Shola Craft in Bangladesh শোলাশিল্প x bfa x fxyz

শোলাশিল্প | বাংলার অন্যতম লোকজ শিল্প

এত সুন্দর মালা দেখে সবাই মুগ্ধ হলেন, সেই থেকে ছেলেটির নাম হয়ে গেল মালাকার। আর তার বংশধররা হলেন মালাকার সম্প্রদায়।

SHOLA CRAFT IN BANGLADESH

বাঙালির ঐতিহ্য ও লোকজ জীবনের এক অনন্য শিল্পকর্ম শোলাশিল্প। এক সময়ের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা শোলাকে মেধা, দক্ষতা আর পরিশ্রম দিয়ে শিল্পে পরিণত করছেন শিল্পীরা। যা আজ ঐতিহ্য, সামাজিক বিবর্তন কিংবা লোক সংস্কৃতিতে, লোকশিল্পে অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে এই শোলার শিল্পকর্ম। এ শোলার শিল্পকর্ম সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই বেশি ব্যবহার করে আসছে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পূজা-পার্বণে, বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনের জন্য তৈরি শোলার মুকুট বা টোপর এবং মালার তৈরি করে আসছে ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শোলার শিল্পকর্ম তৈরি হয়। এ পেশায় নিয়োজিত কারুশিল্পীরা মালাকার বা শোলারী নামে পরিচিত। ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে তারা শিবের উপাসক।

shola craft

মালাকারদের মাঝে একটা কিংবদন্তির প্রচলন আছে—হিমালয় কন্যা পার্বতীকে বিয়ে করবার সময় মহাদেব শিব শ্বেত মুকুট পরবার ইচ্ছে পোষণ করেন। এই ইচ্ছে পোষণ থেকেই জলে জন্ম নিল একধরনের গাছ—শোলা গাছ। বিশ্বকর্মা নানান ধাতব পদার্থে গহনা গড়েন, তো চিন্তায় পড়ে গেলেন শোলার মতো নরম জিনিসে কীভাবে মুকুট গড়বেন। এ-সময় আবার শিবের ইচ্ছেয় জল থেকে এক সুকুমার যুবক উত্থিত হলেন, সেই ছেলেই শোলা থেকে শিবের বিয়ের মুকুট-মালা তৈরি করে দিলেন। এত সুন্দর মালা দেখে সবাই মুগ্ধ হলেন, সেই থেকে ছেলেটির নাম হয়ে গেল মালাকার। আর তার বংশধররা হলেন মালাকার সম্প্রদায়। এই বিশ্বাস থেকেই মালাকার পেশাজীবীরা নিজেদের পেশাকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেন।

লোকশিল্প কোন সমাজের মৌলিক সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। এর মাধ্যমে একটি জাতির আচার-আচরণ মনোভাব প্রথা সম্পর্কে গভীরভাবে জানা যায়।

শোলাশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ জেলাগুলো

বাংলাদেশের ঢাকা, মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, মাগুরা, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, হবিগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, যশোর, রংপুর, দিনাজপুর ও বরিশাল অঞ্চল শোলাশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। 

story of gopendronath chokroborti

একজন গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

শোলাশিল্প পেশায় নিয়োজিত কারুশিল্পীরা মালাকার বা শোলারী নামে পরিচিত। এরা মূলত মালাকার সম্প্রদায়ের হলেও গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নাম শুনলেই বোঝা যাচ্ছে তিনি মালাকার সম্প্রদায়ের না। তার নিষ্ঠা এবং নিখুঁত শিল্পকর্ম তাকে করেছে সন্মানিত। বর্তমানে মালাকার সম্প্রদায়ের বাইরের হয়েও শিল্পটির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি তিনি। ঝিনাইদহের কারুশিল্পের ব্রান্ডিং এর জন্য এই শোলাশিল্পী একাই প্রচারক হয়ে উঠেছেন।

জীবন-জীবিকার শুরুর দিকে তিনি ছোটখাট একটা চাকরি করতেন। চাকরির ফাকেঁ ফাকেঁ শখের বসে কোন এক মালাকার এর কাছ থেকে শোলা নিয়ে কাজ শেখা শুরু। চাকরি করলেও নেশা ছিলো শোলায়। অবসরে যাওয়ার পর থেকে তার একটাই ধ্যানজ্ঞান শোলাশিল্পে নতুন কি সৃষ্টি করা যায়।

মালাকাররা মুলত ফুল, ঝালর ইত্যাদি তৈরি করলেও গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তার শিল্পকর্মে দিয়েছেন ভিন্ন মাত্রা। শিল্পকর্মে আছে নানা প্রজাতির পাখি- যেমন, টিয়া, বক, কাকাতুয়া প্যাঁচা কিংবা হা করে থাকা খাঁজকাটা কুমির। আরো আছে প্রায় হারিয়ে যাওয়া গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, নৌকাবাইচের নৌকা, বিয়ের নৌকা এবং হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী পালকি।

গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রায় ৫০ বছর ধরে এ শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িত। শোলাশিল্পের বিভিন্ন অনিশ্চয়তা এবং সংকটের পরও তিনি এই শোলাশিল্প নিয়ে আছেন এবং সন্তানদেরও কম বেশি শিখিয়েছিলেন কিন্তু এ কাজ দিয়ে পেট চলে না বলে তাই তারা এই কাজ থেকে সরে গেছেন।  

তবে তার মতে এই শিল্প নিয়ে কাজ করায় লোকশিল্পপ্রেমী, শিক্ষত মানুষের কাছ থেকে পেয়েছেন স্বীকৃতি। তিনি বিদেশে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ২০১১ সালে সরকার তাকে জাপানে এবং চীনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সোনারগাঁয়ের কারুশিল্প মেলায় আসেন। এছাড়া জয়নুল মেলাও তাকে সমসময় দেখা যায়। এমনকি ঢাকা মের্কাস এর মত জেন-জি মেলায়ও তার আগমন সত্যিই প্রশংসনীয়।

শোলাশিল্পী গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর যোগাযোগ নাম্বার : +880 1918 524327

শোলাশিল্প

শোলাগাছ জলাশয়ে জন্মে। শোলা একটি কান্ডসর্বস্ব গাছ। কান্ডের বাইরের আবরণটা মেটে রঙের, কিন্তু ভেতরটা সাদা। আর অঞ্চলভেদে এ উদ্ভিদকে মালি শোলা ও ভাট শোলা বলে থাকে। আমাদের দেশে বর্ষাকালে জলাশয় ও নিচু জায়গায় গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ এ শোলার বংশবিস্তার ঘটে। তবে এখনও পর্যন্ত এ গুল্মজাত উদ্ভিদের কোথাও কোনো চাষাবাদ করা শুরু হয়নি। এটি বিভিন্ন ফসলের সঙ্গে আগাছা হিসেবে জন্মে থাকে।

শোলার শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে তেমন কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় তেঁতুলের বিচির তৈরি আঠা (র্তমানে অবশ্য বাজারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল আঠা ), বাঁশ, সুতা, ছুরি ও এক খন্ড পাথর বা কাঠ, কাগজ ও বিভিন্ন রং। প্রথমে ধারাল ছুরির সাহায্যে শোলাকে প্রয়োজনমতো টুকরা করা হয়। পরে ছুরি দিয়ে পাতলা করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শোলার উপর মেটে আবরন ফেলে দিয়ে সাদা একটি লম্বা লাঠির শেপ দেয়া হয়। এই লাঠি বা কান্ডের উপর দড়ি দিয়ে বেঁধে এবং ছুরির সাহায্যে নানা আকারের পাপড়ি কেটে বেলি, কদম ইত্যাদি ফুল তৈরি করা হয়। টোপর, পশুপাখি, অলঙ্কার, চালচিত্র, পটচিত্র প্রভৃতি তৈরিতে পাতলা করে কাটা শোলাকে আঠার সাহায্যে সংযুক্ত করা হয়। পরে প্রয়োজন অনুসারে তাকে বিভিন্ন আকার দেওয়া হয়। শোলাকে সংযুক্ত করতে সাধারণত নিজেরাই তেঁতুলবিচির আঠা তৈরি করে নেয়। বর্তমানে অবশ্য বাজারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল আঠাও ব্যবহার করা হয়।


আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা


শোলা দিয়ে যে সব শিল্পকর্ম তৈরী হয়

শিল্পীরা শোলা দিয়ে মালা গাঁথেন, পুজোর-ঘরসজ্জার ফুল তৈরি করেন, খেলনা, হাতপাখা, অলঙ্কার, কুমির, পালকি, গরুর গাড়ি, তাজমহল, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, ঘোড়ার গাড়ি, মাছ পশুপাখিসহ নানাকিছু শিল্প তৈরী করেন। প্রতিটি শিল্পকর্ম আকার ও কারুকাজের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। আর এইভাবে একটি বিশেষ সম্প্রদায় শোলানির্ভর হয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন।


সেরা কারুশিল্পীর পুরস্কার

২০১৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশন চার কারুশিল্পীকে দেয় সেরা কারুশিল্পীর পুরস্কার। পুরস্কার পান টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পী রাজ্জাক, ঢাকার শাঁখারীবাজারের শঙ্খশিল্পী অনুপ নাগ, কুড়িগ্রামের শোলাশিল্পী নিত্য মালাকার ও রাজশাহীর চিত্রিত পুতুল শিল্পী বিজলী রানী পাল।
 কারুশিল্পীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রবীণ বয়নশিল্পী সরত মালা চাকমা, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল এবং লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের পরিচালক রবীন্দ্র গোপ।
বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণে আয়োজিত হয়েছে কারুমেলা। মেলায় সারা দেশ থেকে শিল্পীরা তাঁদের বৈচিত্র্যময় কারুশিল্প নিয়ে এসেছিলেন। মোট স্টল ১১টি।



তথ্যসূত্র:

www.jugantor.com, শোলার শিল্পকর্ম, হাসান মাহমুদ রিপন

প্রথম আলো: চার কারুশিল্পী পেলেন পুরস্কার

সমকাল: সোনারগাঁয়ে লোকজ উৎসব 


content writer

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link