নৌকা বাইচ Nouka Baich traditional festive in bangaldesh x bfa x fxyz web

নদীর ঢেউয়ে ভাসা ঐতিহ্য: নৌকা বাইচের গল্প

নৌকা বাইচের গল্প, নৌকার কাঠে দোষ থাকলে নৌকা ‘দেওয়ালা’ হয়ে যায়। নৌকা হারিয়ে যায় আবার ফিরে আসে। নৌকার তক্তা পরীক্ষা করার জন্য প্রতিটি তক্তার সামনে কুপি ধরা হয়।

‘হাতে লাগে ব্যথা রে,
হাত ছাইড়া দেও
সোনার দেওরা রে’

নৌকা বাইচ বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদীমাতৃক এই দেশের নদ-নদী মানুষের জীবন, জীবিকা ও উৎসবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নৌকা বাইচ সেই সম্পর্কেরই এক চমৎকার প্রতিফলন, যা প্রতিযোগিতা, আনন্দ, এবং ঐক্যের এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে।

নৌকা বাইচের সময় মাঝিদের বৈঠার তাল ঠিক রাখতে এক ধরনের গান গাওয়া হয়, যা ‘সারি গান’ নামে পরিচিত। এই সারি গান নৌকা বাইচের প্রাণ। সারিগানের মধ্য দিয়ে মাঝিরা বৈঠা টানার তালে তালে একসঙ্গে গান গায়, এবং ‘হেইয়ো হেইয়ো’ আওয়াজ তুলে মনোবল বৃদ্ধি করে।

সারি গান একধরনের লোকসংগীত, যা শ্রম বা কর্মসংগীত নামেও পরিচিত। বিশেষত, নৌকার মাঝিদের গান হিসেবেই এর পরিচয় সবচেয়ে বেশি। মাঝিরা সারিবদ্ধভাবে বসে বৈঠা টানার সময় এই গান গায় বলেই এর নাম হয়েছে সারি গান। যেমন জারি গানে একজন বয়াতি ও দোহার থাকে, তেমনই সারি গানেও একজন বয়াতি এবং দোহার থাকে, তবে এখানে দোহার হলো সকল মাঝি ও মাল্লারা। তারা তাল মিলিয়ে একসঙ্গে গায়, যাতে নৌকার গতি ও তাল ঠিক থাকে।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের উড়ন্ত বলাকা নৌকা মাঝি ফজলু মিয়ার লেখা একটি সারি গান, “হাতে লাগে ব্যথা রে, হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরা রে,” কোক স্টুডিও বাংলার বদৌলতে এখন ভাইরাল। এই গানের দৃশ্যে লাল শাড়ি, রেশমি চুড়ি, ঝুমকা পরা ভাবীদের দেখা যায় দেওরদের (বাইচালদের) উৎসাহ দিতে আসতে। পিঁড়েতে বসিয়ে চিড়ে খাওয়ানোর দাওয়াত দেয়, আর তাতেই যেন মাঝিরা ফিরে পায় নতুন উদ্দীপনা। ক্লান্ত হাত ছেড়ে সর্বশক্তি দিয়ে বৈঠা টানতে থাকে তারা, যেন তাদের নৌকাই জিতবে।

নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতায় কেউ না কেউ বিজয়ী হলেও আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি আমাদের ঐতিহ্য। সময়ের সাথে সাথে নৌকা বাইচের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিযোগিতা এবং সারি গানের মতো লোকসংগীত বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। এটি আমাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির অমূল্য অংশ, যা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার।

নৌকা বাইচের ছবি

‘বাইচ’ শব্দটি ফারসি, যার অর্থ বাজি বা খেলা। নৌকা বাইচের মূল উদ্দেশ্য হলো নৌকার দাঁড় টানার কৌশল এবং নৌকা চালনার দক্ষতার মাধ্যমে জয়লাভ করা। বর্ষাকাল বা বন্যার সময়, যখন নদীগুলো পানিতে পূর্ণ থাকে, তখন এই প্রতিযোগিতাগুলো অনুষ্ঠিত হয়।

নৌকা বাইচ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এবং এটি লোকজ উৎসবের অংশ হিসেবে উদযাপিত হয়। প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত নৌকাগুলো বিভিন্ন আকারের হতে পারে—কিছু নৌকায় ৭, ২৫, ৫০ এমনকি ১০০ মাঝি বা বৈঠাচালকও থাকতে পারে।

