শীতল পাটি প্রাকৃতিক গাছ থেকে তৈরি এক ধরনের মেঝেতে পাতা আসন। মুলত এটি এক ধরণের মাদুর যেখানে আবহমান গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, রূপ এবং সৌন্দর্যকে কারুকাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। শীতল পাটি কে নকশি পাটিও বলা হয়। এটি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প। মুরতা নামে একধরনের ঝোপজাতীয় গাছের বেত দিয়ে তৈরি হয়। পাটি বুননের কাজে যারা জড়িত থাকেন তাদের মূলত ‘পাটিয়াল’ বা ‘পাটিকর’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
শীতল পাটি একই সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প ও লোকশিল্প।
একটা সময় ছিল যখন গ্রামের বাড়িতে অতিথি আসলে বসতে দেয়া হতো এসব পাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্য থাকতো বিশেষ ধরনের পাটি। শীতলপাটির বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে গরমে ঠান্ডা অনুভূত হয়। এটাই হয়তো শীতল পাটির নামের উৎস। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হওয়ার কারণে এই পাটি একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত।
সিলেটের বালাগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা মূলত এ শিল্পের আদি স্থান। যুগ যুগ ধরেই বংশপরম্পরায় এসব গ্রামের নারী-পুরুষেরা পাটি বুননের কাজ করেন। জাতীয় জাদুঘরের হিসেবানুযায়ী সিলেট বিভাগের একশত গ্রামের প্রায় চার হাজার পরিবার এই শিল্পের হাল ধরে আছেন। পরিবারের গৃহিণীরাই মূলত পাটি বোনার কাজটি করেন। পুরুষেরা কেবল মুরতা সংগ্রহের বিষয়টি দেখভাল করে থাকেন। বংশ পরম্পরায় এই কারুশিল্পকে তারা একশত বছরের বেশি সময় ধরে লালন করে আসছে।
শয্যাতে শুইয়া কন্যা ভাবে মনে মন।
কোথা তনে আইল পুরুষ চান্দের মতন ।।
অতিথ বলিয়া যদি আইত আমার বাড়ি।
বাপেরে কইয়া আমি বইতে দিতাম পিড়ি।।
শুইতে দিতাম শীতলপাটি বাটাভরা পান।
আইত যদি সোনার অতিথ যৌবন করতাম দান।।
-চন্দ্রাবতী রচিত মলুয়া, শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন কতৃক সঙ্কলিত মৈমনসিংহ-গীতিকা, পৃষ্ঠা-৫৭
শীতল পাটি তৈরীর ধাপ
শীতল পাটি তৈরী হয় মুরতা বা পাটিবেত থেকে। এই পাটিবেত সাধারণভাবে মোস্তাক নামেও পরিচিত। অনেকটা সরু বাঁশের মতোই দেখতে। এরা বেশির ভাগ সময় ঝোপ আকারেই জন্মে। বিভিন্ন অঞ্চলে কৃত্রিমভাবে চাষাবাদ করা হলেও সিলেটের বনাঞ্চলগুলোতে এই উদ্ভিদ প্রাকৃতিকভাবেই পাওয়া যায়
পাটি তৈরীতে মুরতা সংগ্রহ করে প্রথমে এর ডালপালা ছেঁটে ফেলে কান্ডটিকে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর মাটিতে বটি ফেলে মুরতার কাণ্ডটিকে চিড়ে লম্বালম্বি কমপক্ষে চারটি ফালি বের করা হয়। কাণ্ডের ভেতর ভাগে সাদা নরম অংশ থাকে। যাকে বলে ‘বুকা’। এই বুকা চেঁছে ফেলে দেয়া হয়। পাটি যারা তৈরি করে থাকে তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে মুর্তার ছাল থেকে যতটা সম্ভব সরু ও পাতলা ‘বেতী’ তৈরি করে নেয়া। মূলত ভেজা কান্ড থেকেই পাটিয়ালদের পাটি তৈরির কাজের প্রথম ধাপ শুরু হয়।
বেতী তৈরি হওয়ার পর এগুলো কে আটিঁ করে বাধা হয়। যাকে বিড়া বলা হয়। তারপর সেই বিড়া একটা পাত্রে পানির সঙ্গে ভাতের মাড় ,আমড়া, জারুল, তেতুল আর কাউপাতা সহ বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতা মিশিয়ে সিদ্ধ করা হয়। সিদ্ব করার ফলে বেতী গুলো মোলায়েম, মসৃণ ও চকচকে হয়। শীতল পাটির নকশা আকর্ষনীয় এবং ফুটিয়ে তোলার জন্য আঁটি গুলো আলাদা করে রঙ মেশানো পানিতে সিদ্ধ করে নেয়া হয়।
