চাইরা, কান্দিভাকুর্তা, হিন্দুভাকুর্তা, বাহেরচর, মুশরিখোলা, ঝাউচর, লুটেরচর, চরতুলাতলির সর্বত্র অলঙ্কার তৈরি করা হয়। গ্রামের মানুষ কৃষি কাজ ছাড়াও অলঙ্কার তৈরির কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। গেরস্ত বাড়ির পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অলঙ্কার তৈরির কাজে নিয়োজিত।

এই জনপদে রয়েছে বিরাট একটি বটগাছ। সেই বটগাছ ঘেঁষেই রয়েছে সারি সারি গয়নার দোকান। কিছু পাকা, কিছু আধা পাকা, আবার কিছু টিনের ঘর। পুরো ইউনিয়নে কমপক্ষে এমন ২৫০ থেকে ৩০০টি দোকান রয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে গয়নার কাজ হওয়ার পর চলে যায় স্থানীয় দোকানে। গয়না তৈরির পরবর্তী ধাপগুলো চলে সেখানেই।

হীরে-জহরত-ছাপিয়ে-নতুন-দিনের-গয়না-Mughal-Empire-Jewellery-to-modern-jewellery-x-bfa-x-fxyz

আরও পড়ুন

একসময় গয়না বলতেই মনে করা হতো সোনায়-রূপায়, হীরে-জহরতে মোড়ানো শরীর। গল্পকথা থেকে শুরু করে বাস্তব জীবন, উৎসব আমেজে বিশেষত নারীদের ভূষণে স্বর্ণ-রৌপ্যের আভিজাত্যকে যে কখনো অন্য কোনো ‘নিম্ন’ পর্যায়ের উপাদান জায়গা করে নেবে, সেকথা অন্তত আমাদের আগের জমানার কেউ ভাবেনি।

ভাকুর্তা গয়নাশিল্প

ভাকুর্তার গয়নাশিল্প

জানা যায়, ’৮০-এর দশকে এই বাজারে শুধুই সোনা ও রুপার গয়না তৈরি হতো। কিন্তু কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও উপযুক্ত মজুরি না পাওয়াসহ নানা কারণে ’৯০-এর দশকের পর থেকে কারিগররা সোনা ও রুপার  অলঙ্কার তৈরি থেকে সরে আসেন। কারিগররা ঝুঁকে পড়েন তামা, পিতল ও দস্তা দিয়ে ইমিটেশনের গয়না তৈরির দিকে। শত বছরের ঐতিহ্য পিতৃপুরুষের পেশাকে আগলে রাখা এসব শিল্পীদের জীবনের চিত্রটা সুখকর না হলেও তারা এই পেশা আগলে রেখেছেন জীবিকা ও পিতৃপুরুষের টানে। অন্যকে অলঙ্কুত করেই যাদের আনন্দ।

তামা, কাসা এবং পিতল ইত্যাদিই হলও এই গহনার মূল উপাদান। গয়না তৈরির কাঁচামাল হিসেবে তামা ও পিতল, ডাইস, কালো মাটি ইত্যাদি ভারত থেকে আসে।

VAKURTA, TRADITIONAL JEWELRY

গয়না তৈরির ধাপগুলো

গয়না তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবে কালচে মোমের প্রলেপ দেওয়া বোর্ডের উপর কাঁচামালের প্রতিটি অংশ বসানো হয়। এই মোম আসলে এক ধরনের কালো মাটি যা ভারত থেকে আসে।

এই বোর্ডের উপর নকশার ছাঁচ তৈরি করা হয়।

গয়নার নকশা করা হয়ে গেলে এর ওপর সাদা চুনার মতো দেখতে এক ধরনের প্লাস্টার ঢালা হয়। কাঠ কয়লার আগুনে পুড়িয়ে সেই গয়না শক্ত করা হয়।

এর পর চুনার ভিতর থেকে গহনার নকশা গুলো আলাদা করা হয়।

এরপর নকশা গুলো গ্যাস টর্চ দিয়ে ঝালাই করে মুল গহনা ডিজাইন করা হয়।  

ঝালাইয়ের ফলে গয়নাগুলো কালচে রঙ ধারণ করে। তখন এগুলোকে সালফার এসিড মেশানো পানিতে ৫-৬ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পরিষ্কার করা হয়। পরিষ্কার করার পর গয়নাগুলো ঝকঝকে হয়ে বেরিয়ে আসে।

রঙ করার ক্ষেত্রে দুই ধরনের রঙ ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। প্রথমটি হলো জিপি রঙ বা স্বর্ণের পানি ধোয়া রঙ। এই রঙ ব্যবহার করলে গয়নার উজ্জ্বলতা ও রঙ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এটির দাম বেশি।
দ্বিতীয়টি হলো ডাই রঙ, যা তুলনামূলক বেশ সস্তা। সেগুলো আবার বিভিন্ন ধরনের রঙিন পাথর ও পুঁতি বসিয়ে ডিজাইন ফুটিয়ে তোলার কাজ করেন নারী ও পুরুষ শিল্পীরা।

ভাকুর্তা গয়নাশিল্প

পেশাটি প্রাচীন হলেও গয়না তৈরিতে প্রাচীন পদ্ধতির পরিবর্তে এসেছে আধুনিকতা। ফু দেওয়া নলের পরিবর্তে ব্যবহূত হচ্ছে গ্যাস বার্নার আর কয়লার পরিবর্তে হাওয়া দিতে এসেছে হাপর যন্ত্র।

আগে মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই পেশার সঙ্গে জড়িত থাকলেও কালের বিবর্তনে এবং লাভ বেশি হওয়ায় গ্রামের সব সম্প্রদায়ের মানুষই এখন গয়না তৈরির কাজে যুক্ত হয়েছেন।