গ্রামবাংলার স্থানীয় মেলা, উৎসব, বা বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে নৌকা বাইচের আয়োজন একটি সাধারণ চিত্র। এটি শুধু প্রতিযোগিতা নয়, বরং এলাকাবাসীর মধ্যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের এক উজ্জ্বল প্রকাশ। প্রতিযোগিতাটি সাধারণত নদীর ওপর নির্দিষ্ট দূরত্বের রেস ট্র্যাকে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রতিযোগীরা তাদের নৌকাকে যত দ্রুত সম্ভব গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

নৌকা বাইচে বিভিন্ন দল অংশগ্রহণ করে, এবং প্রতিটি দল তাদের নিজস্ব রঙ ও পতাকা নিয়ে নৌকায় প্রতিযোগিতায় নামে। মাঝিরা গানের তালে তাল মিলিয়ে বৈঠা টানে, যা দলকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। এই সঙ্গীত এবং স্লোগান প্রতিযোগিতার উদ্দীপনা বাড়িয়ে দেয়, এবং পুরো প্রতিযোগিতাকে এক অনন্য সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতায় পরিণত করে।

নৌকা
নির্মান
নিয়ে
লৌকবিশ্বাস

যারা নৌকা বানায় তাদের বলা হয় ‘ছুতার’ আঞ্চলিক ভাষায় ‘হুতার’। নৌকা নির্মান নিয়ে আছে বিভিন্ন লৌকবিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠান। যারা হিন্দু ছুতার তারা নির্মানের পূর্বে ‘বিশ্বকর্মা’র নামে ভক্তি ও পুজা দেন। বিশ্বকর্মা হচ্ছেন দেবশিল্পী। হিন্দুদের বিশ্বাস তাঁর কৃপাতে জন্ম নেয় মানুষের মনে শিল্পকলার জ্ঞান। আর মুসলমানরা গাজী-কালুর নামে সিন্নি বিতরণ করে। মানুষের মাঝে বিশ্বাস হচ্ছে গাজী-কালুর নাম নিয়ে নৌকা চালালে নদীতে কোন বিপদ আসার সম্ভাবনা কম।

মানুষদের মাঝে বিশ্বাস আছে যে নৌকার কাঠে দোষ থাকলে নৌকা ‘দেওয়ালা’ হয়ে যায়। নৌকা হারিয়ে যায় আবার ফিরে আসে। তাই নৌকা বানানোর পূর্বে কাঠের তক্তা পরীক্ষা করা হয়। নৌকার তক্তা পরীক্ষা করার জন্য প্রতিটি তক্তার সামনে কুপি ধরা হয়। যদি কোন তক্তার সামনে কুপি নিভে যায় তাহলে সেই তক্তায় দোষ আছে। তখন সেই তক্তা আর ব্যবহার করা হয় না।

তথ্যসূত্র: মোহাম্মদ আলামিন, সভাপতি, লোকসংস্কৃতি রক্ষা করি (লোরক) সোসাইটি

সোনাইজানী নদী ও
নৌকা বাইচের
জনশ্রুতি
.

জনশ্রুতি অনুসারে, নৌকা বাইচের উৎপত্তি কিশোরগঞ্জের সোনাইজানী নদীতে। বলা হয়, এই নদীর তীরে অবস্থিত শ্রী চৈতন্যদেবের আখড়ায় মনসা দেবী মনুষ্য রূপে এসেছিলেন। সেদিন ঘাটের উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দুইজন জেলে মনসা দেবীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেন। কিন্তু কার প্রস্তাবে সাড়া দেবেন তা নির্ধারণ করতে মনসা দেবী বলেন, তাদের নৌকা নিয়ে লাল গোসাইয়ের আখড়া থেকে চৈতন্যদেবের আখড়ায় আসতে হবে।

জেলেরা মনসা দেবীর কথা মেনে একসাথে নৌকা বেয়ে ঘাটে ফিরে আসেন। কিন্তু অবশেষে মনসা দেবী কারো প্রেমে সাড়া না দিয়ে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাদের প্রেমের স্মৃতি অমর রাখতে প্রতি বছর সোনাইজানী নদীতে নৌকা বাইচ আয়োজনের নির্দেশ দেন। সেই থেকে এই নদীতে নৌকা বাইচের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে।

নৌকা বাইচের এই ঐতিহ্য পুনর্জীবিত করতে স্যাটেলাইট টেলিভিশন ‘বাংলাভিশন’ কিশোরগঞ্জের সোনাইজানী নদীতে একবার নৌকা বাইচের আয়োজন করে। তবে বাংলাদেশে নৌকা বাইচের ইতিহাস স্মরণাতীতকাল থেকে চলে আসছে। বিশেষত বর্ষাকালে, যখন নদীগুলি পানিতে পূর্ণ থাকে, তখন নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়।

