লুঙ্গি কথন lungi tales

men's skirt usually tied around the lower waist

লুঙ্গি কথন | LUNGI CONVERSE

দেশ ভাগের পর পূর্ববাংলায় হিন্দুদের থেকে মুসলমানরা যে আলাদা তা প্রমান করতে কাকাকে চাচা, জলকে পানি বলা কিংবা হাত জোড় করে নমস্কার পরিহার করার মতই ধুতির জায়গা দখল করে নেয় লুঙ্গি। বলা যায় বাংলায় লুঙ্গির প্রচলন মুসলমানদের হাত ধরেই।

Spread the love

দেশ ভাগের পর পূর্ববাংলায় হিন্দুদের থেকে মুসলমানরা যে আলাদা তা প্রমান করতে কাকাকে চাচা, জলকে পানি বলা কিংবা হাত জোড় করে নমস্কার পরিহার করার মতই ধুতির জায়গা দখল করে নেয় লুঙ্গি। বলা যায় বাংলায় লুঙ্গির প্রচলন মুসলমানদের হাত ধরেই। বিশ শতকের দিকে কিছু কিছু মুসলমানদের মধ্যে লুঙ্গি পরিধানের প্রচলন শুরু হয়। সেই সময় রেঙ্গুন (মিয়ানমার) থেকে লুঙ্গি আমদানি হতো। ( লুঙ্গি মায়ানমারের জাতীয় পোশাক হিসেবে স্বীকৃত )। সেই সময় একটু অবস্থাপন্ন সৌখিন ব্যক্তিদের কাছে ‘নয়ন সুখ’ নামের সাদা মিহি সুতার এক প্রকার লুঙ্গির খুব কদর ছিল।

আমাদের জাতীয় পোশাক কী? অনেকে বলেন লুঙ্গি পাঞ্জাবি। আদতে আমাদের জাতীয় পোশাক বলে কিছুই তো নেই। তবে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরতে বাংলাদেশীরা বেশ পছন্দ করে। বাংলাদেশে বা বাঙালীর আদি ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে এক সময় বাঙালীদের পছন্দের পোশাক ধুতি ছিল। সেই থেকেই একটা সাধারন ধারনা যে আমাদের জাতীয় পোশাক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি।

মাওলানা ভাসানী
মাওলানা ভাসানী লুঙ্গি পরতেন বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজের সময়ও

লুঙ্গির ইতিহাস

ভেস্তি নামক এক ধরনের পোশাককে লুঙ্গির পূর্বসূরী বলে মনে করা হয়। ইতিহাসে উল্লেখিত আছে মসলিন কাপড়ের ভেস্তি পোশাক তামিল থেকে ব্যবিলনে রপ্তানী হত। ব্যবিলনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিবন্ধে ‘সিন্ধু’ শব্দ খুঁজে পাওয়া যায়। তামিল ভাষায় সিন্ধু অর্থ কাপড় বা পোশাক। লুঙ্গি একটি বর্মী ভাষার শব্দ। গবেষণায় দেখা গেছে, এর সূচনা হয়েছে দক্ষিণ ভারতে বর্তমানে তামিলনাডুতে। তার সময়ও কিন্তু বেশ দীর্ঘ, প্রায় ৮০০ বছর।  

লুঙ্গি অথবা লোঙ্গাই মায়ানমারের জাতীয় পোশাক হিসেবে স্বীকৃত

মায়ানমারে বার্মিজ ভাষায় লুঙ্গিকে লোঙ্গাই বলে ডাকা হয়। নারীদের জন্য এটি তামাইন হিসেবে পরিচিত, যা খুবই জনপ্রিয়। বিভিন্ন সুতায় বোনা যেমন সুতি এবং সিল্কের লুঙ্গি বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সময়ে পরিধান করা হয়।