এরপর দক্ষ কারিগর/ পাটিকর মাটিতে বসে দৈঘ্য বরাবর এবং প্রস্থ বরাবর বেতী গুলো বিছিয়ে নেয় এবং বেতীগুলোকে ঘন আঁট-সাঁট করে এমন করে বসানো হয় যাতে পাটিতে ফাঁকা বেড় না হয়। পাটি বোনার সময় পাটিকর বুড়ো আঙ্গুল এবং মধ্যমায় কাপড় পেঁচিয়ে নেয় যাতে সরু বেতীর ধারে আঙ্গুল কেটে না যায়। নকশা ফুটিয় তুলতে প্রাকৃতিক যে রঙ এর বেতী তার সাথে রঙ করা বেতী নকশা অনুযায়ী মিশিয়ে পাটি তৈরী করে। বলাবাহল্য যে পাটিতে কোন নকশা আগে থেকে আঁকা থাকে না। পাটিকর তার অভিজ্ঞতা দিয়ে নকশা ফুটিয়ৈ তোলে। যেখানে গ্রামীন জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, পালা-পার্বনের ছবি গুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে পাটিকরে বুননে।

স্বিকৃতি
জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো এবং বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ এর ১২তম অধিবেশনে ৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতল পাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নিবর্স্তুক বা ইনট্যানজিবল (Intangible) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১১৭টি দেশের ৪৭০টি ঐতিহ্যবাহী উপাদান জায়গা পেয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আছে জামদানি, বাউলগান ও মঙ্গল শোভাযাত্রা।

ইতিহাস
শীতল পাটির কাহিনি অনেক দীর্ঘ। ব্রিটিশ আমল থেকেই এর কদর। ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদে শীতল পাটি শোভা পেয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি মোগল শাসনামলে সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং ব্রিটিশ আমলে রানি ভিক্টোরিয়ার রাজদরবারে উপহার হিসেবে গিয়েছিল। জানা যায়, ১৯১৯ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমন্ত্রিত হয়ে সিলেটে সেখানকার বেত ও বাঁশের বানানো চেয়ার টেবিল, ব্যাগ ইত্যাদি দেখে অভিভূত হয়ে কয়েক দফায় কিনে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ব্যবহার করেছিলেন।
শীতলপাটি কোন কোন জেলায় তৈরী হয়?
সিলেট অঞ্চলের শীতল পাটি
বৃহত্তর সিলেটের বালাগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার মূলত এ শিল্পের আদিস্থান। শীতল পাটির জন্য বিখ্যাত। পরিচিতি পেয়েছে পাটিপল্লি নামে। কাশীপুর গ্রামে এখন ১৫টি পরিবার শীতলপাটি বুননের সঙ্গে। এ ছাড়া মৌলভীবাজারের রাজনগর এলাকার ১০০ গ্রামের প্রায় ৪ হাজার পরিবার সরাসরি এ কারুশিল্পের সঙ্গে জড়িত।
বরিশাল অঞ্চলের শীতল পাটি
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি, ডহশংকর, সাংগর, জগন্নাথপুর গ্রামের প্রায় ২০০ টি পরিবার। এছাড়া রাজাপুর সদর, নলছিটির তিমিরকাঠ, কামদেবপুর প্রভৃতি জায়গায় শীতলপাটি তৈরি হয়। ঝালকাঠির কাঁসারিপট্রির কয়েকটা বাড়িতে শীতলপাটি তৈরি হয়। সব মিলিয়ে ঝালকাঠির প্রায় ৩০০ (তিনশত) টি এর বেশি পরিবার শীতলপাটির সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত এবং এর মাধ্যমেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। ঝালকাঠির সবচেয়ে বেশি শীতলপাটি তৈরি হয় হাইলাকাঠি গ্রামে।
