নোলক BY Selim Jahan
সহকর্মীটি একরাশ ছবি আমার টেবিলের ওপর মেলে ধরলেন। জাতিসংঘের খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক তিনি। কার্যোপলক্ষে ক’ সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ ঘুরে এসেছেন – তুলেছেন শ’য়ে শ’য়ে ছবি – মূলত: প্রতিকৃতি। ভারী সুন্দর ছবিগুলো – কিছু রঙীন, কিছু সাদাকালোয়। আমার দেশের কত মানুষের মুখ – মায়া লাগে, মমতায় আপ্লুত হই এই ভেবে আমার স্বজন এঁরা। আমার শেকড় এখানে – এখান থেকেই আমি এসেছি। আস্তে করে ছবিগুলোতে হাত বুলোই – যেন ছুঁচ্ছি আমার দেশকে, স্পর্শ করছি স্বজনদের।
ছবিগুলো দেখতে দেখতে একটা ছবিতে এসে চোখ আটকে যায় আমার। ১৮/১৯ বছরের এক গ্রাম্যবালার ছবি। একটু পাশ ফেরানো ভারী কমনীয় মুখটি। ডুরে শাড়ীর আঁচলে হাল্কা ঘোমটায় ঢাকা ঘনকৃষ্ণকেশ। কাজল কালো চোখ আর ঠোঁটের লাজুক হাসিটি তাকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে। আর সবচেয়ে যা আমার দৃষ্টি কেড়েছে তা হচ্ছে তার নোলকটি। আলো পড়ে চিকচিক করছে তার নাকের নোলকটি – দ্যুতি ছড়াচ্ছে যেন।
আমার ভাবান্তর দেখে একটু অবাক গলায় সহকর্মীটি জিজ্ঞেস করলেন, ‘চেনো একে’? উত্তর দিলাম ‘না’। না, চিনিনা এই মেয়েটিকে। কিন্তু দেখেছি আর জানতাম এর মত আরেকজনকে – হালিমা বুবু, আমার বড় চাচাতো বোন। একেবারে এক চেহারা, এক শাড়ী, এক ঘোমটা আর এক নোলকটি। এ কেমন করে হয়?
আমার বাবা আমাদের পরিবারে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন, সর্বোচ্চ সনদ পেয়েছেন। তারপর শিক্ষকতা শুরু করেছেন বরিশাল শহরে। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সব শহরেই -সর্ব অর্থেই আমরা শহরবাসী। কিন্তু চাচা-ফুপু, তার বাইরের বৃহত্তর পরিবারের সবাই থাকতেন আমাদের পিতৃপুরুষের নোয়াখালীর ভিটেতে।
ছুটি-ছাঁটাতে প্রায়ই চলে যেতাম গ্রামের বাড়ীতে। তারপর শীতের পিঠে, সবাই মিলে হৈ হল্লা, পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা, নদীতে সাঁতার, ক্ষেত থেকে জালি শসা চুরি – স্বাধীনতা আর আনন্দের সব নির্যাসটুকুই তো শুষে নিয়েছি। ভর দুপুরে কাকী বেরুতে দিতেন না। অসুবিধে নেই, বাসা থেকে নিয়ে আসা গল্পের বই পড়ো।
তখন সারা সকাল-দুপুরের অনেক কাজ সেরে হাল্কা পায়ে আসতেন হালিমা বুবু – মুখে সেই অভ্রান্ত লাজুক হাসি, ঘোমটায় হ্রস্বতা, নোলকের দুলুনি। টেবিল ধরে দাঁড়িয়ে আমার বই-পত্র ওল্টাতেন, নাড়া-চাড়া করতেন খাতা-পেন্সিল, জানতে চাইতেন স্কুলের গল্প। বাড়িয়ে-ঝাড়িয়ে, আনিয়ে-বানিয়ে কতশত গল্প বলতাম। কি যে তৃষিত চোখে শুনতেন আমার সে সব আবোল-তাবোল কথা। এখন বুঝতে পারি পড়ার বড় শখ ছিল বুবুর -কিন্তু গ্রামে সে সময়ে সম্ভব ছিল না। থাকতে পারতেন না বেশীক্ষন আমার কাছে, তখনই ভেসে আসত কাকীর গলা, ‘হালু, ধানগুন তুইলছছ নি, ঝড়ি আইয়ের’।