আমাদের লুঙ্গি

লুঙ্গি সাধারণত বাংলাদেশী সব সম্প্রদায়ের পুরুষদেরই পরতে দেখা যায়, যদিও এটি কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে পরা হয় না। আমাদের অনেক পোশাক হারিয়ে গেলেও ঐতিহ্য আর আরামের কারনে দেশের প্রাচীন পোশাক হিসেবে লুঙ্গি টিকে আছে সগৌরবে। অনেক দেশেই লুঙ্গির প্রচলন রয়েছে, পরিচিতিতে বা পরার স্টাইলের ভিন্নতার কারনে আমাদের চেনা লুঙ্গিই কোনো দেশে সারং, কোথাও আবার মুন্ডা বা কাইলি। লোঙ্গাই নামেও ডাকে কোনো কোনো দেশ। কোনো দেশের মানুষ লুঙ্গি পরে গিট্টু দিয়ে, কোনো দেশে লুঙ্গির সঙ্গে বেল্টও পরা হয়। আবার অনেকে লুঙ্গির ভেতরে ওপরের পোশাকটি ঢুকিয়েও (ইন) পরেন। বাংলাদেশে পাঞ্জাবি, শার্ট বা টি-শার্টের সঙ্গে লুঙ্গি পরার চল আছে। গ্রামে আবার লুঙ্গির সঙ্গে শুধু একটা গামছা কাঁধেও বেরিয়ে পড়তে দেখা যায়।

বাংলাদেশের লুঙ্গির প্রধান বৈশিষ্ট্য চেক। ছোট, বড়, মাঝারি চেকের যেমন রকমফের আছে তেমনি কালার এ আছে নিজস্বতা। তবে ইদানিং কালে ফ্যাশনের নিয়ম মেনে পরিবর্তন এসেছে লুঙ্গির কালার এবং নকশাতে। মূলত স্বাধীনতার পর থেকেই অল্পস্বল্প পরিবর্তন আসে যখন থেকে দেশীয় পোশাকের সাথে দেশীয় ফ্যাশন হাউস গুলো যাত্রা শুরু করে। জানা যায় নব্বইয়ের দশকে ডিজাইনার চন্দ্র শেখর সাহা প্রথমবার কালো লুঙ্গিতে নতুন নকশা তৈরি করেছিলেন। চেক ছাড়াও লুঙ্গিতে ছাপা, বাটিক, টাই-ডাই, ব্লক, এমব্রয়ডারিসহ নানা নিরীক্ষামূলক কাজ দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে।

আড়ং, প্রাইড, লা রিভ, ইনফিনিটি, অঞ্জন’স, কে ক্র্যাফট, নিপুণসহ দেশের প্রথম সারির অনেক ফ্যাশন হাউস লুঙ্গি-কে আধুনিক রুপ দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । এছাড়া বাজারে অনুসন্ধান, আমানত শাহ, স্ট্যান্ডার্ড, পাকিজা, এটিএম, বেক্সি লুঙ্গি ইত্যাদি ব্র্যান্ডের লুঙ্গি পাওয়া যায়।

contributor needed for bfa

লুঙ্গি গ্রাম

লুঙ্গি শিল্পের গ্রাম নামে পরিচিত তামাই গ্রাম, তাঁতশিল্পের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য বহন করে চলছে। বলা হয় বাংলাদেশে উৎপাদিত লুঙ্গির ৬০ শতাংশই এই গ্রামে তৈরি হয়।

সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার একটি গ্রাম তামাই। গ্রামের আয়তন ৫ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা ২০ হাজারের উপরে। সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও এই গ্রামে ১২ হাজারের উপরে পাওয়ারলুম এবং বিপুল সংখ্যক হ্যান্ডলুম রয়েছে। যা এক একটি পাওয়ারলুম গড়ে দৈনিক ৮ পিস লুঙ্গি উৎপাদন করে। সাথে হ্যান্ডলুম এর লুঙ্গি তো আছেই।

একটা সময় ছিলো যে হাতে বোনা লুঙ্গি মানেই আমাদের লুঙ্গি, দেশীয় লুঙ্গি। তা এখন অতীত। যান্ত্রিক তাঁতের প্রচলন বাড়ায় হ্যান্ডলুম -এ বোনা লুঙ্গি হয়ে পড়েছে কোণঠাসা। তাঁতীরা চিত্তরঞ্জন তাঁত ছেড়ে পাওয়ার লুমে ঝুঁকে পড়েছে। অল্প পরিমাণে হলেও হাত তাঁতে বোনা লুঙ্গি টিকে আছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের রুহিতপুর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের মতো কয়েকটি অঞ্চলে।

আধুনিক জীবনধারায় লুঙ্গি

লুঙ্গি গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের পোশাক হলেও এখন চেষ্টা চলছে শহুরে মানুষের পোশাক করে তুলতে। তার ধারাবাহিকতায় দেশীয় ফ্যাশন হাউজ রঙ ( বর্তমানে বিশ্বরঙ ) ২০১৪ সালে বৈশাখের পোশাক ডিজাইনের থিম ছিলো বাংলার লুঙ্গি। তবে তা উপস্থাপন করা হয়েছে একদমই নতুন রূপে। ছেলেদের টুপি, পাঞ্জাবি, কটি থেকে শুরু করে মেয়েদের শাড়ি এবং কুর্তায়ও ব্যবহার হয়েছে লুঙ্গির চেক।

লুঙ্গির চেককে ফ্যাশনেবলভাবে উপস্থাপনের জন্য শাড়িতে এর সঙ্গে ব্লকপ্রিন্ট ও আলাদা পাড় ব্যবহার করা হয়েছে আর কুর্তা, পাঞ্জাবি ও কটিতে করা হয়েছে প্যাচওয়ার্ক। হাল ফ্যাশনের সঙ্গে মানানসই থাকার জন্য বৈচিত্র্য আনা হয়েছে মেয়েদের কুর্তার কাটেও। চেকের মধ্যে নীল, ময়ূর নীল, সবুজ এবং সাদা রঙই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।

Bishwo Rang Fan Club

Shop online: www.bishworang.com| further queries: +880 1819-257768

স্টাইল মানে পাকিজা লুঙ্গী, এই বৈশাখে জীবন হোক আরও রঙ্গিন …. এমন শ্রোগান নিয়ে পাকিজা ২০১৭ সালে মেট্রো লাইফে লুঙ্গির সৈান্দর্য উপস্থঅপন করার চেষ্টা করে। যা সত্যিই প্রশংসনীয়।

বিশ্ব ফ্যাশনে লুঙ্গি

বোতাম, দড়ি বা বেল্ট, ফিতা, চেইন, সেফটিপিন ছাড়া কেমন করে গিঁট দিয়ে কোমরে জড়িয়ে পায়ের দিকে ঝুলিয়ে একটা কাপড় পরিধান করে তা এখনও অনেক বিদেশীদের কাছে আশ্চর্যের। বিদেশীদের, বিশেষ করে বিদেশিনী নারীদের জন্য এ সমস্যা দূর করতে সম্প্রতি স্প্যানিশ গ্লোবাল ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘জারা’ লুঙ্গির আধুনিকীকরণ করে নতুন ফ্যাশন বাজারে চালু করেছে এবং তারা তাদের পণ্যের নাম দিয়েছে ‘চেক মিনি স্কার্ট’), এগুলো পলিয়েস্টার ও ভিস্কোস দিয়ে তৈরি। সেই স্কার্টের বিশেষত্ব হচ্ছে ‘মুড়ি-সেলাই করা অংশ লম্বালম্বিভাবে কাটা’ এবং ‘পেছনে বন্ধ করার জন্য ভাঁজ বরাবর লুকানো জিপার দেয়া। তারা সেসব স্কার্টের দামও রেখেছে অত্যধিক, যা বাংলাদেশী প্রায় ৮ হাজার টাকা।

zara

লুঙ্গির হাট

বাংলাদেশে বেশির ভাগ লুঙ্গি উৎপাদন হয় নরসিংদী, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায়। লুঙ্গির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বসে নরসিংদীর বাবুরহাট, সিরাগঞ্জের শাহজাদপুর ও টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। মূলত এসব বাজার থেকেই সারা দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা লুঙ্গি কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। এছাড়া নরসিংদীর লুঙ্গি ২০০০ সাল থেকে রফতানিও করা শুরু হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন লুঙ্গি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দেশ ও বিদেশের বাজারে প্রতি বছর বিভিন্ন ধরনের প্রায় সাড়ে ১০ কোটি পিস লুঙ্গি বাজারজাত করে এবং ২০২০ সালে তা বেড়ে প্রায় ১১ কোটি পিস লুঙ্গি উৎপাদন এবং সরবরাহ করেছে। বিদেশে লুঙ্গি রফতানি করে ২০১৯ সালে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে।

বাংলাদেশ লুঙ্গি ম্যানুফ্যাকচারার্স, এক্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী


তথ্যসূত্র :

daily-bangladesh.com

prothomalo.com

lungiwalabd.wordpress.com

bn.wikipedia.org


About Post Author

Spread the love

আপনার মূল্যবান মতামত এর অপেক্ষায়

%d bloggers like this: