ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে
গা-রে মাঝি গা কোন গান
একদিন তোর নাও মাঝি ভাসবে না রে
নীল নদীর জলে, ও মাঝি রে
সেইদিন তোর গান মাঝি শুনবে না কেউ
গাইবে না বলে, ও মাঝি রে
যন্ত্রের নাও ধোঁয়া ছাইড়া করবে আঁধার
নীল আকাশটারে, ও মাঝি রে
সেইদিন তোর নাও মাঝি শূণ্য হয়ে
থাকবে রে পারে”
.
‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে’ বিশিষ্ট গীতিকার এস এম হেদায়েত এই গানের মধ্য দিয়ে নদী ও নৌকা একটি প্রতীকী ও বাস্তবিক উপাদানকে চমৎকারভাবে প্রতিফলিত করেছে। চিরায়ত বাংলায় নৌকা বাংলার গ্রামীণ জনপদের প্রতীক, যা কেবল নদী পারাপারের বাহন নয়, বরং এক জীবনচক্রের ধারক। যুগ যুগ ধরে, নৌকা শিল্পের সঙ্গে আবহমান বাংলার নদীমাতৃক সভ্যতা জড়িয়ে আছে। রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার মাশালিয়া বাজারে কাঠমিস্ত্রীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বংশ পরম্পরায় নৌকা তৈরি হয়, আর সেই নৌকাগুলোই যেন এক একখানি জীবন্ত গান বা কবিতা।
বাংলা সাহিত্যে নদী ও নৌকা একটি প্রতীকী ও বাস্তবিক উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নদী, নৌকা, এবং গ্রাম বাংলার জীবনবোধকে উপজীব্য করে বহু কবি অসাধারণ কাব্য সৃষ্টি করেছেন। জসীমউদ্দীনের “সোজন বাদিয়ার ঘাট” এই বিষয়কে চমৎকারভাবে প্রতিফলিত করে।
যখন জসীম উদ্দীন তাঁর কবিতায় নদী, নৌকা আর খেয়াঘাটের কথা বলেন, তখন তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—কাঠের তৈরি নৌকা যেন এক শিল্পের মূর্ত প্রতীক। নৌকা তৈরির কারিগরেরা শুধু নৌকা বানান না, তারা একটি সংস্কৃতি নির্মাণ করেন, যেখানে প্রতিটি দাঁড়, প্রতিটি খোদাইয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে গ্রামীণ জীবনের এক একটি গল্প। নদী, যা একদিকে যেমন জীবনধারা, অন্যদিকে তেমনই বিভাজন সৃষ্টি করে। নৌকা সেই বিভাজন পেরিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের, গাঁয়ের সঙ্গে গাঁয়ের সংযোগ ঘটায়।
নৌকার সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের আত্মিক সম্পর্ক তাই কেবলই বাহ্যিক নয়, তা রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে তাদের সত্তায়। প্রতিটি নৌকা যেন একটি ছোট্ট পৃথিবী, যা নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে চলতে থাকে। আর সেই লড়াইয়ে নৌকা শিল্পীরা যুক্ত হন তাঁদের মেধা ও শ্রম দিয়ে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা কাঠের তৈরি নৌকাকে করে তোলেন জীবন্ত শিল্পকর্ম।
এই নৌকা কেবল জলের পথে যাত্রা নয়, এটি এক শিল্পভিত্তিক জীবনের ধারক, যা বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নৌকা
তৈরির
ইতিহাস:
বাংলাদেশের নৌকা তৈরির ইতিহাস বহু প্রাচীন। প্রাচীন বাংলা অঞ্চলের নদী-প্রধান ভূগোলের কারণে নৌকা ছিল অন্যতম প্রধান পরিবহন মাধ্যম। নদী, খাল, এবং হাওড়-বাওড়ে চলাচলের জন্য নৌকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। বিভিন্ন ধরনের নৌকা তৈরি হতো, যেমন: পালতোলা নৌকা, ডিঙি নৌকা পানসি নৌকা।
প্রাচীন বাংলায় নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নৌকা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। সেই সময়ে নৌকায় করে পণ্য আদান-প্রদান হতো, এবং দেশ-বিদেশের বাণিজ্য চালানো হতো। প্রাচীন যুগ থেকে নৌকা তৈরি করা ছিল একটি বিশেষ দক্ষতা, এবং এটি ধীরে ধীরে একটি শিল্পে পরিণত হয়।
নৌকা শিল্পে রূপান্তর
নৌকা নির্মাণ প্রক্রিয়ার সূচনা মূলত কাঠ দিয়ে, বিশেষ করে সেগুন, গর্জন, এবং কড়ই গাছের কাঠ ব্যবহার করে। নৌকা তৈরির কৌশলগুলোর উন্নতি হতে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, এবং এই প্রক্রিয়াটি বংশ পরম্পরায় টিকে যায়। কুমার, রাজমিস্ত্রি, এবং কামারের মতো, নৌকা নির্মাণও গ্রামীণ জীবনের একটি পেশাগত শিল্পে পরিণত হয়।
মুসলিম শাসনামলে এবং মুঘল আমলে
বাংলার নদীগুলোতে নৌকার ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নৌকায় করে রাজস্ব আদায় করা হতো এবং প্রভূত পরিমাণ সামরিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এই সময়কালে বাংলার নৌকা শিল্প তার সেরা সময় কাটায়। নৌকা তখন শুধু পরিবহন নয়, বিশেষ নকশা এবং কারুকার্যের মাধ্যমে অলঙ্কৃত করে বানানো হতো, যা এটি শিল্পের মর্যাদা দিয়েছিল। যেমন বজরা নৌকা, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে একটি অনন্য স্থান দখল করে আছে। এটি বাংলার অভিজাত এবং জমিদার শ্রেণির লোকদের দ্বারা বিলাসবহুল ভ্রমণের জন্য ব্যবহৃত হতো।
নৌকা
নির্মান
নিয়ে
লৌকবিশ্বাস
যারা নৌকা বানায় তাদের বলা হয় ‘ছুতার’ আঞ্চলিক ভাষায় ‘হুতার’। নৌকা নির্মান নিয়ে আছে বিভিন্ন লৌকবিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠান। যারা হিন্দু ছুতার তারা নির্মানের পূর্বে ‘বিশ্বকর্মা’র নামে ভক্তি ও পুজা দেন। বিশ্বকর্মা হচ্ছেন দেবশিল্পী। হিন্দুদের বিশ্বাস তাঁর কৃপাতে জন্ম নেয় মানুষের মনে শিল্পকলার জ্ঞান। আর মুসলমানরা গাজী-কালুর নামে সিন্নি বিতরণ করে। মানুষের মাঝে বিশ্বাস হচ্ছে গাজী-কালুর নাম নিয়ে নৌকা চালালে নদীতে কোন বিপদ আসার সম্ভাবনা কম।
মানুষদের মাঝে বিশ্বাস আছে যে নৌকার কাঠে দোষ থাকলে নৌকা ‘দেওয়ালা’ হয়ে যায়। নৌকা হারিয়ে যায় আবার ফিরে আসে। তাই নৌকা বানানোর পূর্বে কাঠের তক্তা পরীক্ষা করা হয়। নৌকার তক্তা পরীক্ষা করার জন্য প্রতিটি তক্তার সামনে কুপি ধরা হয়। যদি কোন তক্তার সামনে কুপি নিভে যায় তাহলে সেই তক্তায় দোষ আছে। তখন সেই তক্তা আর ব্যবহার করা হয় না।
তথ্যসূত্র: মোহাম্মদ আলামিন, সভাপতি, লোকসংস্কৃতি রক্ষা করি (লোরক) সোসাইটি
বাংলাদেশে
প্রচলিত
বিভিন্ন ধরনের
নৌকার নাম
বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূগোলে নৌকা যুগ যুগ ধরে পরিবহন, মৎস্য শিকার, বাণিজ্য এবং যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিভিন্ন অঞ্চলের প্রয়োজন অনুযায়ী নৌকাগুলোর আকার-আকৃতি ও নকশা ভিন্ন হয়। বাংলাদেশে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী এবং আধুনিক নৌকা পাওয়া যায়। নিচে বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের নৌকার নাম এবং তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:
০১
ডিঙি নৌকা:
ডিঙি নৌকা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রচলিত ছোট নৌকা। এটি দৈনন্দিন জীবনে যাতায়াত, ছোটখাটো মালামাল পরিবহন এবং মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত হয়। সাধারণত এটি এক বা দুইজন ব্যক্তি ব্যবহার করেন।
০২
পানসি নৌকা
পানসি নৌকা বড় আকারের এবং এটি সাধারণত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পণ্য পরিবহন এবং নদীপথে যাত্রী বহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এর সামনের এবং পেছনের অংশ উঁচু এবং বাঁকানো থাকে। এটি সাধারণত পালতোলা নৌকা হিসেবে ব্যবহার হয়।