VAKURTA, TRADITIONAL JEWELRY

যেসব গয়না পাওয়া যায়

মাথার টায়রা, কানের দুল, নাকের নথ, গলার হার, হাতের ব্রেসলেট, কোমরের বিছা ও পায়ের নূপুর থেকে শুরু করে নারীদের সব ধরনের গয়না তৈরি করা হয় এই গহনা গ্রামে। আর যে কেউ কাস্টমাইজ অর্ডার করলে বানিয়ে দেওয়া হয় পছন্দসই গয়না।

ভাকুর্তা গহনা তৈরির পদ্ধতি
Jewellery Categorization

গহনার নামকরন

গহনার নামকরণ নিয়ে বলতে গেলে, গলার, হাতের, কোমরের এবং পায়ের গহনার আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। গলার, হাতের, পায়ের, কোমরের, কানের, নাকের, মাথার এবং কপালের গহনা ছাড়াও আরও কিছু গহনার নাম আছে, যেগুলো শরীরের অন্যান্য অংশে পরা হয়।

গহনার নামগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত, এবং প্রাচীন ও আধুনিক ফ্যাশনের মধ্যে তাদের ব্যবহার ও চারিত্রক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীও নামকরন করা হয়ে থাকে। অনেক সময় গহনাশিল্পি দ্বারাও নাম করন হয়ে থাকে, তবে তা আধুনিক গহনা শিল্পিদের ভিতর বিভিন্ন নামকরনের প্রবনতা দেখা যাচ্ছে।

১. গলার গহনা:
হার/নেকলেস, চোকার, মঙ্গলসূত্র, গলার মালা,
লকেট, কন্ঠচিক, হাসলি, হার, মটর মালা, বিছামালা, সিতাহার, শীলড নেকলেছ, নয়ন কারা নেকলেছ।

২. হাতের গহনা:
বালা/চুড়ি,কাঁকন, ব্রেসলেট, আঙ্গুরী/আংটি, পলাশী, হাতফুল, গোলাপ বালা, চুর, রতন চুর, বাজু বান, মাস্তানা, আংটি, রুলি, মটর রুলি, ফারফোর অনন্ত, পেচি সাপ তাগা, নোয়া, নখফুল, বাজুবন্দ

৩. পায়ের গহনা:
নূপুর/পায়েল, মল, তাগা/অলতা, খারু, পায়ের আংটি।


৪.কোমরের গহনা:
কামরবন্দ/কামরপাটি, কোটা, চাবির গোছা, বিছা, গুঞ্জন বেল্ট

৫. কানের গহনা:
ঝুমকা, বালি, টপস, কানফুল, কর্ণফুল, ঝাঁক ঝুমকা, দুল, মাখরি, কান পাশা, বালি, সুই সুতা, সাগরিকা,

৬. নাকের গহনা:
নথ, নথনি, নাকফুল, নোলক, টিপ নাক ফুল

৭. মাথার গহনা:
টিকলি, মাঙ্গটিকা, মাথাপট্টি, ঝুমর, টায়রা, বিন্দি, চন্দন বোর,

গয়নার দামদর

প্রতি পিস নেকলেস ৩০০ থেকে হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। এছাড়া চুড়ির জোড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, সীতাহার ৬০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, নুপুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, নাকফুল ২০ থেকে ৩৫ টাকা এবং টিকলি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। তবে গয়নাগুলো গ্রাম থেকে পাইকারদের হাত ধরে চলে যায় রাজধানীর নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, গাউছিয়াসহ সারা দেশের প্রায় সব বিপণিবিতানে, যা পরে মার্কেটে দেড় থেকে দুইগুণ বেশি দামে খুচরা বিক্রি করা হয়।প্রতি পিস নেকলেস ৩০০ থেকে হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। এছাড়া চুড়ির জোড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, সীতাহার ৬০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, নুপুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, নাকফুল ২০ থেকে ৩৫ টাকা এবং টিকলি ৮০ থেকে ১০০ টাকা।

তবে গয়নাগুলো গ্রাম থেকে পাইকারদের হাত ধরে চলে যায় রাজধানীর নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, গাউছিয়াসহ সারা দেশের প্রায় সব বিপণিবিতানে, যা পরে মার্কেটে দেড় থেকে দুইগুণ বেশি দামে খুচরা বিক্রি করা হয়।

গয়নাশিল্পদের জীবনমান উন্নয়নে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শত বছরের এই পেশাজীবী কারিগরদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে বেসরকারি সংস্থা সো21শ্যাল আপলিফটমেন্ট সোসাইটি (সাস)। ভাকুর্তার  জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের সমস্যা থেকে উত্তরণ ও এ ব্যাবসা প্রসারে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় ভাকুর্তায় সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্টের আওতায় স্বাস্থ্যসম্মত ও কর্মবান্ধব ইমিটেশন  জুয়েলারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যোক্তা ও কারিগরদের আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজাইন প্রচলনের মাধ্যমে পণ্যের মান উন্নয়ন, কারিগরি জ্ঞান ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

৩০০ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় তৈরি করা গয়না
কেন বৈশ্বিক হতে পারছে না?

The jewels of the Mughals মুঘলদের রত্ন ভান্ডার x bfa x al mahin x fxyz

এই রত্নগুলি যেমন সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য এবং মর্যাদার প্রতীক ছিল, তেমনি সেগুলি সুরক্ষামূলক তাবিজ হিসেবেও। চার খন্ডে বিস্তারিত দেখতে পাবেন এই লিংকে-


তথ্যসূত্র:

jugantor.com

ittefaq.com.bd/


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Instagram did not return a 200.
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!