শৈশবের খেলাধুলা childhood game 90s game in bangladesh

সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের খেলাধুলা

আপনার জীবনের কোন অধ্যায়টা সবচেয়ে সুন্দর ও আনন্দময়? প্রায় সকলেই একই উত্তর দিবে তা হলো তার শৈশব বা ছেলেবেলা। সবার মতো আমার শৈশবও হিরন্ময়।

Childhood
Games in
Bangladesh

কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ” আপনার জীবনের কোন অধ্যায়টা সবচেয়ে সুন্দর ও আনন্দময়?” প্রায় সকলেই একই উত্তর দিবে তা হলো তার শৈশব বা ছেলেবেলা। সবার মতো আমার শৈশবও হিরন্ময়। শৈশবের কথা মনে হলেই কিছু ছবি চোখের ভেসে উঠে যেমন, একটা মজা পুকুর, তালপাতার বাঁশি, শাপলা বিল, নারকেল পাতার ঘিন্নি, কাঠের গাড়ী, ফেলে দেয়া টায়ার, গুলতি, নাটাইসহ হাজারো অনুষঙ্গ। রঙিন সেই জীবনের রঙিনতম অংশ ছিলো নানান খেলাধূলা। সে সব দিনে সোনায় মোড়ানো বিকেলে আমাদের হাতে ধরা দিত পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ। দলবেঁধে হারিয়ে যেতাম অজানা এক স্বর্গে। নাম না জানা কিংবা নিজেরা ইচ্ছে মতো নাম বানিয়ে দেওয়া সেসব খেলাধূলার অনেকগুলোই আজকাল দেখতে পাওয়া যায় না। স্মৃতি হাতড়ে কয়েকটি খেলার নাম ও নিয়ম এখনো মনে করতে পারি। এখানে আমাদের শৈশবের খেলাধুলা -র কিছু বর্ননা দেয়া হলো। এসব খেলা ঐতিহ্যবাহী শিশুতোষ লোকজ খেলা গুলোর মধ্যে অন্যতম।

লোকজ শৈশবের খেলাধুলা কানামাছি

কানামাছি

কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছো। এই ছড়াটি শুনেননি এমন বাঙালি পাওয়া অসম্ভব। এখনো এই অর্থহীন ছড়াটি শুনলে স্মৃতিকাতর হই, বুকে পুলক জাগে। একটুকরো কাপড় দিয়ে একজনের চোখ বেঁধে দেয়া হয়। যার চোখ বাধা হয় তাকে বলা হয় কানা এবং বাকিরা তার চারদিকে বিচরণ করতে থাকে। এই বিচরণকারীেদর বলা হয় মাছি। কানা মাছিদের ধরতে চেষ্টা করে এবং যাকে ধরে ফেলতে পারে সেই পরবর্তী কানা হয়।

টায়ার দৌড়

পুরনো ফেলা দেয়া টায়াকে একটা প্রায় একহাতি লাঠি দিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে তার সঙ্গে অবিরাম ছুটে চলা। যান্ত্রিক জীবনে এই টায়ার অনেক গতি দিয়েছে কিন্তু সেই আনন্দ দিতে পারেনি। তাইতো টায়ার দেখলেই বলতে ইচ্ছে করে, ” দিনগুলি মোর সোনায় খাঁচায় রইলো না।”

লোকজ শৈশবের খেলাধুলা টায়ার দৌড়
লোকজ শৈশবের খেলাধুলা গোল্লাছুট

গোল্লাছুট

সবচেয়ে বেশি হইচইয়ের খেলা হলো গোল্লাছুট। দুই দলে ভাগ হয়ে খেলতে হয় এই খেলা। একদল নির্দিষ্ট একটা পয়েন্ট থেকে দৌড়ে আরেকটা নির্ধারিত পয়েন্টে পৌঁছাতে চেষ্টা করবে, তাদের দলে একজন থাকবে বিশেষ তাকে বলা হবে গোল্লা। আরেক দল মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকে তাদেরকে বাঁধা দিতে চেষ্টা করবে যেন কেউ নির্ধারিত জায়গায় পৌছুতে না পারে বিশেষ করে গোল্লাতো নয়ই। গোল্লাসহ তারা যে কয়েকজন পৌছাতো পারবে তত পয়েন্ট পাবে। হঠাৎ হঠাৎ খুব ছুটতে ইচ্ছে করে, আপনাদেরও কি করে?

