লালন সাঁইজী Fakir Lalon Shah

লালন সাঁইজী | Fakir Lalon Shah

লালন সাঁইজী বিশ্বাস করতেন সব মানুষের মধ্যেই বাস করে এক ‘মনের মানুষ’। আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে। দেহের ভেতরেই সেই মনের মানুষ বা যাকে তিনি ‘অচিন পাখি’ বলেছেন।

এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।

প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন মানবতাবাদী এবং তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ, ধর্ম, জাত, কূল, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না। তিনি মানুষের ভেতরের মানুষকে বাঁচানোর জন্য জীবনভর যুদ্ধ করে গিয়েছেন। লালন ফকির বিশ্বাস করতেন সব মানুষের মধ্যেই বাস করে এক ‘মনের মানুষ’। আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে। দেহের ভেতরেই সেই মনের মানুষ বা যাকে তিনি ‘অচিন পাখি’ বলেছেন।

“যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে” – এই ছিল লালনের দর্শন। বৈষ্ণব সহজিয়া, বৌদ্ধ সহজিয়া ও সুফিবাদের সংমিশ্রণে মানবগুরুর ভজনা, দেহ-কেন্দ্রিক সাধনাই লালন প্রদর্শিত বাউল ধর্মের মূলমন্ত্র।

বাংলা লোকসাহিত্যের একটি অংশ বাউল গান

Baul song is a part of Bengali folklore

বাউল একটি বিশেষ লোকাচার ও ধর্মমত। লালনকে বাউল মত এবং গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন এবং একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাদের অভ্যাস। বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ বাউল গান। বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক। তারা মানবতার বাণী প্রচার করেন। বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেন আত্মাকে।  তাদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করেন।

২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল গানকে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।

লালন সাঁইজীর তীর্থ যাত্রা ও প্রথম মৃত্যু এবং নবজীবন

Fakir Lalon Shah

লালন ফকিরের সঠিক জন্ম ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কোন কোন লালন গবেষক মনে করেন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ভাড়ারা গ্রামে লালন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিছু সূত্রে পাওয়া যায় লালন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হারিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায়, তার পিতার নাম কাজী দরীবুল্লাহ্ দেওয়ান। কাজী তাদের বংশগত উপাধি। অনেকের মতে তার বাবা মাধব কর ও মা পদ্মাবতীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। কথিত আছে শৈশবে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় অল্প বয়সেই তাঁর ওপর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ তাঁর হয়নি। তবে গানের প্রতি তার অন্যরকম টান ছিলো। ভাড়ারা গ্রামে কবিগান,পালাগান,কীর্তন সহ নানা রকম গানের আসর বসতো। তিনি সেই আসর মাতানোর একজন ছিলেন। মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনতো।

লালন পূন্যলাভের আশায় মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে গঙ্গা স্নানে যান। গঙ্গা স্নান সেরে লালন যখন সঙ্গীদের সাথে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তিনি আকস্মিকভাবে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। রোগের যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সঙ্গীরা মনে করলেন তিনি মারা গেছেন।  তারা তার মুখাগ্নি করেই  নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়।

নদীতে ভাসতে ভাসতে লালনের দেহ এক ঘাটে পৌঁছায়। এক মুসলমান রমণী নদীকূল থেকে লালনের সংজ্ঞাহীন দেহ উদ্ধার করে সেবাশুশ্রূষা করে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। বসন্ত রোগে লালনের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় এবং মুখাগ্নির কারণে তার মুখমন্ডলে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সুস্থ্য হয়ে লালন ফিরেন মায়ের কোলে, নিজ গ্রামে। সমাজপতিদের সাফ কথা সে মুসলমান বাড়ির জল খেয়েছে তাই তাঁকে আর এই সমাজে থাকতে দেয়া যাবে না। সেদিন ধর্মের অজুহাতে লালনকে সমাজ থেকে বের করে দেয়া হয়। যে জাতের কারণে লালনকে সমাজ থেকে, পরিবার থেকে বিচ্যুত করা হয়েছিলো, সেই জাত-পাতের বিরুদ্ধে লালন গানের মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এবং এখান থেকেই হয় তাঁর নতুন জন্ম।

