সুপ্রাচীন জমিদারি প্রথার স্বর্গরাজ্য, পোড়াবাড়ির মিষ্টান্ন চমচম, ঐতিহ্যবাহী শাড়ি শিল্প আর ভাওয়ালের লাল মেটে মাটির গড় অঞ্চলের জন্য বিখ্যাত দেশের সমৃদ্ধ এক জেলা ‘ টাঙ্গাইল ‘। প্রশাসনিকভাবে ১২ টি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত এ জেলা আয়তনে ঢাকা বিভাগের সবচেয়ে বড় জেলা। – প্রাথমিকভাবে এ তথ্যগুলো জানার পর, আর আমার বসবাসের জায়গা থেকে সখিপুর উপজেলা সন্নিকটে থাকায় মনস্থির করলাম, ২ দিনে কিভাবে বিশাল আয়তনের টাঙ্গাইল জেলার গুরুত্বপূর্ণ ও দর্শনীয় স্থানগুলোকে ভ্রমণ করা যায়। ভ্রমন পরিক্রমার ১৭ তম জেলা হিসেবে এখানকার অভিজ্ঞতাই শেয়ার করছি দুটো পর্বে। এবার, চমচমিয়া টাঙ্গাইল: ১ম পর্ব। এতে করে অল্প সময়ে অধিক স্থান দেখার কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে ট্রাভেলার দের।
বলে রাখা ভালো,আমি গাজীপুর থেকে শুরু করায় পরপর দুটো শুক্রবারেই খুব সকালে রওয়ানা দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই ফেরত আসা সম্ভব হয়েছিল। যারা পরপর দুদিনের জন্য ঢাকা বা অন্য কোনো জেলা থেকে আসবেন তারা অবশ্যই ব্যক্তিগত বাহন কিংবা বাস, ট্রেনে এলে টাঙ্গাইল শহর থেকেই যাত্রা শুরু করতে পারেন।
মহেড়া জমিদার বাড়ি
Mohera Jamider Bari
জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রচন্ড দাবদাহ উপেক্ষা করেই মেহেদী আর আমি মির্জাপুর উপজেলার নটিয়াপাড়া বা ডুবাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে ইজিবাইক যোগে ৩ কিলোমিটার দূরে বিখ্যাত ‘মহেড়া জমিদার বাড়ি’, যা বর্তমানে মহেড়া পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে সারা বাংলায় পরিচিত সেখানে প্রবেশ করলাম। সকাল ১০ টার দিকে দর্শনার্থীদের প্রবেশ শুরু হয়, ১০০ টাকা জনপ্রতি টিকেট করে প্রশিক্ষণরত যুবকদের মহড়া দেখতে দেখতেই মূল রাজবাড়িতে প্রবেশ করি। মহেড়া জমিদার বাড়ির মতো সুন্দর ও যত্নে সংরক্ষিত জমিদার বাড়ি বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন৷ টাঙ্গাইলের বিখ্যাত তিনটি জমিদারির মধ্যে এই জমিদারি ছিল অন্যতম প্রধান একটি। স্পেনের করাডোভা ও বাইনজেনটাইন নগরীর আদলে তৈরি ‘আনন্দ লজ‘, ‘কালীচরণ লজ‘ আর ‘মহারাজ লজ‘ আর ‘চৌধুরী লজ‘ নামের চারটি প্রধান বাড়ি এখানকার অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তাছাড়া রানীর পুকুর, প্রবেশ তোরণে সিংহের দরজা আর বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর আবির্ভাবকালের ইতিহাস ও মহেড়া অঞ্চলের জমিদারির সব ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংগ্রহশালা নিয়ে গঠিত জাদুঘরও এখানকার দর্শনীয় স্থানের শোভা নিচ্ছে।
১৯৭২ সালে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল থেকে ১৯৯০ সালে ট্রেনিং সেন্টার উন্নীত হওয়ার পর থেকেই নিয়মিত পরিচর্যা, পর্যবেক্ষণ ও সংরক্ষণে থাকায় মহেড়া জমিদার বাড়িটি দেশের সবচেয়ে অভিজাত জমিদার বাড়ি হওয়ার দাবি রাখে। প্রশাসনের শর্ত ও পরিশোধ সাপেক্ষে এখানে রাত্রিযাপনের সুবিধাও আছে। আমরা আর তা করিনি। মোটামুটি ঘন্টা দুয়েক অবস্থান করার পর আমরা বের হয়ে যাত্রা অভিমুখ করি নাগরপুর উপজেলাধীন ‘পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি’র উদ্দেশ্যে।
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি
Pakutia Zamindar Bari
ডুবাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে পাকুল্লা বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে সিএনজিযোগে লাউহাটি বাজার, আর সেখান থেকে আবার সিএনজি যোগে পাকুটিয়া বাজারেই পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি৷ বাড়ি দেখেই আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! সে কি! অসাধারণ ভাবগাম্ভীর্য পূর্ন স্থাপত্যশিল্প ও নান্দনিক নকশাদারিত্ব বহন করা পরপর তিনটি বাড়ি, একটি নাট মন্দির প্রশাসনের নজরদারিতা আর হস্তক্ষেপের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। কারো কাছে কোনো