লোকজ শৈশবের খেলাধুলা দাঁড়িয়াবান্ধা

দাঁড়িয়াবান্ধা

প্রতিপক্ষের বাঁধাকে অতিক্রম করে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চ এবং নতুন নতুন কৌশল আবিস্কারের নেশা এই দুয়ে মিলন হয় যে খেলায় সেটাই দাঁড়িয়াবান্ধা। মাটিতে দাগ কেটে ঘর তৈরি করা হয়। দেখতে অনেকটা ব্যাডমিন্টনের কোর্টের মত ঘর। কোর্টের নির্দিষ্ট জায়গায় লাইন বরাবর একদলের খেলোয়াড় পাহাদারের ভুমিকায় অবস্থান নেয় আরেক দল কৌশলে তাকে ফাঁকি দিয়ে পাড় হয়ে যেতে চায়। পাহারাদার যদি পাড় হওয়া ব্যক্তিকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে তাহলে সে আউট। এভাবে সবগুলো ঘর কেউ পাড়ি দিতে পারলে সে বিজয়ী। পাড় হয়ে যাওয়ার সফলতায় যে আনন্দ হতো এখন আর কোন সফলতায় সে আনন্দ পাই না।

সুপারি পাতার গাড়ী

যার শৈশবে সুপারি পাতার গাড়ী ছিলো না তার শৈশব চন্দ্রযান না চড়তে পারার আফসোসের। সুপারি গাছ থেকে ঝরে পড়া পাতার খোলে একজনকে বসিয়ে পাতার অন্য প্রান্ত ধরে এক বা একাদিক জন ধরে টেনে নিতো। আমাদের সেই গাড়ীতে গতি হয়তো ছিলো না তবে আজকালকার বহুগুণ গতিশীল গাড়ীগুলোর চেয়ে বেশি বিনোদন দিতো। আমাদের গাড়ীগুলোর গতি বেড়েছে, কমেছে আনন্দ।

লোকজ শৈশবের খেলাধুলা সুপারি পাতার গাড়ী
গুলতি লোকজ শৈশবের খেলাধুলা

গুলতি

গাছের ডাল কেটে ইংরেজি Y আকৃতির একটা কাঠামো বানাতে হয়। Y এর দুই মাথায় একটা ইলাস্টিক বেধে নিতে হয়। ইলাস্টিকের মাঝখানে একটা গোলাকার শক্ত কোন বস্তু রেখে পিছনের দিকে টান দিয়ে ছেড়ে দিলে বস্তুটি দূরে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এটাকে বলা হয় গুলতি। গুলতি দিয়ে ঢিল দিয়ে গাছ ফল পেরে খাওয়া আনন্দ থেকে কেউ বঞ্চিত হচ্ছে শুনলে আফসোস হয় তার জন্য। গুলতি দিয়ে মেরে কারো মাথা ফাটানো, মুল্যবান সামগ্রী ভেঙে ফেলার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে প্রত্যেকের।

শৈশবের খেলাধুলা childhood game 90s game in bangladesh
কুতকুত লোকজ শৈশবের খেলাধুলা

কুতকুত

কুতকুত সাধারণত মেয়েদের খেলা তবে ছেলেদেরও মাঝে মাঝে খেলতে দেখা যায়। মাটিতে দাগ টেনে ৭/৮ টি ঘর বানানো হয় তারপর প্রথম ঘরে মাটির চাড়া দিয়ে বানানো ঘুটি রেখে এক পা শুন্যে তুলে আরেক পায়ে লাফিয়ে সবগুলো ঘর ঘুটিয়ে নিয়ে ঘরতে হয় এবং কুতকুতকুত…. বলে দম দিতে হয়। গুটি যদি ঘর থেকে বের হয়ে যায় কিংবা দম ফুরিয়ে যায় তাহলে আউট।

গোলাপটগর বা ফুল টোক্কা টুক্কি

দলপতি সহ দুই দলে ভাগ হয়ে কিছুটা দূরত্বে মুখোমুখি বসে এই খেলা শুরু করতে হয়। দুই দল নিজেদের খেলোয়াড়দের নাম ফুলের নামে রেখে থাকে। দলপতি অপর পক্ষের যে কোনো খেলোয়াড়ের চোখ দুইহাতে চেপে ধরে সাংকেতিক নামে তার যে কোনো একজন খেলোয়াড়কে ডাকে। সে খেলোয়াড় এসে চোখ ধরে রাখা খেলোয়াড়টির কপালে আলতো করে টোকা দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে। চোখ খোলার পর ঐ খেলোয়াড়কে যে টোকা দিয়েছে তাকে শনাক্ত করতে হয়। সফল হলে সে সামনের দিকে লাফ দেবার সুযোগ পায়। এইভাবে যে দলের খেলোয়াড় লাফ দিয়ে প্রথমে সীমানা অতিক্রম করে সেই দলই জয়ী হয়। দলপতি সুর করে ডাকতো, আয় আমার শিমুল। কি সুন্দরই না লাগতো সেই সুরেলা সঙ্গীত।

ফুল টোক্কা টুক্কি লোকজ শৈশবের খেলাধুলা
মার্বেল লোকজ শৈশবের খেলাধুলা

মার্বেল

কাঁচ বা পাথেরের তৈরি গোলাকার ছোট ছোট বল হলো মার্বেল। মার্বেলের বহু রকমের খেলা আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো মুঠো ভর্তি মার্বেল দাগের বাইরে ছুঁড়ে মেরে নির্দিষ্ট আরেকটি মার্বেলে লাগানোর চেষ্টা। খেলায় জয়ের পুরস্কার হিসেবে বিজয়ী পরাজিতের মার্বেল নিয়ে নিতো। যারা ভালো খেলতে পারতো তারা অনেক মার্বেল জমিয়ে ফেলতো।


আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা


লাটিম লোকজ শৈশবের খেলাধুলা

লাটিম

একটা লম্বা সুতা ও বাজার থেকে কিনে আনা লাটিম হলো এই খেলার উপকরণ। লাটিমে সুতা পেচিয়ে বিশেষ কায়দায় নিক্ষেপ করতে হয় এবং লাটিমটি থাকতে হয় গোলাকার দাগের ভিতরে। সবার শেষে যার লাটিম স্থির হয় সেই জয়ী হয়। এছাড়াও আরো অনেক রকমের খেলা আছে লাটিমের। আঘাত করে অপরের লাটিম ভেঙে দেওয়া যুদ্ধ জয়ের আনন্দ দিতো।

ডাংগুলি

একটি দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা লাঠি যার স্থানীয় নাম ডাং এবং অপর একটা দুই বা আড়াই ইঞ্চি গুলি যা গোলাকার নয় আবার লম্বাও নয়, এই দুই উপকরণ দিয়ে খেলতে হয়। একটি নির্দিষ্ট ছোট গর্ত থেকে ডাং দিয়ে গুলিতে কিক মেরে দূরে পাঠিয়ে বারংবার আঘাত করে করে গুলিকে দূরে পাঠিয়ে ডাং দিয়ে মেপে দেখা হয় কতদূরে গেলো।

ডাংগুলি লোকজ শৈশবের খেলাধুলা
ইচিং বিচিং লোকজ শৈশবের খেলাধুলা

ইচিং বিচিং

দু’জন খেলোয়াড় পাশাপাশি বসে খেলোয়াড়দের অতিক্রম করার জন্য উচ্চতা নির্মাণ করে দেয়। প্রথমে তারা দু’পায়ের গোড়ালি দিয়ে উচ্চতা নির্মাণ করে। খেলোয়াড়রা উচ্চতা অতিক্রম করার পর তারা পায়ের উপর আরেক পা তুলে দিয়ে উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়। এইভাবে পায়ের উপর প্রসারিত করতল স্থাপন করে উচ্চতা বাড়িয়ে তোলা হয়। উচ্চতা অতিক্রম করার পর বসে থাকা খেলোয়াড়রা দুই পা মুক্ত করে ত্রিকোণাকার একটি সীমানা তৈরি করে। এই পায়ে ঘেরা স্থানটি পা তুলে দম দিতে দিতে বা ছড়া আওড়াতে আওড়াতে তিনবার অতিক্রম করে লাফ দিয়ে পার হতে হয়। এই সীমানা অতিক্রম করার পর বসে থাকা খেলোয়াড়দের যুক্ত পাকে প্রতিটি খেলোয়াড় শূন্যে লাফিয়ে ইচিং বিচিং ছড়া বলতে বলতে দুইবার করে অতিক্রম করে নেয়। এটিই খেলার শেষ পর্ব।


আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!