অনুষ্ঠান এবং মিষ্টি বাঙালি ঐতিহ্যের দুটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কারণ, বাংলাদেশিরা মিষ্টির খুব পছন্দ করে। এদেশে মানুষ মিষ্টি ছাড়া কোনো শুভ অনুষ্ঠান উদযাপন করতে পারে না। শুধু দেশেই নয় সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বাংলাদেশের সেরা দশ মিষ্টি নিয়ে বিভিন্ন জেলার ব্রান্ডিং করা যেতেই পারে। যা জেলাগুলোকে সমৃদ্ধ করেছে । মিষ্টি নিয়ে একটি খনার বচন রয়েছে।
‘যত জ্বালে ব্যঞ্জন মিষ্ট/তত জ্বালে ভাত নষ্ট’ অর্থাৎ মিষ্টি যত জ্বালানো যাবে তত ভালো, আর ভাত যত জ্বাল দেয়া হবে তত নষ্ট হবে।
পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন হালখাতা খোলার সাথে সাথে ক্রেতাদের মিষ্টি মুখ করানো হয়। তাতে থাকে ক্ষীরকদম, গোলাপজাম, কাঁচা এবং পাকা দুই রকমের ম্যাংগো রসগোল্লা, মতিচুরের লাড্ডু, কেশর কালাকাধ, কেশর মালাই চমচম, চকলেট সন্দেশ সহ হরেক রকমের মিষ্টি। আর, প্রচলিত ভাবে লাল হাঁড়িতে করে শশুর বাড়ি মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার যে প্রচলন তা তো আজ হারাতে বসেছে আধুনিকতার মোড়কে।
আমাদের দেশে অনেক রকম জাতের মিষ্টি উৎপাদিত হয়; কিন্তু কিছু ঐতিহ্যবাহী মিষ্ট সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। তারা তাদের আকার, রঙ এবং স্বাদ অনুযায়ী বেশিরভাগই অন্যদের থেকে আলাদা। সারা দেশে বিভিন্ন জেলায় বেশ কিছু মিষ্টি রয়েছে যা সমৃদ্ধ করেছে পুরো দেশকে।
মিষ্টি নির্মাণ একটি বিশেষ কলা। যারা মিষ্টি তৈরী করে তাদের বলা হয় ময়রা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বিখ্যাত সব মিষ্টি
famous sweets of different districts of Bangladesh
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ মিষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন সেখানকার ময়রারা। তাদের নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতায় ঐতিহ্যবাহী হয়ে উঠেছে সেসব মিষ্টি। এর মধ্যে আছে-
- ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মন্ডা
- নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি
- নাটোরের কাঁচাগোল্লা
- টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম
- কুমিল্লার রসমালাই
- বিক্রমপুর ও কলাপাড়ার রসগোল্লা
- বগুড়ার দই
- গৌরনদীর দই
- যশোরের খেজুরগুড়ের সন্দেশ
- শাহজাদপুরের রাঘবসাই, পানতোয়া
- খুলনা ও মুন্সিগঞ্জের অমৃতি
- নওগাঁর প্যারা সন্দেশ
- চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের আদি চমচম
- শিবগঞ্জের চমচম, প্যারা সন্দেশ
- কিশোরগঞ্জের তালরসের পিঠা
- ফেনীর খন্ডলের মিষ্টি
- ময়মনসিংহের অমৃতি, মালাইকারী এবং চালের জিলাপি
- যশোরের জামতলার মিষ্টি
- মেহেরপুরের সাবিত্রী মিষ্টি
- যশোরের নলেন গুড়ের প্যারা সন্দেশ
- গুঠিয়ার সন্দেশ
- সিরাজদিখানের পাতক্ষীর
- রাজবাড়ীর চমচম
- নওগাঁর রসমালাই
- কুষ্টিয়ার মহিষের দুধের দই
- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী
- গাইবান্ধার রসমঞ্জরী
- গুলশানের সমরখন্দের রেশমী জিলাপী
- রাজশাহীর রসকদম
- লক্ষ্মীপুরের রামগতির মহিষের দুধের দই
- যশোরের খেজুর রসের ভিজা পিঠা
কয়েক প্রকার মিষ্টি
different types of sweets
- রসগোল্লা
- রাজভোগ
- কালোজাম
- চমচম
- রসমালাই
- প্রাণহরা
- সন্দেশ
- ছানামুখী
- মণ্ডা
- বুরিদান
- মতিচুর লাড্ডু
- আমিট্টি বা আমৃতি
- মালাইকারী
- কাঁচাগোল্লা
বাংলাদেশের সেরা দশ মিষ্টি
Sweets of Bangladesh
পোড়াবাড়ির চমচম
Porabari Chamcham | TANGAIL
আপনি কি কখনো টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি চমচম খেয়েছেন? যে মিষ্টি ছানার তৈরি এবং ইট রঙের মতো। এই বিখ্যাত মিষ্টি টাঙ্গাইলের প্রায় দুইশ বছরের প্রাচীন গৌরব বহন করে। এই পোড়াবাড়ি চমচম যা সমগ্র ভারত পাক উপমহাদেশ জুড়ে বিখ্যাত ছিল এবং এখনও সকলের কাছে চিরন্তন আবেদন রয়েছে। বৃটিশ শাসনামল থেকে প্রস্তত হওয়া এই মিষ্টিটি টাঙ্গাইলকে সারা বিশ্ব কর্তৃক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির ধলেশ্বরী নদীর তীরে ছোট্ট একটি গ্রামে এই মিষ্টি বানানো হয়। পোড়াবাড়ি গ্রামের নামানুসারে এই মিষ্টির নামকরণ করা হয়েছে। এটি টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।
ধরানা করা হয়, চমচম বানানোর ক্ষেত্রে ধরেশ্বরী নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ বিষেশ প্রভাব রাখে। ওখানের মিষ্টি কারিগররা বিশ্বাস করেন যে টাঙ্গাইল শহরের বাইরে গিয়ে এই মিষ্ট বানানো সম্ভব নয়।
প্রাচিন কালে মিষ্টি কারিগরদের হালই বলা হতো
কে এই মিষ্টি নামের প্রবর্তক তা অজানা থাকলেও কথিত আছে, আসাম থেকে আসা যশোরাথ নামক এক ব্যক্তি বা অজ্ঞাত ঠাকুর প্রথমে পোড়াবাড়ির দেশি গাভির ঘন দুধে ধলেশ্বরীর মিষ্টি জল আর চিনি মিশিয়ে চমচম তৈরি করতে শুরু করে। পরবর্তীতে পোড়াবাড়ি গ্রামের ঘোষ ও পাল বংশের লোকরা বংশানুক্রমে চমচম তৈরির সাথে জড়িত হয়।
এটি প্রস্তুতের উপকরণসমূহ হলো ময়দা, ননী বা মাখন, চিনি, জাফরান, লেবুর রস, এবং নারকেল।
প্রস্তুত প্রণালীঃ
চুলায় গরুর খাঁটি দুধ জ্বাল দিয়ে প্রথমে প্রস্তুত করা হয় ছানা। পাঁচ কেজির মতো ছানার সঙ্গে মেশানো হয় ২৫০ গ্রাম ময়দা। এরপর ভালো করে মেখে মিষ্টির আকার দিয়ে চিনির শিরায় জ্বাল দিতে হয় অন্তত আধাঘণ্টা। ক্রমশ পোড়া ইটের মতো রং ধারণ করে লম্বা মিষ্টিগুলো। এভাবেই প্রস্তুত হয় পোড়াবাড়ির চমচম।
লালচে রঙের পোড়াবাড়ির চমচমের ওপর দুধ জ্বাল দিয়ে শুকিয়ে তৈরি গুঁড়া মাওয়া ছিটিয়ে দেওয়া হয়।
মুক্তাগাছার মণ্ডা
বাংলাদেশের মিষ্টি প্রেমীরা ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মণ্ডের সাথে পরিচিত যা প্রথম চালু করেছিলেন গোপাল পাল নামে পরিচিত রাম গোপাল পাল।
মন্ডা তৈরি নিয়ে একটি ইতিহাস জানা যায়। দুই শতাধিক বছর আগে মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মন্ডার জনক গোপাল পাল এক রাতে স্বপ্নে দেখতে পান, শিয়রে দাঁড়িয়ে এক ঋষি তাকে আদেশ দিচ্ছেন মন্ডা মিষ্টি তৈরি কর। পরদির গোপাল ঋষির আদেশে চুল্লি খনন শুরু করলেন। হটাৎ উদয় হলেন সেই সাধু। তিনি হাত বুলিয়ে দিলেন চুল্লিতে। শিখিয়ে দিলেন মন্ডা তৈরির কলাকৌশল।
শেখানোর পর আশীর্বাদ করেন, ‘তুই এই মন্ডার জন্য অনেক খ্যাতি অর্জন করবি। তোর মন্ডার সুখ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।’
দুধ ও চিনি দিয়ে তৈরি হলো মন্ডা। গোপাল তার নব উদ্ভাবিত মন্ডা পরিবেশন করলেন তৎকালীন মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর রাজদরবারে। খেয়ে তো জমিদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পরে জমিদার গোপালকে জমিদারদের সাথে দেখা করতে আসা অতিথিদের আপ্যায়ন করার জন্য মন্ডা তৈরি করতে উৎসাহিত করেন। তখন এই প্রথাটি অন্যান্য জমিদার এবং পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠল গোপাল পালের মন্ডা। এখনও তার বংশধরেরা মন্ডা তৈরি করেন।
গোপাল সম্বন্ধে জানা যায়, বাংলা ১২০৬ সালে তৎকালীন ভারতবর্ষের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন । নবাব সিরাজদৌলার মৃত্যুর পর গোপাল মাতৃভূমি রাজশাহীতে চলে আসেন । পরে বাংলা ১২৩০ সালে তিনি মুক্তাগাছায় বসত গড়েন । প্রথম মন্ডা তৈরি হয় বাংলা ১২৩১ সালে । তিনি ১৮২৪ সালে এই লোভনীয় মিষ্টি মন্ডা প্রস্তুত করতে শুরু করেন, এটি এখন উপমহাদেশ এবং অনেক দেশে এর মৌলিকতা, স্বাদ এবং গন্ধের জন্য বিখ্যাত।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়, পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি, প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আলাউদ্দিন খাঁ, রাশিয়ার কমরেড জোসেফ স্তালিন, চিনের কমরেড মাও সে তুং অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন মুক্তাগাছার মিষ্টি খেয়ে।
বগুড়ার দই
Bogurar mishti doi
দই হল একটি সুস্বাদু দুগ্ধজাত দ্রব্য, যা গরুর দুধের ব্যাক্টেরিয়া গাঁজন থেকে প্রস্তুত করা হয়। আর এই দই বাঙালি রসনায় যেনো শেষ পাতের অমৃত। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক ভোজে মুল খাবার শেষে মিস্টান্ন হিসেবে দই পরিবেশন করা হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় দই তৈরি হলেও ‘বগুড়ার দই’ বা ‘বগুড়ার দোই’ গুণগত দিক থেকে সেরা এবং স্বাদে বিখ্যাত। খোদ ইংল্যান্ডের রানি মুগ্ধ হয়েছেন বগুড়ার দুই খেয়ে। বগুড়ার দই বলতে, বগুড়া শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিনে শেরপুর উপজেলা থেকে শুরু হয় বগুড়ার দই এর ইতিহাস।
২০২৩ সালে জুন মাসে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বগুড়ার বিখ্যাত সরার দই।
বগুড়ার দইয়ের খ্যাতির মুকুটে যুক্ত হলো ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। বগুড়ার দইয়ের মাথায় জিআই মুকুট। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) ২৫ জুন এ অনুমোদন দেয়। নিয়ে দেশের ১৭টি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেল। ( হালনাগাদ ২৫ আগষ্ট ২০২৩ )
বগুড়ার এই এলাকায় কে এই ব্যবসা শুরু করেছে সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি তবে ধারণা করা হয় ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর গৌড় গোপাল চন্দ্র ঘোষ নামে এক ব্যক্তি এই ব্যবসার প্রবর্তক যিনি ভারত থেকে বগুড়ার শেরপুর এলাকায় চলে আসেন এবং তার পেশা ছিল দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন। এটি ছিল তার পূর্বপুরুষদের পারিবারিক পেশা। শুরুতে তিনি টক দই সরবারাহ করতনে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবারের কাছে। পরে সময়ের বিবর্তনে স্বাধের বৈচিত্রতা আনতে মিষ্টি ‘দই’ উৎপাদন শুরু করেন এবং প্রতিদিন বগুড়ায় বিক্রি করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই প্রশংসিত হন। এরপর তিনি পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বগুড়ায় একটি কারখানা শুরু করেন, যিনি তার ‘দোই’-এর স্বাদ দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর দই বা ‘দই দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তিনি তা বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে শুরু করেন। দোই দোকান “গৌর গোপাল দধি ঘর” তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং এখনও তার ছেলে দ্বারা পরিচালিত এবং এখনও এটি ব্যবসা করছে।
বগুড়ার বিখ্যাত দই এর আদি দোকান “গৌর গোপাল দধি ঘর”
বলে রাখা ভালো দই যত জনপ্রিয়ই হোক, এটি আমাদের নিজস্ব খাদ্য নয়। প্রায় চার হাজার বছর আগে দইয়ের চল শুরু হয়েছিল সুমেরীয় বা আক্কাদীয় যাযাবর নোম্যাডিক জাতির কল্যাণে। তারা চামড়ার মশকে করে দুধ সংরক্ষণ করত। এক বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংযোগ গাঁজন প্রক্রিয়ায় দুধ জমে দই হয়ে যেত। এখনো সেই একই প্রক্রিয়াতেই দই তৈরি হয়ে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে দইয়ের উৎপাদন এবং আধুনিক বিশ্বে দইয়ের প্রচলনের কৃতিত্ব বুলগেরিয়ার। সেই দই কালক্রমে যুক্ত করেছে বাঙালির রসনাতে।
( তথ্য : প্রথম আলো )
বগুড়ার দই এর প্রস্তুত প্রণালি:
The method of making traditional mishti doi
দুধ সংগ্রহ
ভালো দই এর গুরুত্বপূর্ন উপাদান গলো উৎকৃষ্ট মানের দুধ। বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামগঞ্জ থেকে দুধ সংগ্রহ করে কারখানায় আনা হয়। শেরপুরের এই দইয়ের বাজারকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রায় ৬ হাজার দুগ্ধ খামার। এসব খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার লিটার দুধ আসে।
দুধ জ্বাল
বলা হয় দুধ যত জ্বাল হবে, দই তত ভালো হবে। ভালো দই এর অন্যতম ধাপ হলো ভালো ভাবে দুধ জ্বাল দেয়া। প্রথমে পরিষ্কার বড় কড়াই বা পাতিলে দুধ ছেঁকে ঢেলে নিতে হয়। তারপর সেটিকে দুই থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত জ্বাল দিতে হয়। দই তৈরির মূল বিষয় হলো জ্বালের তারতম্য। এই জ্বালের ওপর ভিত্তি করে সাদা দই, শাহি দইসহ নানান ধরনের দই বানানো হয়।
দুধ জ্বাল দিতে দিতে যখন মোট পরিমানের অর্ধেকে চলে আসে তখন তাতে পরিমান মত চিনি দিয়ে, চিনি না গলা পর্যন্ত জ্বাল দিতে হবে। দুধ ঘন হয়ে লালচে রং হয়ে আসলে জ্বাল থেকে নামিয়ে আনতে হবে।
মিষ্টি দইয়ের ক্ষেত্রে ৪০ লিটার দুধের সঙ্গে ৬ কেজি চিনি মিশিয়ে ২৬-২৯টি সরায় দই পাতা যায়। প্রতিটি সরায় ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ গ্রাম দই থাকে।
দই পাতা
দুই পাতার জন্য চুলার পাশেই মাটির হাঁড়ি বা সরা সাজিয়ে রাখা হয়। যাতে সরা গুলো হালকা গরম থাকে। ঘন দুধের লালচে রং আসলে সরা গুলোতে দুধ ঢালা হয়। এবং সরার সাইজ অনুযায়ী বীজদই যুক্ত করা হয়। এরপর সরাগুলোকে বড় ঝাপি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। এভাবেই আস্তে আস্তে দই জমতে থাকে।
কুমিল্লার রসমলাই
বগুড়ার দই এর মত করে শতবর্ষের ঐতিহ্য নিয়ে কুমিল্লার জেলার ব্রান্ডিং করে যাচ্ছে কুমিল্লার রসমালাই। মিষ্টির নামের এবং আলাদা স্বাদের জন্য ওই অঞ্চলের নাম জুড়ে দিতে হয়েছে। তার কারন হিসেবে অনেকে মনে করেন যে স্থানীয় জল বা ধোঁয়া গন্ধ হল কুমিল্লার রসমালাই এর মুল রহস্য। সে যাই হোক, মিষ্টির মূল স্বাদ আসে খাঁটি দুধ, জ্বাল আর দুধের সাথে অন্যান্য উপকরনের সঠিক মিশ্রন।
কুমিল্লার রসমালাই ইতিহাস
কুমিল্লা তখন ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে কুমিল্লা শহর দুইটি অংশে বিভক্ত ছিল। রাজগঞ্জ বাজারের পূর্বদিক ছিল ব্যাবসায়িক এলাকা। আর পশ্চিম দিক ছিল আবাসিক। রাজগঞ্জের পূর্বদিকে গোয়ালপট্টিতে ঘোষরা মিষ্টান্ন তৈরি করতো। সেখানে খাঁটি গরুর দুধ দিয়ে দই, মাঠা, মাখন, ঘি, জিলাপি ও বাতাসা তৈরি করা হতো। ব্যাবসায়িক এলাকা হওয়ায় এখানে ব্যাংকরে কাজে দূর-দূরান্তের মানুষের যাতায়ত ছিলো। পাশেই ছিলো রাজরাজেশ্বরী কালিবাড়ি মন্দির। মন্দিরের ভোজনের উপকরন ছিলো মিষ্টি জাতিয় খাবার। এসব কারনেই ১৯৩০ সালের দিকে কুমিল্ল নগরীর মনোহরপুর একলাকায় গড়ে ওঠে মাতৃভান্ডার, শীতল ভান্ডার এবং ভগবতী পেড়া ভান্ডার। এবং ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা মিষ্টি ভান্ডার। তারাই ছানার মিষ্টি শুরু করে। এরপর আকৃতি এবং স্বাদের পরিবর্তনের রসমালাই বানানো শুরু হয়। মূলত এ চার প্রতিষ্ঠান থেকেই কুমিল্লার রসমালাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
রসমালাই বানানো রেসিপি
প্রথমে বিভিন্ন গোয়ালার কাছ থেকে খাঁটি দুধ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ওই দুধ চুলার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় জ্বাল দেওয়া হয়। অন্তত দুই ঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর দুধ ঘন হয়ে ছানায় রূপ নেয়। এরপর ছানার সাথে কিছু ময়দা মিশিয়ে ছোট ছোট দানাদার মিষ্টির মতো বানানো হয়। েএক কেজি ছানাতে এক ছটাক পরিমান ময়দা মেশানো হয়। পরে রসের মধ্যে দিয়ে সেটি রসমালাইতে পরিণত করা হয়। দুধের ঘনত্ব যত বেশি হবে, রসমালাই তত বেশি সুস্বাদু হবে।
পরিমান : একমন দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষির তৈরি করে ১৪ কেজির মতো রসমালাই বানানো যায়।
মাতৃভান্ডার আর অন্যান্য ভান্ডার
কুমিল্লার রসমালাই বলতেই মাতৃভান্ডার এর রসমালাই এর সুনাম শুধু দেশেই নয়, বরং সারাবিশ্বে। এ সুনামে খুশি হয়ে কিছু দুর্নাম মেশাতে ঢাকা-চট্টগ্যাম মহাসড়কের আলেখাচর অংশের দু’পাশে ব্যাবসা শুরু করেছে বেশ কয়েকটি মাতৃভান্ডার। এসব মিষ্টির দোকানের সবই নকল মাতৃভান্ডারের দোকান। কারন মাতৃভান্ডারের মনোহরপুর ছাড়া আর কোনো শাখা নেই।
কুমিল্লার আসল মাতৃভান্ডার রসমালাই
নামকরন: মন্দিরের কালী থেকে মায়ের নামটি নিয়ে এর নাম মাতৃভান্ডার করা হয়েছে।
অবস্থান : কুমিল্লা নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ২০০ গজ পূর্বদিকে মনোহরপুর।
মাতৃভান্ডারের স্বত্বাধিকারী : অনির্বাণ সেন গুপ্ত (তার দাদা, বাবার পর বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছেন। )
দাম : কেজি রসমালাইয়ের দাম ৩৭০ টাকা। (হালনাগাদ ২০২৩)
নাটোরের কাঁচাগোল্লা
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
– জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশের ক্লান্ত প্রান কি জুড়িয়ে ছিলো মধুসূদন এর কাচাঁ গোল্লায়! এতো পুরানো ঐতিহ্যবাহী খাবার চেখে দেখলে অবশ্যই কবিতায় আসতো। সে যাই হোক। নাটোরের মিষ্টিটির নাম কাচাগোল্লা হলেও এটি দেখতে মোটেও কাচাঁ কিংবা গোলাকার নয়।
কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির কাহিনি
জনশ্রুতি আছে নিতান্ত দায়ে পড়েই নাকি তৈরি হয়েছিল এই মিষ্টি। নাটোর শহরের লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান ছিল নাটোরের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই মণ ছানা দিয়ে রসগোল্লা, পানতোয়া, চমচম, কালোজাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন ১০-১৫ জন কর্মচারী।
হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই মিষ্টি বানানেরা জন্য আগের রাতেই তৈরি করা হয় দেড় থেকে দুই মন ছানা। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখলেন। এরপর এলোমেলো চিন্তা থেকেই ওই চিনি মেশানো ছানা মুখে দিয়ে দেখেন বেশ স্বাদ হয়েছে। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় নতুন এই মিষ্টি পাঠিয়ে দেন রানি ভবানীর রাজবাড়িতে।
রানি ভবানী এই মিষ্টি খেয়ে প্রশংসা করেন এবং এর নাম জানতে চান। নতুন মিষ্টির নাম কী রাখা হবে- এ নিয়ে শুরু হয় চিন্তাভাবনা। যেহেতু চিনির রসে ডোবানোর পূর্বে ছানাকে কিছুই করতে হয়নি অর্থাৎ কাঁচা ছানাই চিনির রসে ঢালা হয়েছে। মধুসূদন পাল তখন কাঁচা ছানা থেকে তৈরি বলে এর নাম দেন কাঁচাগোল্লা।
এর রয়েছে একটি মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধ, যা অন্য কোনো মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তখন থেকে মধুসূদন নিয়মিতই এই মিষ্টি বানাতে থাকেন। কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কাঁচাগোল্লার চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগল।
এই হচ্ছে কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির ইতিহাস। এই গল্প বেঁচে আছে শত-শত বছর ধরে মানুষের মুখে- মুখে।
নাটোরের কাঁচাগোল্লা এক ধরনের মিষ্টি যা মিষ্টি কম এবং কাঁচা ছানার আবেশ
কাঁচাগোল্লার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নাটোরবাসীর আবেগ ও ভালোবাসা। তাই ২৫০ বছর আগে কাঁচাগোল্লা আবিষ্কৃত হয়ে আজও সুনাম বজায় রেখেছে। এ সুনামের সাথে এবার যুক্ত হলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
দেশের ১৭তম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি “কাঁচাগোল্লা”। ৮ আগস্ট শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) এক সভায় এ অনুমোদন দেয়।
কোথায় পাবেন ভালো কাঁচাগোল্লা :
নাটোর শহরের কালীবাড়ি এলাকার ভিতরে মন্দিরের সামনে লালবাজারের মধুসূদন পালের জরাজীর্ন দোকানটিই নাটোরের সেরা কাচাঁ গোল্লার দোকান। এছাড়া নীচা বাজারের কুন্ডু মিষ্টান্ন ভান্ডার, অনুকূল দধি ও মিষ্টান্ন ভান্ডার, দাবপট্টি মিষ্টান্ন ভান্ডার, স্টেশন বাজারের নয়ন ও সকাল-সন্ধ্যা এবং জগন্নাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার ভালো মানের কাচাঁগোল্লা বিক্রি করে। তবে বর্তমানে কাঁচাগোল্লা বিক্রিতে শীর্ষে রয়েছে মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডার। এদের রয়েছে নিজের ৩৮টি গাভি। নিজস্ব জমিতে গো-খাদ্য হিসেবে এরা ঘাসও চাষ করে। নাটোরের কাঁচাগোল্লার দাম ৬০০ – ৬৫০ টাকা প্রতি কেজি
জামতলার মিষ্টি
যশোর জামতলা মিষ্টির জন্য সুপরিচিত। এই স্পঞ্জ ধরনের মিষ্টি সারা দেশে খুব পরিচিত এবং এটি ৫0 বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যমান। এটি বাংলাদেশের একটি অনন্য মিষ্টি যা স্থানীয়ভাবে সাদেক গোল্লা নামে পরিচিত। এটি যশোরের একটি দেশীয় মিষ্টি হলেও এখন এটি বাংলাদেশের সর্বত্র পাওয়া যায়। এই মিষ্টি পাওয়ার প্রধান স্পট জামতলা, শার্শা, যশোর।
সাতক্ষীরার সন্দেশ
সারা বাংলাদেশেই কমবেশি সন্দেশ প্রস্তুত করা হয়। দুধ ও চিনি প্রধান উপাদান। সাতক্ষীরা প্যারা সন্দেশ আরেকটি জনপ্রিয় মিষ্টর জাত। এটি একটি শুকনো মিষ্টি। অন্যদিকে ঐতিহ্যবাহী নরম সন্দেশও এখানে জনপ্রিয়। সাতক্ষীরা জেলায় অনেক কারখানা ও মিষ্টির দোকান রয়েছে। এরকম দু-একটি দোকানের বয়সও একশো বছরেরও বেশি।
নওগাঁর প্যারা সন্দেশ
প্যারা সন্দেশ হল দুধের ক্ষীর দিয়ে ও চিনি দিয়ে তৈরি মিষ্টির শুষ্ক রূপ। নওগাঁ বড় শহর নয় তবুও মিষ্টির প্রায় ১00 বছরের ইতিহাস রয়েছে। সেই সময়টা ছিল হিন্দু দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এই মিষ্টান্ন দেয়া হত । পেরা সন্দেশ শুষ্ক প্রকৃতির হওয়ায় এক সপ্তাহ সহজেই সংরক্ষণ করা যায়। বিদেশেও রপ্তানি হয়।
নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি
নেত্রকোনা অনেক কিছুর জন্য বিখ্যাত। এর মধ্যে বালিশ মিষ্টি সবচেয়ে জনপ্রিয়। আমরা এই নির্দিষ্ট জায়গা সম্পর্কে কথা বলতে গেলে এটি প্রথমে আসে। প্রায় শত বছরের ইতিহাস রয়েছে এই মিষ্টির। বালিশের মতো আকৃতি এবং বিশাল আকারের কারণে একে বালিশ (বালিশ) মিষ্টি বলা হয়। প্রতিটির ওজন দুই কেজি পর্যন্ত হতে পারে। ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে বর পরিবার কনের বাড়িতে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি পাঠালে এটি তালিকার শীর্ষে থাকে। এই মিষ্টি প্রথম তৈরি করেন গয়ানাথ। তাই এটি গয়ানাথের বালিশ মিষ্টি বা গয়ানাথের চমচম নামেও পরিচিত। তবে ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে তিনি তার কর্মচারী নিখিল মোদককে গোপন রেসিপি শিখিয়েছিলেন। সেই থেকে তার বংশধরেরা এই বিশেষ মিষ্টি তৈরি করে আসছেন। তবে এই মিষ্টি এখন অনেক দোকানেই পাওয়া যায়। আপনি যদি কখনও নেত্রকোনায় যান তবে এই বিশাল চমচমের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। একবার খেয়ে নিলে এর স্বাদ ভুলতে পারবেন না। যদিও মিষি।টর পরিমান অনেক বেশি।
যশোরের জামতলার রসগোল্লা
যশোর বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর জেলা এবং এই স্থানটি বিভিন্ন ধরনের মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। “জামতলার রসগোল্লা” এখানকার অন্যতম প্রধান মিষ্টি। যশোরের পাশের ছোট্ট শহর জামতলা। এটা শহরের মতো নয়, এর নাম জামতলা বাজার। জামতলা মিষ্টির জন্য বিখ্যাত আর রসগোল্লা তার মধ্যে অন্যতম। এই মিষ্টির ইতিহাস অনেক পুরনো। এটা নিয়ে অনেকেই অনেক গল্প বলেছেন। ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এর স্বাদ। এটি খুব মিষ্টি স্বাদ এবং একটি খুব ভাল গন্ধ আছে. যখন আপনি এটি আপনার মুখে প্রবেশ করেন, আপনি একটি ভিন্ন পরীক্ষা পূরণ করেন। মিষ্টি খুব নরম এবং দেখতে সুন্দর। এটি চিনি, দুধ এবং অন্যান্য উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়।
–কন্ট্রিবিউটর | Partho Pratim Mazumder