০৩
কোষা নৌকা
কোষা নৌকা অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের এবং সাধারণত নদী, খাল বা পুকুরে ব্যবহার করা হয়। এটি মূলত ব্যক্তিগত বা পরিবারের ব্যবহারের জন্য তৈরি হয় এবং সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কোষা নৌকা কুমার সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশি ব্যবহৃত হয়।
০৪
মাল্লা নৌকা
মাল্লা নৌকা বড় এবং শক্তিশালী কাঠামোর নৌকা যা মূলত জেলেদের মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি গভীর নদী বা সাগরে চলাচলের উপযোগী।
০৫
বাওয়ালি নৌকা
বাওয়ালি নৌকা সুন্দরবনের কাঠুরে এবং মধু সংগ্রহকারীদের (বাওয়ালি) প্রধান নৌকা। এটি সুন্দরবনের গভীর জলাশয়ে চলাচলের উপযোগী এবং শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি হয়।
০৬
কয়েকা নৌকা
এটি একটি অতি ছোট নৌকা, যা সাধারণত পুকুরে ব্যবহার করা হয়। কয়েকা নৌকা সাধারণত মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এটি এক বা দুইজনের জন্য উপযোগী।
০৭
সাম্পান নৌকা
সাম্পান নৌকা চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশি ব্যবহৃত হয়। এটি ছোট আকারের হলেও বেশ শক্ত এবং সাধারণত সাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন নদীতে এটি প্রচলিত।
০৮
গোয়াল নৌকা
গোয়াল নৌকা বড় আকারের নৌকা যা মূলত পশু বা গরু-ছাগল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি শক্ত কাঠামোযুক্ত এবং স্থিতিশীল নৌকা।
০৯
জালি নৌকা
জালি নৌকা ছোট আকারের এবং নদী বা বিলে মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি হালকা কাঠ দিয়ে তৈরি এবং নৌকাটির সামনের অংশ কিছুটা উঁচু থাকে।
১০
মাস্তুল নৌকা
মাস্তুল নৌকা বিশেষ ধরনের বড় নৌকা, যার সাথে একটি বা দুটি বড় মাস্তুল (পাল) থাকে। এটি বড় নদী বা সমুদ্রে চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়।
১১
চাঁন্দা নৌকা
চাঁন্দা নৌকা দেখতে চাঁদের মতো বাঁকানো। এটি পূর্ববঙ্গে জনপ্রিয় এবং স্থানীয় নদীপথে বাণিজ্যিকভাবে পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
১২
পালতোলা নৌকা
এটি পাল দিয়ে চালানো হয় এবং বাণিজ্যিক জাহাজ হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রাচীনকালে পালতোলা নৌকা নদী এবং সমুদ্রপথে দূরবর্তী স্থানে পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হতো।
বজরা
নৌকা
বজরা নৌকা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী নৌযান, যা একসময় বিশেষ করে জমিদার, অভিজাত ও ধনী পরিবারের সদস্যদের জন্য বিলাসবহুল যাতায়াতের মাধ্যম ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে একটি অনন্য স্থান দখল করে আছে। এটি সাধারণত বিশাল আকৃতির এবং সুন্দরভাবে সজ্জিত। বজরা নৌকায় বিভিন্ন কক্ষ, জানালা, এবং ছাদ থাকে, যা যাত্রীদের আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য উপযোগী করে। এই নৌকাগুলোকে অনেক সময় চলন্ত প্রমোদতরী হিসেবে দেখা হতো। সাধারণত, নদীতে ভ্রমণ করার সময় আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের জন্য বজরা নৌকা ব্যবহৃত হত। এই নৌকাগুলোর কাঠামো এবং নকশায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের নিদর্শন দেখা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্য ও চিন্তার সময় বজরা নৌকা ব্যবহার করতেন। বিশেষত তার জীবন ও রচনা সংক্রান্ত বহু স্মৃতিতে বজরা নৌকার উল্লেখ রয়েছে। কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে বা বাংলাদেশে নদীর তীরে জমিদার বাড়িতে অবস্থানকালে তিনি বজরা নৌকায় ভ্রমণ করেছেন। তার অনেক কবিতা এবং গানেও বজরা নৌকার ভ্রমণ বা নদীপথে যাত্রার অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। ১৯০৫ সালে নদীয়ার শিলাইদহে তার জমিদারী কাজ পরিচালনা করার সময় তিনি প্রায়শই এই নৌকায় ভ্রমণ করতেন।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদও তার সাহিত্যকর্মে এবং বাস্তব জীবনে বজরা নৌকার উল্লেখ করেছেন। তিনি নুহাশপল্লীর নিসর্গে বজরা নৌকায় নদী ভ্রমণ করে তার উপন্যাস ও নাটকের জন্য প্রেরণা পেতেন। তার বিভিন্ন উপন্যাস ও নাটকে বজরা নৌকার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, যেখানে চরিত্রগুলো নদী পথে ভ্রমণ করে এবং সেই সময়ে নানা রকম সম্পর্ক বা ঘটনার প্রকাশ ঘটে। হুমায়ূন আহমেদ বজরা নৌকায় ভ্রমণকে এক ধরনের মানসিক আরাম ও সৃজনশীল চিন্তার সময় হিসেবে দেখতেন।
নদীর ঢেউয়ে ভাসা ঐতিহ্য: নৌকা বাইচের গল্প
নৌকা বাইচের গল্প, নৌকার কাঠে দোষ থাকলে নৌকা ‘দেওয়ালা’ হয়ে যায়। নৌকা হারিয়ে যায় আবার ফিরে আসে। নৌকার তক্তা পরীক্ষা করার জন্য প্রতিটি তক্তার সামনে কুপি ধরা হয়।
অঞ্চলভেদে বা
বিশেষ উদ্দেশ্যে
ব্যবহৃত
নৌকার নাম
বাংলাদেশে প্রচলিত নৌকাগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান নৌকার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তবে এসব ছাড়াও আরও কিছু স্থানীয় ধরনের নৌকা রয়েছে, যেগুলো অঞ্চলভেদে বা বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। নিচে আরও কয়েকটি নৌকার নাম ও বিবরণ দেওয়া হলো:
১৩
পাটলা নৌকা
এটি খুব সরু এবং লম্বা ধরনের নৌকা। সাধারণত এটি গ্রামের ছোট নদী বা খাল-বিলে চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়। পাটলা নৌকা খুব হালকা ও সহজে চলার উপযোগী।
১৪
বলাহারি নৌকা
বলা হয় যে, এই নৌকা মূলত যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। বিশেষত, বড় নদী বা বিলে এর চলাচল সহজ। এটি শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি হয় এবং তুলনামূলকভাবে বড় আকারের।
১৫
ঢেউয়া নৌকা
এই নৌকাগুলো ঢেউ বা স্রোতের সঙ্গে সমন্বয় রেখে তৈরি করা হয়। বড় নদী বা সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকায় এটি ব্যবহৃত হয়। এর পিছনের অংশ উঁচু এবং ঢেউ মোকাবেলায় সহায়ক।
১৬
কুনে নৌকা
কুনে নৌকা সাধারণত মৎস্যজীবীদের ব্যবহৃত ছোট নৌকা। এটি হালকা কাঠ দিয়ে তৈরি হয় এবং খাল-বিলের মতো স্থানে মৎস্য শিকারে ব্যবহার করা হয়।
১৭
ঘাটাইল নৌকা
এই নৌকা স্থানীয়ভাবে একধরনের বিল অঞ্চলের জন্য উপযোগী নৌকা, যা স্থানীয় কৃষি ও মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হয়। এর বৈশিষ্ট্য হলো এটি স্থিতিশীল ও শক্ত কাঠামোর।
১৮
হরগিলা নৌকা
হরগিলা নৌকা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাওয়া যায় এবং এটি বিশেষত মৎস্য শিকারের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি বেশ সরু ও লম্বা ধরনের নৌকা।
১৯
সাহেবী নৌকা:
সাহেবী নৌকা সাধারণত উঁচু শ্রেণীর মানুষের বা জমিদারদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো। এটি দেখতে অনেকটা শৌখিন এবং অলঙ্কৃত। আগেকার দিনে বাংলার অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা এ ধরনের নৌকা ব্যবহার করতেন।
২০
ভাটিয়ালি নৌকা
