অনুষ্ঠান এবং মিষ্টি বাঙালি ঐতিহ্যের দুটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কারণ, বাংলাদেশিরা মিষ্টির খুব পছন্দ করে। এদেশে মানুষ মিষ্টি ছাড়া কোনো শুভ অনুষ্ঠান উদযাপন করতে পারে না। শুধু দেশেই নয় সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বাংলাদেশের সেরা মিষ্টি নিয়ে বিভিন্ন জেলাকে ব্রান্ডিং করা যেতেই পারে। যেমন বগুড়া জেলাকে সমৃদ্ধ করেছে বগুড়ার দই। বগুড়ার দইয়ের মাথায় আজ জিআই মুকুট।
দই হল একটি সুস্বাদু দুগ্ধজাত দ্রব্য, যা গরুর দুধের ব্যাক্টেরিয়া গাঁজন থেকে প্রস্তুত করা হয়। আর এই দই বাঙালি রসনায় যেনো শেষ পাতের অমৃত। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক ভোজে মুল খাবার শেষে মিস্টান্ন হিসেবে দই পরিবেশন করা হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় দই তৈরি হলেও ‘বগুড়ার দই’ বা ‘বগুড়ার দোই’ গুণগত দিক থেকে সেরা এবং স্বাদে বিখ্যাত। খোদ ইংল্যান্ডের রানি মুগ্ধ হয়েছেন বগুড়ার দুই খেয়ে। বগুড়ার দই বলতে, বগুড়া শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিনে শেরপুর উপজেলা থেকে শুরু হয় বগুড়ার দই এর ইতিহাস।
২০২৩ সালে জুন মাসে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বগুড়ার বিখ্যাত সরার দই।
বগুড়ার দইয়ের খ্যাতির মুকুটে যুক্ত হলো ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। বগুড়ার দইয়ের মাথায় জিআই মুকুট। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) ২৫ জুন এ অনুমোদন দেয়। নিয়ে দেশের ১৭টি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেল। ( হালনাগাদ ২৫ আগষ্ট ২০২৩ )
বগুড়ার এই এলাকায় কে এই ব্যবসা শুরু করেছে সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি তবে ধারণা করা হয় ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর গৌড় গোপাল চন্দ্র ঘোষ নামে এক ব্যক্তি এই ব্যবসার প্রবর্তক যিনি ভারত থেকে বগুড়ার শেরপুর এলাকায় চলে আসেন এবং তার পেশা ছিল দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন। এটি ছিল তার পূর্বপুরুষদের পারিবারিক পেশা। শুরুতে তিনি টক দই সরবারাহ করতনে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবারের কাছে। পরে সময়ের বিবর্তনে স্বাধের বৈচিত্রতা আনতে মিষ্টি ‘দই’ উৎপাদন শুরু করেন এবং প্রতিদিন বগুড়ায় বিক্রি করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই প্রশংসিত হন। এরপর তিনি পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বগুড়ায় একটি কারখানা শুরু করেন, যিনি তার ‘দোই’-এর স্বাদ দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর দই বা ‘দই দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তিনি তা বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে শুরু করেন। দোই দোকান “গৌর গোপাল দধি ঘর” তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং এখনও তার ছেলে দ্বারা পরিচালিত এবং এখনও এটি ব্যবসা করছে।
বগুড়ার বিখ্যাত দই এর আদি দোকান “গৌর গোপাল দধি ঘর”
বলে রাখা ভালো দই যত জনপ্রিয়ই হোক, এটি আমাদের নিজস্ব খাদ্য নয়। প্রায় চার হাজার বছর আগে দইয়ের চল শুরু হয়েছিল সুমেরীয় বা আক্কাদীয় যাযাবর নোম্যাডিক জাতির কল্যাণে। তারা চামড়ার মশকে করে দুধ সংরক্ষণ করত। এক বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংযোগ গাঁজন প্রক্রিয়ায় দুধ জমে দই হয়ে যেত। এখনো সেই একই প্রক্রিয়াতেই দই তৈরি হয়ে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে দইয়ের উৎপাদন এবং আধুনিক বিশ্বে দইয়ের প্রচলনের কৃতিত্ব বুলগেরিয়ার। সেই দই কালক্রমে যুক্ত করেছে বাঙালির রসনাতে।
( তথ্য : প্রথম আলো )
বগুড়ার দইয়ের মাথায় জিআই মুকুট
বগুড়ার দই এর প্রস্তুত প্রণালি:
The method of making traditional mishti doi
দুধ সংগ্রহ
ভালো দই এর গুরুত্বপূর্ন উপাদান গলো উৎকৃষ্ট মানের দুধ। বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামগঞ্জ থেকে দুধ সংগ্রহ করে কারখানায় আনা হয়। শেরপুরের এই দইয়ের বাজারকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রায় ৬ হাজার দুগ্ধ খামার। এসব খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার লিটার দুধ আসে।
দুধ জ্বাল
বলা হয় দুধ যত জ্বাল হবে, দই তত ভালো হবে। ভালো দই এর অন্যতম ধাপ হলো ভালো ভাবে দুধ জ্বাল দেয়া। প্রথমে পরিষ্কার বড় কড়াই বা পাতিলে দুধ ছেঁকে ঢেলে নিতে হয়। তারপর সেটিকে দুই থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত জ্বাল দিতে হয়। দই তৈরির মূল বিষয় হলো জ্বালের তারতম্য। এই জ্বালের ওপর ভিত্তি করে সাদা দই, শাহি দইসহ নানান ধরনের দই বানানো হয়।
দুধ জ্বাল দিতে দিতে যখন মোট পরিমানের অর্ধেকে চলে আসে তখন তাতে পরিমান মত চিনি দিয়ে, চিনি না গলা পর্যন্ত জ্বাল দিতে হবে। দুধ ঘন হয়ে লালচে রং হয়ে আসলে জ্বাল থেকে নামিয়ে আনতে হবে।
মিষ্টি দইয়ের ক্ষেত্রে ৪০ লিটার দুধের সঙ্গে ৬ কেজি চিনি মিশিয়ে ২৬-২৯টি সরায় দই পাতা যায়। প্রতিটি সরায় ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ গ্রাম দই থাকে।
দই পাতা
দুই পাতার জন্য চুলার পাশেই মাটির হাঁড়ি বা সরা সাজিয়ে রাখা হয়। যাতে সরা গুলো হালকা গরম থাকে। ঘন দুধের লালচে রং আসলে সরা গুলোতে দুধ ঢালা হয়। এবং সরার সাইজ অনুযায়ী বীজদই যুক্ত করা হয়। এরপর সরাগুলোকে বড় ঝাপি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। এভাবেই আস্তে আস্তে দই জমতে থাকে।
আরও পড়ুন