তারপর একদিন হালিমা বুবুর বিয়ে হোল। শ্বশুর বাড়ী দশ মাইল দূরের এক গ্রামে। আমাদের আনন্দ দেখে কে – বাড়ীর সবচেয়ে বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা। সেই প্রথম আমি গ্রামের বিয়ে দেখি। আত্মীয় স্বজনে ভরে গেছে বাড়ী, হৈ চৈ চারদিকে, আনন্দ যেন ফুরোতেই চায় না। বিয়ের দিন বুবুর কাছে ভেড়ার উপায় নেই। তারই একফাঁকে বুবু আমাকে ডেকে পাঠালেন যখন সবাই ‘বর এসেছে’, ‘বর এসেছ’ বলে হল্লা করে বাইরে চলে গেছেন।
ঘরে ঢুকে দেখি, বুবু একা – লাল শাড়ীতে, বিয়ের ওড়নায়, গয়নায় কি যে সুন্দর লাগছিল বুবুকে। ইশারায় কাছে ডাকলেন। ওঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। সাবান, তেলের একটা মৃদু সুবাস নাকে এসে লাগল। আমার থুতনিতে আদর করে মেহেদী রাঙা হাতটি ঠেকিয়ে বুবু বললেন, ‘তুঁই তো আঁরে দেইকতে যাইতি ন’? বুবুর কালো দু’চোখে জল টলটল করছে। ‘যাব, বুবু, নিশ্চয়ই যাব, দেখো তুমি’, বলতে বলতে আমার কিশোর দু’চোখে জল ছাপিয়ে এলো। বুবু আমাকে দু’হাতে কাছে টেনে নিলেন।
শুনতে পেয়েছিলাম, বুবু যখন শ্বশুর বাড়ীতে যাওয়ার জন্য পাল্কিতে ওঠেন, তখন খুব খুঁজেছিলেন আমাকে। না, আমাকে পাওয়া যায় নি আশেপাশে। আমি তখন বসে ছিলাম অনেক দূরে খালের পাড়ের শিমুল গাছটির নীচে একবুক অভিমান নিয়ে। কিসের অভিমান, কার প্রতি অভিমান – কে জানে?
পরের বছর শীতে বাড়ীতে গিয়ে দেখি সাজ সাজ রব পড়ে গেছে সারা বাড়ীতে। কাকী-ফুপুরা ঝুড়ির পর ঝুড়ি পিঠা বানাচ্ছেন। বুবুর শ্বশুর বাড়ীতে এই প্রথম পিঠা যাচ্ছে। সবাই সন্ত্রস্ত নিন্দে যাতে না হয়। আমার এক বড় চাচাতো ভাই আর মুনিষেরা ঝাঁকা ঝাঁকা পিঠে নিয়ে যাবে। ঘোষনা দিলাম আমিও যাব। সবাই হা হা করে উঠলেন – শহরের ছেলে, গ্রামের মেঠোপথে হাঁটতে পারবি না। আমি অনড়। কাকী বুঝলেন আমার মনের কথা।
পরের দিন অতি ভোরে যাত্রা শুরু। সূর্য্য তেজী হওয়ার আগেই যাতে সেখানে পৌঁছুনো যায়। পৃথিবীর কত জায়গায় কতবার হেঁটেছি – কিন্তু ঐ হাঁটার কোন তুলনা নেই, কোন বর্ণনা চলে না তার। আকাশ, বাতাস, মাঠ, নদী, মেঠো পথ, গাছের ছায়া, পাখীর কাকলি, পথ চলতি মানুষের উৎসুক দৃষ্টি কি না দিয়েছে আমাকে। মাঠ পেরুলাম, নদী পেরুলাম, গাছের ছায়ায় জিরুলাম – জয় গোস্বামীর ‘নন্দর মা’ কবিতার মতো।
