বিসর্জনের বাজনা বাজে

বিসর্জনের বাজনা বাজে

বিসর্জনের বাজনা বাজে

‘তবু আশা জাগে, তবু ভালো লাগে’ – বিজয়ার শুভেচ্ছা যাচ্ছে এক মানুষের কাছ থেকে আরেক মানুষের কাছে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ‘

‘বিভূতিবাবুদের বাড়ীর প্রতিমা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে’। বেশ জোরের সঙ্গে সিদ্ধান্ত জানায় তিনটে কিশোরের একটি। ‘তোকে বলেছে!’, প্রতিবাদ করে দ্বিতীয় কিশোরটি, ‘সবচেয়ে ভালো হয়েছে শঙ্করমঠের মন্ডপ’। ‘তুই প্রতিমার কি জানিস?’, রেগে যায় প্রথম কিশোরটি, ‘তোরা পূজো করিস?’ উত্তেজিত দু’ কিশোর প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে আসে।

তৃতীয় যে বালকটি এতক্ষন চুপচাপ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল, সে এবার নীচু স্বরে বলে, ‘এই চুপ, চুপ! পন্ডিত মশায় আসছেন’। অন্য দু’টি কিশোর এ সাবধান বাণীতে সচেতন হয়ে ওঠে। ততক্ষনে পন্ডিত মশায় একেবারে কাছে পড়েছেন। ‘নমস্কার,পন্ডিত মশায়’ বলতে বলতে দু’মিনিট আগের ঝগড়া ভুলে গিয়ে তিন কিশোরই পন্ডিত মশায়ের পদতলে সাটাঙ্গে প্রনিপাত’। ‘বেঁচে থাক, বাবারা। দীর্ঘজীবি হও’। বলতে বলতে তিন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তিন কিশোরেকে বুকে টেনে নেন পন্ডিত মশায় বিভূতিবাবুদের বিরাট মন্ডপের সামনে। ষাট বছরেরও ওপরে কোন এক বিজয়া দশমী। স্হান বরিশাল শহরের মধ্যিস্হান।

‘খুব ক্ষিদে পেয়েছে’, তিন কিশোরের একজন ঘোষনা করে পন্ডিত মশায়ের বিদায়ের ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই – কিছুক্ষন আগের জোর তর্ক তখন ইতিহাস মাত্র। ‘অমলদের বাড়ী সবচেয়ে কাছে’, একজন বলে ওঠে। মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনজনকে অমলদের বাড়ীর রান্নাঘরের সামনে। অমলবাবু তখন সবেমাত্র ফলারে বসেছেন। এ ত্রিমূর্তিকে দেখে তিনি মোটেই প্রীত হন না – বুঝতেই পারেন বন্ধুরা ভাগ বসাতেই এসেছে। কিন্তু ভীষন খুশী হন রানী মাসিমা – অমলের মা। উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর মুখ হাসি আর আনন্দে। ‘আয়, আয় বোস’, বলতে বলতে তিন পাত পাড়েন তিনজনের জন্য। ক্ষিদের চোটে ত্রিরত্ন মাসীমাকে বিজয়ার প্রনাম করতে ভুলে যায়। ‘ওদের পাতে দু’টো করে নাড়ু দিয়েছ কেন? আমাকে দিয়েছ মাত্র একটা’, অমলবাবু কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন। ‘ছি, এ ভাবে বলতে হয় না। ওরা অতিথি না? অতিথি নারায়ন’, বিমলের মা ভারী নরম গলায় বলেন। ‘কেন, ঈদের সময়ে যখন আমাদের বাড়ীতে যাস, তখন আম্মা তোকে আটটা মাংসের টুকরো দেন না? আমাকে দেন মাত্র চারটে’, একটি কিশোর মোক্ষম যুক্তি উত্থাপন করে।

পেটপূজো সেরে মাসীমাকে কোনক্রমে একটি ছোট্ট প্রনাম সেরে তিন বন্ধু বাইরে এসে দাঁড়ায়। পেটটা ঠিকমত ভরানো হয় নি – কি করা যায় এখন। ‘চল, অরুনদের বাড়ীতে গিয়ে রাবড়ী খেয়ে আসি’, একজন প্রস্তাব দেয়। এরচেয়ে ভালো কথা আর হয় না – ভাবে অন্য দু’জনা। মীরা কাকীমা ভারী ভালো রাবড়ী বানান। শিব্রাম পড়ার পর থেকেই তিনজনাই রাবড়ীর ভারী ভক্ত। মিনিট বিশেক পরে এই তিন হরিহর আত্মাকে দেখা যায় কলেজ পাড়ায় অরুনদের বাড়ীর সামনের দরজায়।

খোলা দরজা দিয়ে তিনজনেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। আর পড়বি তো পড়ব একেবারে মীরা কাকীমার সামনে। একপেড়ে করে পরা মোটা লাল পাড়ের গরদ পরা, কপালে লাল বড় টিপ, শাঁখা-সিঁদুরে ফর্সা কাকীমাকে প্রতিমার মতো মনে হয় তিন কিশোরের কাছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম কাকীমার, দু’হাতে দু’টো নৈবেদ্যের থালা। ঢিপ ঢিপ করে কাকীমাকে প্রনাম করে তিনজনই। ‘ওরে, থাম, থাম। থালা দু’টো আগে নামিয়ে রাখি’। কাকীমা বলে ওঠেন। ‘রাবড়ী আছে?’, সময় নষ্ট করতে রাজী নয় ত্রিরত্ন। ‘ও, এ’জন্যই আসা বাবুদের’, মুখ টিপে হাসেন মীরা কাকী, ‘বিজয়ার প্রনামী-ট্রনামী কিছু নয়’। ঢিপ ঢিপ করে আবার প্রনাম – রাবড়ী না ফসকে যায়। খিল খিল করে হেসে ওঠেন কাকীমা। তারপর ভারী মায়াময়কন্ঠে বলেন, ‘আয়, দিচ্ছি’।

রাবড়ী দিয়ে পেট ভরিয়ে রাস্তায় নামতেই দেখা গেল সুধীর কাকা আর হেমায়েত চাচা গল্প করতে এদিকেই আসছেন। ‘রাবড়ী খেতে আসছেন’, তিন কিশোরের একজন বাকী দু’জনকে জানায়। তারপর তিনজনই হাসিতে ভেঙে পড়ে। ‘কি রে, টই টই করে সারা দুপুর পাড়া বেড়াচ্ছিস কেন? যা বাড়ী যা’, হেমায়েত চাচা ধমকে ওঠেন। ওঁরা পার হয়ে যেতেই তিন কিশোর ঠোঁট বাঁকায় – ‘হুঁ, নিজেরা পাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে! আর আমরা ঘুরলেই যত দোষ’। ‘বড়রা ভারী হিংসুটে হয়’, দ্রুত এ সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে তিন কিশোরের এক মিনিটও লাগে না।

ঠিক তখনই দেখা যায় বাঁদিকের গুলিতে বেরিয়ে আসছেন রাজিয়া আপা আর প্রতিমা’দি। স্কুলের শেষ বছরে পড়া দু’জন গলায় গলায় বন্ধু। গুজ গুজ করে তিন বন্ধু কি যেন মতলব ফাঁদে। তারপর বান্ধবী দু’জন একেবারে সামনে আসতেই দু’জন কিশোর দ্রুত প্রনামের ভঙ্গিতে দু আপা আর দিদির পা জড়িয়ে বসে পড়ে। তরুনী দু’জন পরম বিব্রত। ‘এই, একি শয়তানী হচ্ছে!’, ‘দাঁড়া, এমন মার খাবি না!, ‘ছেড়ে দে লক্ষ্মী ভাই আমার’ – ভয় দেখানো, অনুরোধ-উপরোন্ত, কিন্তু নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু। ‘ বিজয়া -র প্রণাম। দু’জনকে দু’টো টাকা দিয়ে দাও, ছেড়ে দেবে’, তৃতীয় কিশোরটি ত্রাণকর্তার ভূমিকা নেয়। পারলে তিন জনকেই ভস্ম করে দেয় তরুণী দু’জন তাদের চোখের দৃষ্টি দিয়ে। দিতেই হয় টাকা – তিন কিশোরের উল্লাস দেখে কে? আপাতত: বাড়ী যাওয়া যাক। রাতে আবার প্রতিমা বির্সজনের সময়ে দেখা হবে।

বিসর্জনের বাজনা বাজে

গভীর রাত। কীর্তনখোলার পাড়। প্রতিমা নৌকোয় নিয়ে মাঝনদীতে গেছে। ঢোলের বাদ্যি তুঙ্গে। নদীর পাড় ধরে শত শত মানুষ। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ঐ তিন কিশোর। সবার চোখে জল – তিন কিশোরেরও। প্রনামের ভঙ্গিতে সবাই যুক্তকর হয় – কে কোন ধর্মের তা সেখানে তুচ্ছ। এক সময়ে ঝরাত করে একটা শব্দ হয় – প্রতিমা বির্সজিত হয়েছে। তিন কিশোর বন্ধু জলভরা চোখে পরস্পরকে টেনে নেয় উষ্ণ আলিঙ্গনে।

কাল বিজয়া দশমী। কিন্তু সময় কত বদলে গেছে, বদলে গেছে মানুষ। এক সময় যা ছিল সার্বজনীন, আজ তা হয়ে গেছে খন্ডিত, এক সময়ে যা ছিল অবিভাজ্য, আজ তা হয়ে গেছে বিভাজিত, এক সময়ে যা ছিল বৃহত্তর সংস্কৃতি, আজ তা হয়ে গেছে সীমিত ধর্ম। বলা হচ্ছে, রাম আর রহিম আলাদা, জলের সঙ্গে পানি মিলতে পারে না, আল্লাহর আর ভগবান এক নন। নানান জায়গায় পূজোতে বাধা দেয়া হচ্ছে, মন্ডপ ভাঙ্গা হচ্ছে এখানে ওখানে। ‘অদ্ভুত এক আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’। ‘তবু আশা জাগে, তবু ভালো লাগে’ – বিজয়া -র শুভেচ্ছা যাচ্ছে এক মানুষের কাছ থেকে আরেক মানুষের কাছে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ‘ভালো থাকুক সবাই, আনন্দ আসুক প্রতিটি জীবনে, মঙ্গল হোক সবার’ – সব শুভেচ্ছার ওটাই তো মূলকথা। কিন্তু তার পরেও কথা আছে বিজয়া -র শুভেচ্ছার – ‘আমরা কেউ একা নই, আমরা সবাই সবার সঙ্গে আছি, আমরা সবাই মিলে ঐ অদ্ভুত আঁধারকে সরিয়ে দেব’। আমাদের সবার ‘মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে’।

ষাট বছর পরে কালকের বিজয়া দশমীর আগে ঐ তিনটে কিশোরের একজন পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে। ঐ তো ১৯৬৪ র দাঙ্গার পরে অপূর্বরা চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে অতি ভোরে। ঠেলা গাড়ীর মাথায় বসা অপূর্ব জামার হাতায় চোখ মুছছে। আজকের পেছন ফিরে তাকিয়ে থাকা কিশোরটি হাতের ডালটি মট করে ভেঙ্গে ফেলল – কোন রাগে কে জানে। ঐ তো তার ক’বছর পরে ডেনিসরা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাল – সংখ্যালঘু খৃস্টানদের জন্য নিরাপদ নয় এই দেশ। যে দিন ওরা চলে যায়, আজকের পেছন ফিরে তাকানো কিশোরটি শুধু একবার আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। কি যে কার নালিশ আর কার কাছে যে নালিশ – কে জানে। আস্তে আস্তে পেছন ফিরে তাকানো কিশোরটি সামনের দিকে মুখ ফেরায় – দেখা যায় তাকে পরিস্কার। চিনি তাঁকে আমি, কারন সে আমারই আমি।



durgha puja bangladesh 23

দূর্গা পূজা নিয়ে আরও পড়ুন

এবার আমি দুর্গা হতে চাই

এই ভাবেই দুর্গা প্রধানতম দেবী হিসেবে আবির্ভূত হন বাঙ্গালী হিন্দুদের কাছে। যা আজ বাংলার সর্ববৃহৎ পূজায় রুপান্তরিত হয়েছে।

লেখকের facebook থেকে নেয়া :

মন্তব্য করেন | 


Mahmuda Rahman Khan
আজকের এই বিভক্তি কি কোনদিন আমরা এক করতে পারবো আবার? আজ বিজয়ার শুভেচ্ছা জানালেই মানুষ ধর্ম নিয়ে কথা তোলে, গালাগাল দেয়, দেখলাম আজ আর একটি সামাজিক মাধ্যমে! মানব ধর্ম ভুলেই গেলাম সবাই! বিজয়ার শুভেচ্ছা সকলকে!

Shamsul Alam
একটি কালের মানুষের হার্দ্যপূর্ণ সামাজিক অবস্থার সুন্দর ছবি।মনকে আলোকিত ও আলোরিত করে।আজকে আমাদের এত বিভাজিত চিন্তা কেন ?এমন অবক্ষয় আমাদের সমাজে কিভাবে বিস্তৃত হল ?এ প্রশ্নের উওর খুঁজে সমাধানের পথে এগুতে হবে ।ধন্যবাদ ভাই ।

Hemayet Haroon
আমাদের সময়ের পুজো পার্বণের চিরন্তন ছবির গল্প। আনন্দ ভাগাভাগির গল্প।


Arifur Rahman
আমাদের কৈশোর আর আমাদের প্রজন্মের মননশীলতা ফিরে দেখার একটি শ্রেষ্ঠ ইতিহাস এই লেখাটি। আমরা সেসময় সবাই মানুষ ছিলাম। কিন্তু রাজনীতি ধর্মীয়বোধকে ব্যবহার করে আমাদের সব মানুষকে বিভিন্ন ধর্মে ভাগ করে দিলো।

Nilufar Momtaz
কি নিদারুন সত্য,আজ ভগবান, জীশু, আল্লাহ সবাই কি আলাদা হয়ে গেল,নাকি মানুষ তাদের আলাদা করেছে.? মানুষের জন্য ধর্ম,মানবতাই একমাত্র ধর্ম.! কত সুন্দর স্মৃতিকথা ও একাত্মবোধ মানুষের মাঝে, আজ কেন এগুলো হারিয়ে ফেলছি আমরা,তাহলে মানবিক গুণ গুলোও যে হারিয়ে যাবে, সেটা কি ভাবছি না,ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এই খন্ডিত সমাজচিত্র কেন থাকবে..? এগুলো মাথায়,মনে এলে নিজের অসহায়ত্ব ছেঁকে ধরে, পেছনের চিত্রগুলো মনকে আলোড়িত করে, আবারও অতীতেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, যেটা সম্ভব নয়। অতীতের শিক্ষাকে কাজে লাগানোই একমাত্র উপায়।ধন্যবাদ এমন একটি বিষয় নিয়ে লেখার জন্য.! শারদীয় ও বিজয়ার শুভেচ্ছা রইলো.!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!