টাঙ্গাইলের শীতল পাটি
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার হিঙ্গানগর, গজিয়াবাড়ি, আটিয়া ও নাল্লাপাড়াসহ বেশ কয়েকটি শীতল পাটি সমৃদ্ধ গ্রাম এছাড়াও কলাবাড়ি সংলগ্ন পাইট্টাপাড়ার দুইহাজারের বেশি পরিবার এই শীতলপাটি তৈরির সাথে জড়িত বলে তথ্য পাওয়া যায়।
টাঙ্গাইলের শীতল পাটির হাট
বর্ষা শেষের মৌসুমে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর বাজারে জমে ওঠে বড় পাটির হাট। সালুটিকর সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি গ্রাম্য হাট। সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট—এ তিন উপজেলার মাঝামাঝি অবস্থানে থাকায় পাটির এ হাটটি সব সময়ই জমজমাট থাকে। পাটিগুলো হাটে বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
শীতল পাটির বিভিন্ন নাম
বুনন এবং নকশা অনুযায়ী শীতলপাটিরও রয়েছে নানান নাম আর জাত। এর মধ্যে ‘পয়সা’, ‘সিকি’, ‘শাপলা’, ‘সোনামুড়ি’, ‘টিক্কা’ এ পাটি গুলো গ্রামের গৃহস্থ পরিবারে বেশি ব্যবহার হয়। ‘সিকি’ পাটি খুবই মসৃণ হয়। কথিত আছে, মসৃণতার কারণে সিকির ওপর দিয়ে সাপ চলাচল করতে পারে না। এ ছাড়া অভিজাত পাটি হিসেবে ‘লালগালিচা’, ‘আধুলি’, ‘মিহি’ নামের পাটি গুলো চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হয়।
শীতল পাটির নকশা
নকশা হিসাবে গ্রামীন জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, পালা-পার্বনের ছবি গুলো ফুটে ওঠে। পাটিতে পৌরাণিক কাহিনিচিত্র, পাখি, ফুল-লতা-পাতা বা অন্যান্য জ্যামিতিক নকশা প্রধান্য বেশি থাকে। এছাড়াও ইদানিং কালে দক্ষ পাটিকর নতুন নতুন নকশা করার ব্যাপারে আগ্রহী। বিভিন্ন মেলায় দেখা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রতিকৃত ফুটিয়ে তুলছে নকশী পাটিতে।
শীতল পাটির আরও ছবি
বোটনিপাটি
নোয়াখালির কোম্পানিগঞ্জ এলাকার বহু কারুশিল্পী এই বটনিপাটির সাথে জড়িত আছে পেশা ও সখের সুত্রে। এর মধ্যে কোম্পানিগঞ্জের একজন মরিয়ম বেগম যিনি শ্রেষ্ঠ কারুলিল্পী সন্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি তার মনন ও দক্ষতায় তৈরী করে চলেছেন ভিভিন্ন মটিফের বটনী পাটি। শুধু তাই নয় তিনি স্থানীয় গ্রামীন মহিলাদের স্বাবলম্বী করে তুলতে গঠন করেছেনে ‘নারী কুঠির’ নামে একটি সংগঠন।




সাধারণ শীতল পাটি
সাধারণ কিছু নকশী পাটি আছে যা নিত্যদিনের ব্যবহারে জন্য তৈরি করা হয়ে থাকে। নকশার ব্যাবহার কম থাকে বিধায় এর দামও অনেটা কম। এগুলো তৈরি করতে দক্ষ পাটিকরদের সময় লাগে এক থেকে দুই দিন। তবে নকশা কিংবা সাধারণ পাটি যা-ই হোক না কেন, তার দাম নির্ভর করে বুনন, রঙ, বেতির মসৃণতা আর কারুকার্যের নকশার উপর।
পোশাকে শীতল পাটির নকশা
শীতলপাটি একই সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প ও লোকশিল্প। আর এই ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবে তুলে ধরতে হবে। বেশি বেশি করে ব্রান্ডিং করতে হবে। তার ধারাবাহিকতায় দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো চেষ্টা করে ঐতিহ্যময় কারুশিল্পের নকশা গুলো পোশাকে নিয়ে আসতে যাতে এর বিভিন্ন মাত্রায় বৈচিত্রতা পায়।









তথ্যসূত্র
www.prothomalo.com
roar.media
bn.wikipedia.org
www.jagonews24.com
www.dailysangram.com
www.jhalakathi.gov.bd
www.bd-journal.com
www.djanata.com
আরও পড়ুন