বাংলা পঞ্জিকা মতে পৌষের শেষের দিন বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে যে উৎসব উদযাপন করা হয় তা “পৌষ সংক্রান্তি’ নামে পরিচিত । কোথাও কোথাও পৌষসংক্রান্তি শুধু ’সংক্রান্তি’ নামে পরিচিত । আর আদি ঢাকার মানুষ এ উৎসব কে বলে থাকেন ‘সাকরাইন উৎসব ’ । কারো কারো কাছে ঘুড়ি উৎসব নামেও পরিচিত ।
বিভিন্ন দেশে পৌষসংক্রান্তির এই উৎসব পালন করতে দেখা যায় । এ উৎসব বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত । যেমন ভারতে বলা হয় মকরসংক্রান্তি , মায়নমারে ‘থিং ইয়ান , লাওসে পি মা লাও, নেপালে মাঘি, কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান এবং থাইল্যান্ডে সংক্রান ।
পৌষ সংক্রান্তি :
পৌষ সংক্রান্তি মুলত একটি ফসলী উৎসব । এই উৎসব মুলত ক্ষেতের পাকা ধান ঘরে তোলা উপলক্ষে কৃষক পরিবার উৎসব পালন করতেন । উৎসবের অংশ হিসাবে কয়েকটি পাকা ধানের শীষ বিনুনী করে ধানের গোলা, ঢেঁকি কিংবা ঘরের চালে গুঁজে রাখতেন । কারন বছরের প্রথম ফসল কে অতিপবিত্র এবং সৌভাগ্যদায়ক মনে করা হয় । পাকা ধানের শীষ বিনুনী করাকে বলা হয় ‘আউনি-বাউনি’ ( বানানান্তরে আওনি বাওনি )
শোনা যায় উৎসবের অংশ হিসাবে ঘরের জামাইদের দাওয়াত করে আনা হত । এবং তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হত ঘুড়ি আর নাটাই । আর বাড়ির বাচ্চাদের হাতে থাকত বাশের লগি । যার সাইজ তাদের থেকেও তিন-চার গুন লম্বা । এবার বিভিন্ন বাড়ির জামাইদের মধ্যে শুরু হত ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতা । আর কারো ঘুড়ি কাটা হলে . . .. চারদিকে “ভো কাট্টা , ভো কাট্টা “ কলরব । আর বাচ্চারা লগি নিয়ে ছুটে বেড়ায় কাটা ঘুড়ি ধরবার জন্য . . .
আর ঘরে ঘরে বাহারি সব পিঠার আয়োজন

সাকরাইন উৎসব ২০২১ । ১৪ জানুয়ারি রোজ বৃহস্পতি বার । বাংলা ৩০শে পৌষ ১৪২৭
সংক্রান্তি বা সাকরাইন :
পৌষ সংক্রান্তির এ্ই দিনকে ঢাকায় বলা হয় সাকরাইন । আদি ঢাকাই ভাষায় ‘হাকরাইন’ । সাকরাইন বা হাকরাইন একান্তই ঢাকাইয়াদের নিজন্ব উৎসব এবং দীর্ঘ সাংস্কৃতিক চর্চার ফল । এটা বাংলাদেশের কোথায়ও উৎযাপিত হয় না ।
সাকরাইন উৎসবের আরেকটি দিক হল বিশেষ ঘুড়ি উৎসব । এক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে সুতা মাঞ্জা দেয়ার ধুম। নানা রঙের ঘুড়ি পসরা সাজিয়ে বসে অলিতে গলি দোকানগুলো ।
সকরাইনের দিন ভোরবেলা থেকেই শুরু হয় ঘুড়ি উড়ানোর উম্মাদনা । ছোট বড় সবার হাতেই নাটাই । বেলা বাড়ার সাথে সাথে উৎসবের জৌলুস বাড়তে থাকে । শুরু হয় ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা।
প্রকৃতি আলো কমতে শুরু করলে ছাদে ছাদে বাড়তে থাকে লাল-নীল আলো । সাথে সাউন্ড সিস্টেম । শুরু হয় সে আরেক প্রতিযগিতা । কে কত উচ্চ বাজনায় অন্যকে পিছে ফেলতে পারে । কারো ৬ পিয়ার বক্স , কারো ১০ পিয়ার বক্স । সাথে চলতে থাকে লাইন ধরে ফানুস উড়ানো । আর সাথে যুক্ত হয়েছে আতশবাজী । মুখে কেরসিন-আগুন বের করার খেলা । গানের তালে তালে সবাই নাচ গান । এ যেন এক অনবদ্য আনন্দ উৎসব ।

সাকরাইন উৎসব ২০২১ | চিত্র : anirban kaisar সাকরাইন উৎসব ২০২১ | চিত্র : anirban kaisar সাকরাইন উৎসব ২০২১ | চিত্র : anirban kaisar সাকরাইন উৎসব ২০২১ | চিত্র : anirban kaisar
সাকরাইনে খাওয়া-দাওয়া :
সকাল থেকেই ঘরে ঘরে বাহারি সব রসালো পিঠার আয়োজন । সাথে মুড়ির মোয়া , বাখরখানি । পুরান ঢাকাইয়াদের উৎসব আর বিরিয়ানি থাকবে না! বিরিয়ানি তো থাকছেই সাথে খিচুড়ি ও গরুর মাংসও ।
সাকরাইন উৎসবে যে সব ঘুড়ি দেখা যায় :
চোখদার, মালাদার, ঘায়েল, দাবা প্রভৃতি নামে বিভিন্ন রকমের/ডিজাইনের ঘুড়ি পাওয়া উড়ানো হয় সাকরাইন উৎসবে ।
পুরান ঢাকার যে সব স্থানে ঘটা করে সাকরাইন উৎসব পালন করে :
পুরান ঢাকার নবাবপুর, লালবাগ, চকবাজার, সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, বংশাল, ওয়ারী ও পোস্তগোলা হাজারীবাগ, সদরঘাট, এলাকার মানুষ এখনো ঘটা করে সাকরাইন পালন করে। সাকরাইন উৎসব শুধু পুরান ঢাকাইয়াদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই । এখন ঢাকায় বসবাসকারী সকল মানুষের উৎসব হয়ে উঠেছে এই সাকরাইন উৎসব ।
পুরান ঢাকার এই ঐতিহ্য কে সবার কাছে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে বর্তমানে নেয়া হয় বিভিন্ন কর্মসুচি । ফেসবুকে খোলা হয় বিভিন্ন ইভেন্ট ।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যগুলো সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করার লক্ষ্যে সবার আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন।
সমৃদ্ধকরন :
- পৌষ সংক্রান্তি মুলত একটি ফসলী উৎসব
- ঢাকাই ভাষায় ‘হাকরাইন’ । সাকরাইন বা হাকরাইন একান্তই ঢাকাইয়াদের নিজন্ব উৎসব
- কারো কারো কাছে ঘুড়ি উৎসব নামে পরিচিত ।
- ঢাকাইয়াদের ভাষায় ঘুড়িকে বলে ঘুড্ডি বা গুড্ডি।
- বিভিন্ন দেশে পৌষসংক্রান্তির এই উৎসব পালন করতে দেখা যায় । ভারতে বলা হয় মকরসংক্রান্তি , মায়নমারে ‘থিং ইয়ান , লাওসে পি মা লাও, নেপালে মাঘি, কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান এবং থাইল্যান্ডে সংক্রান বলে থাকে ।
সূত্র : প্রথম আলো ,উইকিপিডিয়া এবং উৎসবের ঢাকা” গ্রন্থ থেকে