ইতিহাস না জানতে পেরে গুগল ঘেঁটে দেখলাম ১৯১৫ সালে তৎকালীন ওই এলাকার একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল বিদেশী ব্যবসায়ীদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার সুবাদে একই ডিজাইনে তিনটি প্যালেস নির্মান করেন। অট্টালিকা গুলো পাশ্চাত্য শিল্প সংস্কৃতির অনন্য সৃষ্টি। চমকপ্রদ লতাপাতা ও ফুলের নকশা আর পূজা মন্ডপের শিল্পিত কাজ এক শতাব্দী পরেও পর্যটকদের মুগ্ধ করে। কলকাতার ভিক্টোরিয়া প্যালেস, ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ আর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির নান্দনিক সৌন্দর্যের মিশেলে ভবনগুলো নির্মিত।
সবচেয়ে বড় মহলে বর্তমান পাকুটিয়া বিসিআরজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। দ্বিতল বিশিষ্ট ভবনের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। তবে সংস্কারের অভাবে ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। অপূর্ব লতাপাতার কারুকার্যখচিত বিশাল আরেকটি ভবন, যার মাথায় ময়ূরের মূর্তি রয়েছে, এ ছাড়া কিছু নারী মূর্তির দেখা মিলে। লতাপতায় আছন্ন ভবনটির একাংশ বর্তমানে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আরেক অংশে একটি বেসরকারি দাতব্য সেবা সংস্থা পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি বাড়ীর মাঝ বরাবর মুকুট হিসাবে লতা ও ফুলের অলংকরণে কারুকার্য মন্ডিত পূর্ণাঙ্গ দুই সুন্দরী নারী মূর্তি রয়েছে। এবং প্রতিটি মহলের রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য।
এই তিন মহলার জমিদাররা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রজানন্দিত। তাঁদের নিজেদের প্যালেস তৈরীর পর ১৯১৬ খ্রিঃ তাঁরা তাঁদের পিতা বৃন্দাবন এবং কাকা রাধা গোবিন্দের যৌথ নামে বৃন্দবন চন্দ্র রাধা গোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় (বিসিআরজি) প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৃতি ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্টাতা উপচার্য এবং সাবেক মন্ত্রী ডঃ এ,আর মল্লিক, সাবেক প্রধান মন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং ভবা পাগলার মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ । দেশ বিভাগের পরে তৎকালীন সরকার কর্তৃক পুরো সম্পদ অধিগ্রহণের পর জমিদারদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের নিদর্শন স্বরূপ ১৯৬৭ সালে এই সম্পদের উপর গড়ে তোলা হয় বিসিআরজি ডিগ্রী কলেজ।
বলা বাহুল্য,কালের বিবর্তনে বর্তমানে জমিদারদের জমিদারি না থাকলেও এখনো তাদের তৈরি জমিদার বাড়ি গুলো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে বছরের পর বছর। জমিদার বাড়িটি সংস্কার বা জমিদারদের ইতিহাস সংরক্ষণ না হওয়াতে একদিকে যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে বাড়িটি অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে এর ইতিহাস। আমার ক্লিকের কিছু ছবি দেখলেই সে ধারণাটা পাওয়া যাবে।

পুরো অ্যালবাম দেখতে এখানে ক্লিক করুন
আরও পড়ুন :


এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আতিয়া জামে মসজিদ
Atiya Jame Masjid
জুম্মার নামাজ ও দুপুরের খাবার শেষ করে আমাদের প্রথম দিনের শেষ ও সবচেয়ে আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা ভ্রমন স্পট দেলদুয়ার উপজেলার ‘আতিয়া জামে মসজিদ’ এর দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। পাকুটিয়া থেকে বাসে চড়ে ১৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নাগরপুর উপজেলা সদরে যাই। সেখান থেকে নাগরপুর- টাঙ্গাইল রোড ধরে ছিলিমপুরের আটিয়া মাজার গেটে নেমে পড়ি। পড়ন্ত বিকেলে ক্লান্ত শরীর নিয়ে দুজনে মফস্বলের পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ১ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে পৌঁছুই এক সময়ে দেশের প্রচলিত দশ টাকা মূল্যমানের গায়ে মুদ্রিত, সবার পরিচিত ‘আতিয়া মসজিদ’র কাছে। আলহামদুলিল্লাহ, সৌভাগ্য হয়েছিল মসজিদটিতে আসরের নামাজ আদায় করার। পরক্ষণেই পুরো মসজিদ ঘুরে ফিরে দেখার পালা। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম এজন্যই, আশপাশটা বেশ নিরিবিলি। তরুবীথিকায় ছাওয়া চারপাশ। হাজারো পাখির কলরবে মুখরিত পরিবেশ। ৪১৪ বছরের জৌলুস মসজিদটির। মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এর পুরো দালান।
সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন।
মসজিদটি থেকে একটি আরবি ও একটি ফারসি শিলালিপি পাওয়া যায়। এই লিপিগুলো থেকে মসজিদের নির্মাতার সময়কাল জানা যায়। সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদের পরিকল্পনা ও নির্মাণকাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। মসজিদটি নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবি সংস্কার করেন।
মসজিদটির আকার দৈর্ঘ্য ১৮.২৯ মিটার , প্রস্থ ১২.১৯ মিটার, দেয়ালের পুরুত্ব ২.২৩ মিটার। মসজিদের চারকোনা অষ্টকোনাকৃতি মিনার রয়েছে। মসজিদটি টেরাকোটার তৈরি। আতিয়া মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দিকের বাইরের দেয়ালে টেরাকোটার ওপর চমৎকার বৃত্তের মাঝে ফুলের নকশা করা, যা মোগল আমলের নিদর্শন। সুলতানি আমলের নিদর্শন হচ্ছে মিহরাব, কিবলা দক্ষিণ এশীয়দের জন্য পশ্চিমে। আর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মসজিদের খিলানসমূহ। আতিয়া মসজিদের খিলানগুলো চতুর্কেন্দ্রিক। আর মসজিদটি টেরাকোটার ইটের তৈরি। বিদায়ি সুলতানি আর নবাগত মোগল উভয় রীতির সংমিশ্রণে অপূর্ব এক মুসলিম স্থাপত্য, যা দৃষ্টিনন্দন এবং এ অঞ্চলে বিরল।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদগুলো ইটের তৈরি। কারণ আমাদের এই দেশে পাথর সহজলভ্য না। পাথর দিয়ে তৈরি করতে চাইলে অন্য দেশ থেকে পাথর আমদানি করে আনতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ। আদিতে মসজিদের ছোট তিন গম্বুজগুলো পলকাটা বা ঢেউ তোলা ছিল। প্রধান গম্বুজটি ধসে পড়েছিল সে জন্য পলকাটা বা ঢেউ তোলা বৈশিষ্ট্যটি বর্তমানে বিলুপ্ত।
মানুষের হাতের কারুকাজ কতটা নিখুঁত আর সুন্দর হতে পারে, এই মসজিদটিই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অসংখ্য নকশাখচিত মসজিদটির গায়ে খোদাই করা হয়েছে আরবি হরফ।
১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে প্রথম আতিয়া মসজিদটি স্থান পায়। এরপর ১৯৮২ সালে পরিবর্তিত ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদেও স্থান পায় আতিয়া মসজিদ। এতে দেশবাসীর মাঝে সহজেই মসজিদটি পরিচিতি লাভ করে।
দেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন থাকায় ২০০১ সালের পর থেকে মসজিদটিতে কোনো চুনকাম করা হয়নি। বিভিন্ন অংশে শ্যাওলা জমে কালো হয়ে গেছে। দেয়ালের কিছু ইট-বালিও খসে পড়ছে। মসজিদটির প্রধান গম্বুজের একটি অংশ ভেঙে পড়ায় বৃষ্টি হলে মসজিদে পানি পড়ে। বিশেষত বর্ষাকালে মুসল্লিদের নামাজ আদায়ে দুর্ভোগে পড়তে হয়। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের এর রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি আরো দায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ।
বেলাশেষে আমাদের ঘরে ফেরার পালা। গোধূলীবেলায় সারাদিনের উষ্ণ গরমে টাঙ্গাইলে ঘুরতে কিছুটা কষ্ট হলেও, স্বকীয় সৌন্দর্য ও চোখ ধাঁধানো নির্মানের এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখার যে তৃপ্তি পেলাম, তার কাছে এই ত্যাগ স্বীকার নিতান্তই যৎসামান্য। হালকা নাশতা সেরে দু ভাই যার যার গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার জন্য পথ বেছে নিলাম।
আর আপনার যারা দুদিনের জন্য আসছেন, তারা টাঙ্গাইল শহরে উচ্চ বা মধ্যম মানের আবাসিক হোটেল বা রিসোর্টগুলোতে বিশ্রাম নিন। আতিয়া মসজিদ থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইল শহর; আগামী দিন কোথায় কোথায় যাবেন, সেটা পরের পর্বে জানতে পারবেন।
(চলবে…)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