তিনি তাঁর গানে উল্লেখ করেছেন-

” জাত না গেলে পাইনে হরি

কি ছার জাতের গৌরব করি

ছুঁসনে বলিয়ে।

লালন কয় জাত হাতে পেলে

পুড়াতাম আগুন দিয়ে ॥ “

লালন সাঁইজীর দর্শন

Darshan of Fakir Lalon Shah

লালন এই জাত-পাত ও ধর্ম বর্ণ-বিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি জাত ধর্ম বর্ণ গোত্রহীন সমাজ গড়ে তুলতে। সবকিছুর ওপরে তিনি স্থান দিয়েছিলেন মানবতাবাদকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লালনের জীবদ্দশায় তাঁকে কোনধরনের ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করতেও দেখা যায়নি। নিজের সাধনা দিয়ে তিনি হিন্দুধর্ম এবং ইসলামধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর রচিত গানে এর প্রচুর নিদর্শন রয়েছে। মুসলমানদের সাথে তার সুসম্পর্কের কারণে অনেকে তাকে মুসলমান বলে মনে করতেন। আবার বৈষ্ণবধর্মের আলোচনা করতে দেখে হিন্দুরা তাকে বৈষ্ণব মনে করতেন। প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন মানবতাবাদী এবং তিনি ধর্ম, জাত, কূল, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না।

লালন তাঁর গানের মাধ্যমে নিজের ধর্মীয় অবস্থান পরিস্কার করে  গেছেন। তিনি বলেছেন-

” সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে

লালন বলে জাতের কি রুপ দেখলাম না এ নজরে ॥ “

লালন মনে করেছেন ধর্ম হলো তাই যা ধারন করা হয়। বাউল মন যা ধারন করে তাই- ই বাউলের ধর্ম। আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেছিলেন। তার সহজ-সরল শব্দময় এই গানে মানবজীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। লালনের বেশ কিছু রচনা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে অতীব সংবেদনশীল ছিলেন।

কুষ্টিয়া জেলায় অবস্থিত লালন সাঁইয়ের মাজার

লালন সাঁইজীর ছেঁউড়িয়ার আখড়া

লালনের ধারনা গুরু ঈশ্বরেরই প্রতিচ্ছায়া। গুরুকে ভক্তি শ্রদ্ধা জানালে তা ঈশ্বরকেই জানানো হয়। গুরু ছাড়া কোন সাধনা সাধ্য হয় না। গুরু সিরাজ সাঁই এর নির্দেশে লালন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে আখড়া করেন। যেখানে তিনি তার শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন।

তার শিষ্যরা তাকে “সাঁই” বলে সম্বোধন করতেন। তিনি প্রতি শীতকালে আখড়ায় একটি ভান্ডারা (মহোৎসব) আয়োজন করতেন। যেখানে সহস্রাধিক শিষ্য ও সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত হতেন এবং সেখানে সংগীত ও আলোচনা হত।

ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৩তম তিরোধান দিবস

লালন সাঁইজী Fakir Lalon Shah

১৮৯০সালের ১৭ অক্টোবর শুক্রবার। সারারাত ধরে আখড়ায় বাউল গান নিয়ে শিষ্য ভক্তদের সময় দিয়েছেন। ভোর ৫টায় তিনি সকল ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “আমি চলিলাম”। এই কথার আধা ঘন্টা পর তিনি সকলকে কাঁদিয়ে সত্যি সত্যিই একেবারে চলে যান। ১১৬ বছর বয়সে বাউল সম্রাট সাধক লালন শাহ্‌ ইন্তেকাল করেন।

তার নির্দেশ থাকায় তার মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতি নীতিই পালন করা হয় নি। তারই উপদেশ অনুসারে ছেউড়িয়ায় তার আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তার সমাধি গড়ে তোলা হয়।


এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর , বিবিসি বাংলা


আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম


fashion content writer

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link