তারপর এসে দাঁড়ালাম হালিমা বুবুর শ্বশুর বাড়ীর উঠোনে মধ্য গগনের সূর্য্যকে নিয়ে। সাড়া পেয়ে ঘর থেকে দৌঁড়ে বেরুলেন বুবু। বেরিয়ে আসলেন তাঁর শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা। বুবু থমকালেন এক মুহূর্ত – যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তারপর তাঁর নিজের ভাই, পিঠার ঝাঁকা, শ্বশুর বাড়ীর লোক সব যেন লুপ্ত হয়ে গেল তাঁর কাছে। ঘোমটা-টোমটা কোথায় গেল, দৌড়ে এসে ছোঁ মেরে নিলেন আমাকে, জড়িয়ে ধরলেন বুকে, তারপর হু হু করে কেঁদে উঠলেন। আমার চোখও শুকনো ছিল না।
ঘরে ঢুকে মাটিতে বসে কোল পেতে দিলেন, বললেন, ‘আয়’। ওটাই নিয়ম। বড় বোনের শ্বশুর বাড়ীতে গেলে ছোট ভাইকে কোলে নিতে হবে বোনকে – তা যত বড়ই হোক না কেন ভাই। আমার কেন জানি কোন লজ্জা লাগল না। সেই একঘর লোকের সামনে আমি বুবুর কোলে চড়ে বসলাম সেই ছোট বেলার মতো। বুবু আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন।
তারপর শুরু হল যত্ন- আত্তি আর আদরের পালা। কি খাওয়াবেন, কোথায় শোনাবেন, কি যে করবেন – তা ভেবেই বুবু অস্হির। কিছুতেই তার মন ভরে না। যত বলি সব ঠিক আছে, তাও বুবুর খুঁতখুঁতনি যায় না। কিন্ত টের পাই একটা চাপা গর্ব বুবুর ফর্সা মুখে ফেটে পড়ছে – শহুরে ভাই তাঁকে দেখতে এসেছে।
পরের দিন যখন চলে আসি, তখন বাড়ীর যে প্রান্তসীমা পর্যন্ত আসা যায়, বুবু এসেছিলেন। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘ তোঁর লগে আঁর আর দ্যাখা হইতো ন’। অশ্রু চাপতে চাপতে আমি বলেছিলাম, ‘কি যে বলো, আবার দেখতে আসবো তোমাকে’। তারপর হঠাৎ করে নাকের নোলকটি খুলে আমার হাতে দিয়ে চোখের জলের মাঝে সেই অভ্রান্ত লাজুক হাসিটি মিশিয়ে বুবু বললেন, ‘বিয়া কইরলে তোঁর বো’রে দিস’। আমার বয়স তখন পনের।
পরের বছর বাচ্চা হতে গিয়ে আমার বুবু মারা যান। বিয়ের পরে ঐ নোলকটি বেনুর হাতে দিয়ে যখন এ গল্পটি আমি ওকে বলেছিলাম, তখন ওর চোখ জলধারা নেমে এসেছিল। নাক ফোঁড়ানো হয়নি বলে নোলকটি ও কখনোই পড়তে পারেনি। কিন্ত ওটা যত্ন করে তুলে রেখেছিল সে, মাঝে মাঝে বের করে দেখত। চল্লিশ বছরে ও সেটা পরিস্কার করে নি – বলতো, ‘এটাতে বুবুর গায়ের গন্ধ লেগে আছে’।
যিনি এ নোলক দিয়েছিলেন, এবং যাকে এটা দেয়া হয়েছিল, দু’জনেই আজ প্রয়াত। আজ হালিমা বুবুও নেই, বেনুও নেই। নোলকটিও কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। বেনু চলে যাওয়ার পরে আর কোথাও খুঁজে পাই নি সেটা।