নদীতে ভাটির সময় চলাচলের উপযোগী নৌকাগুলোকে ভাটিয়ালি নৌকা বলা হয়। বিশেষত ভাটিয়ালি গানের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এটি সাধারণত পাল তুলে চলাচল করে।
২১
সেরগাসি নৌকা
সেরগাসি নৌকা মূলত বৃহত্তর পটুয়াখালী ও বরিশাল অঞ্চলে পাওয়া যায়। এটি ছোট আকারের এবং নদী বা খালে দ্রুত গতিতে চলার জন্য উপযোগী। মৎস্যজীবীরা এই নৌকা ব্যবহার করেন।
২২
ময়ূরপঙ্খী নৌকা
ময়ূরপঙ্খী নৌকা দেখতে অনেকটা ময়ূরের মতো আকৃতির হয় এবং এটি বিশেষত উৎসব ও অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। এটি শৌখিন ও সাজানো নৌকা হিসেবে পরিচিত, যা মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ দিনে ব্যবহৃত হয়।
২৩
কাচারি নৌকা
কাচারি নৌকা মূলত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। এটি মাঝারি আকারের নৌকা, যা যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় নদী এবং হাওর অঞ্চলে এই নৌকা দেখা যায়।
২৪
পাটুরী নৌকা
মেঘনা নদী অঞ্চলের পাটুরী নৌকা বেশ জনপ্রিয়। এটি তুলনামূলকভাবে বড় আকারের এবং প্রধানত পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হয়। এর কাঠামো মজবুত এবং নদীর তীব্র স্রোত মোকাবেলা করার ক্ষমতা রাখে
২৫
গয়না নৌকা
গয়না নৌকা মূলত চাঁদপুর এবং আশেপাশের এলাকায় পাওয়া যায়। এটি দেখতে সুন্দর এবং চমৎকার কারুকাজে তৈরি, যার জন্য এটিকে গয়না নৌকা বলা হয়। এটি সাধারণত পারিবারিক এবং যাত্রী পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
২৬
বাওয়ালি নৌকা
সুন্দরবন এলাকায় বাওয়ালিরা এই নৌকা ব্যবহার করে। সুন্দরবনের মধু সংগ্রাহক এবং কাঠুরেরা এই নৌকা ব্যবহার করেন, যা সুন্দরবনের সংকীর্ণ খাল ও নদীতে চলাচলের উপযোগী।
২৭
কেল্লা নৌকা
কেল্লা নৌকা বৃহত্তর কিশোরগঞ্জ এবং ব্রহ্মপুত্র নদীতে দেখা যায়। এটি সাধারণত মাঝারি আকারের এবং মালামাল ও যাত্রী পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এর পেছনের দিকটি কিছুটা উঁচু এবং বাঁকানো থাকে।
২৮
জয়ন্তী নৌকা
এই নৌকা ছোট আকারের এবং মৎস্যশিকারের কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি স্থানীয় খাল-বিলে খুব সহজে চলতে পারে এবং হালকা কাঠ দিয়ে তৈরি হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জয়ন্তী নৌকা দেখা যায়।
২৯
পাইন্দা নৌকা
পাইন্দা নৌকা মূলত চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেখা যায়। এটি মূলত উপকূলবর্তী এলাকায় মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত হয়। শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি হওয়ায় এটি টেকসই এবং সমুদ্রের ঢেউ মোকাবেলায় সক্ষম।
৩০
জোলঙ্গা নৌকা
জোলঙ্গা নৌকা সাধারণত ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে দেখা যায়। এটি মাঝারি আকারের এবং সাধারণত মৎস্যজীবীরা মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করেন।
৩১
ধাও নৌকা
ধাও নৌকা বৃহত্তর নদীপথে চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি পালতোলা নৌকা, যা নদীর তীব্র স্রোতে দ্রুতগতিতে চলতে পারে। এটি বড় আকারের এবং পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হয়।
৩২
হাতিখানা নৌকা
এই নৌকা বৃহত্তর সুনামগঞ্জ অঞ্চলে পাওয়া যায়। এটি একটি বড় আকারের নৌকা, যা হাওর অঞ্চলে যাত্রী এবং মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। এর কাঠামো খুবই শক্তিশালী।
৩৩
ফিঙ্গি নৌকা