প্রাচীনকালে মুসলিম শাসকদের আমলে নবাব ও বাদশাহরা নৌকা বাইচের আয়োজন করতেন। বাংলার বারো ভুঁইয়ারা মুঘলদের বিরুদ্ধে তাদের নৌবাহিনী ব্যবহার করতেন, এবং মগ ও হার্মাদ জলদস্যুদের মোকাবেলায়ও নৌবাহিনীর নৌকা ব্যবহৃত হতো। সেই সময়ের রণবহরে ব্যবহৃত ছিপ নৌকার ঐতিহ্য আজও নৌকা বাইচের নৌকাগুলিতে প্রতিফলিত হয়। যদিও বর্তমানে এই ধরনের নৌবাহিনীর কার্যক্রম সেভাবে আর দেখা যায় না, তবুও নৌকা বাইচের মাধ্যমে সেই পুরোনো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আজও জীবন্ত রয়েছে।

নৌকা
বাইচের
বর্ণনা

নৌকা বাইচে ব্যবহৃত নৌকাগুলোর মধ্যে সোরঙ্গী নৌকা বিশেষভাবে বিখ্যাত। এছাড়াও ছিপ নৌকাও নৌকা বাইচে ব্যবহৃত হয়। এসব নৌকা চিকন ও লম্বা হওয়ায় দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম। নৌকা নির্মাণের জন্য আদর্শ কাঠ হলো ‘জারই’। বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকার নকশা ও আকারে কিছু ভিন্নতা দেখা যায়, তবে প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত নৌকাগুলো সাধারণত সরু ও লম্বা হয়ে থাকে।

নৌকার সামনের অংশ, যাকে গুলুই বলা হয়, অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়। দর্শকদের মুগ্ধ করতে এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া নৌকাগুলিকে বিশেষভাবে আলাদা করে তুলতে গুলুইকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে নামকরণ করা হয়। যেমন: ঝড়ের পাখি, পঙ্খিরাজ, ময়ূরপঙ্খি, তুফান মেল, সোনার তরী ইত্যাদি।

নৌকা বাইচ মূলত নৌকার দাঁড় টানার প্রতিযোগিতা, যেখানে প্রতিযোগী দলগুলো নৌকা চালনার কৌশল এবং শারীরিক কসরতের মাধ্যমে নির্দিষ্ট দূরত্বের রেসে অংশ নেয়। জাতীয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় সাধারণত ৬৫০ মিটার দূরত্বের রেস অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি নৌকায় মাঝির সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে—৭, ২৫, ৫০ কিংবা ১০০ মাঝি বা বৈঠাচালক থাকতে পারে।

প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া মাঝিরা একসঙ্গে তাল মিলিয়ে বৈঠা চালান, আর তালে তালে ঢোল ও করতাল বাজিয়ে বাদকরা তাদের উৎসাহিত করেন। এভাবে নৌকা বাইচ শুধু একটি প্রতিযোগিতাই নয়, বরং এটি এক অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে।

আয়োজক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়

বাংলাদেশে নৌকা বাইচের সংগঠন ও উন্নয়নের জন্য ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ রোয়িং ফেডারেশন গঠিত হয়। এই ফেডারেশন নৌকা বাইচ ও রোয়িং প্রতিযোগিতার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। এছাড়াও, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতাও আয়োজিত হয়, যা দেশের এই ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার একটি বড় পদক্ষেপ ছিল।


সাংস্কৃতিক মূল্য ও গুরুত্ব

নৌকা বাইচ শুধুমাত্র একটি প্রতিযোগিতা নয়, এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত নিদর্শন। প্রতিযোগিতার সময় মাঝিরা আল্লাহ বা প্রকৃতির কাছে সাহস ও শক্তি কামনা করে গান গেয়ে থাকেন, যা গ্রামীণ জীবনের সাথে এই প্রতিযোগিতার গভীর সম্পর্ককে আরও স্পষ্ট করে তোলে। এদেশের লোকজনের আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের উৎসবমুখর পরিবেশে নৌকা বাইচ আজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।


আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা


Country boats in Bangladesh নৌকা x bfa x bipul hossain x fxyz +

নৌকা বাংলার ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার প্রতীক

নৌকা বাংলার ঐতিহ্যবাহী 
 জীবনধারার
 প্রতীক। জসীমউদ্দীনের “সোজন বাদিয়ার ঘাট” এই বিষয়কে চমৎকারভাবে প্রতিফলিত করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!