ফিঙ্গি নৌকা সাধারণত হাওর অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। এটি ছোট আকারের এবং খাল, বিল বা হাওরে চলার উপযোগী। মাছ ধরার জন্যও এটি ব্যবহৃত হয়।
রাজবাড়ী জেলার
বালিয়াকান্দির
নৌকা তৈরির ঐতিহ্য
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলায় বংশ পরম্পরায় নৌকা তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী পেশা হিসেবে পরিচিত। বিশেষত, বালিয়াকান্দির কিছু বিশেষ সম্প্রদায়, অনেক দিন ধরে নৌকা নির্মাণে দক্ষতা অর্জন করেছে এবং এই পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এখানকার কারিগররা সাধারণত ৯ থেকে ২০ হাত পর্যন্ত লম্বা নৌকা বানিয়ে থাকেন, যা স্থানীয় নদীপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
এখানকার কারিগররা সাধারণত কাঁঠাল, গর্জন, এবং অন্যান্য কাঠ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের নৌকা তৈরি করেন, যা স্থানীয় চাহিদা মেটায়। বালিয়াকান্দির নৌকা শিল্পী সম্প্রদায় প্রাচীনকাল থেকেই নৌকা তৈরি করে আসছে, এবং এই কাজের জন্য তারা সুনাম অর্জন করেছে। এই নৌকাগুলো শুধু রাজবাড়ী জেলার জন্য নয়, আশেপাশের জেলার মানুষও এগুলো ব্যবহার করে থাকেন। যদিও আধুনিকতার প্রভাবে এই শিল্প কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, তবে নৌকা নির্মাণের ঐতিহ্য এবং দক্ষতাকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও পুনর্জীবিত করার মাধ্যমে এটি আবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমান অবস্থা
বালিয়াকান্দিতে নৌকা তৈরির ঐতিহ্য এখনো কিছুটা টিকে আছে, তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্পের অবস্থা অনেকটাই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নৌকার ব্যবহার কমে গেছে, এবং তাই নৌকা নির্মাণের চাহিদাও কমে গেছে। এছাড়া মোটরচালিত নৌকা এবং অন্যান্য আধুনিক যানবাহনের প্রচলন হওয়ায় সাধারণ কাঠের নৌকার চাহিদা কমে গেছে। তারউপর নৌকা তৈরির জন্য কাঠ এবং অন্যান্য উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই শিল্পে লাভজনকতা কমেছে। তাই অনেক নৌকা নির্মাণকারী পরিবার এই পেশা ছেড়ে অন্য কাজে যুক্ত হচ্ছেন।
শিল্পের পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা
বালিয়াকান্দির নৌকা শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। সরকারি ভাবে নৌকা নির্মাতাদের আর্থিক সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা উচিত, যাতে তারা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নৌকা তৈরি করতে পারে। এছাড়া নেপাল, কাস্মির কিংবা থাইল্যান্ডের মত করে নৌকা পর্যটন শিল্পে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। ঐতিহ্যবাহী নৌকাগুলোকে পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা শিল্পের চাহিদা বাড়াতে পারে। এবং নৌকার ডিজাইন ও কার্যকারিতায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উন্নয়ন করা যেতে পারে, যা এটি বেশি টেকসই ও
নৌকার
বিভিন্ন
অংশ
নৌকা প্রধানত কাঠ দিয়ে তৈরী। গাঠনিক ভিন্নতা থাকলেও কিছু ব্যাসিক অংশ থাকে- যেমন খোল, পাটা, ছই বা ছাউনী, হাল, দাঁড়, পাল, পালের দড়ি, মাস্তুল, নোঙর, খুঁটি দড়ি, গলুই, বৈঠা, লগি, গুণ।
নৌকা চিত্র
আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা
তথ্যসূত্র:
প্রতিদিনের সংবাদ
উইকিপিডিয়া
আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিংক