সুকান্ত বণিক : পিতল শিল্পের রেনেসা নেপথ্যে

Dhamrai Metal Crafts | 200 years of family tradition

সুকান্ত বণিক : পিতল শিল্পের রেনেসা নেপথ্যে

প্রায় ২০০ বছর ধরে তার পূর্বপুরুষেরা এ পেশার সাথে জড়িত।  তিনি  নিজেই এখন যুগপুরাতন পারিবারিক ব্যবসায়ের রথী হিসেবে এই ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

 Sukanta
Banik

এরপরেও খুড়িয়ে খুড়িয়ে লোকজ ঘরানার শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে কিছু পুরোধা ব্যক্তিত্ব, যেন হালের ক্রেজকে তারা চ্যালেঞ্জ করে ক্ষণে ক্ষণে। বাংলার লোকজ তৈজসশিল্পের ধারাকে দেশের সীমানা ডিঙিয়ে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করিয়েছেন সুকান্ত বণিক । তিনি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শিল্পী হননি। বংশপরম্পরায় শিল্পনির্মাণের শৈলী মিশে আছে তাঁর রক্তে। ধামরাইয়ের নিবাসী সুকান্ত বণিক কাঁসা-তামার শিল্পকে নতুন প্রাণ দিয়েছেন, প্রমাণ করেছেন, শিল্প-সংস্কৃতিতে বাঙালির আছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। তাঁর প্রত্যয়, ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্পকে তিনি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবেন।

প্রাদেশিক শিল্পকলার যে চর্চা হয়ে আসছিল যুগ যুগ ধরে, ব্রিটিশ শাসনের হাত ধরে ইউরোপের অনুকরণ করতে করতে কিংবা দির্ঘস্থায়ী পশ্চিমমুখীতার কারণে তাতে ছেদ পরে, কালে কালে নগরসভ্যতায় হারাতে থাকে দেশীয় বা লোকজ শিল্পের ব্যবহার এবং তা শুধু নন্দনতত্ত্বের দিক দিয়ে নয়, ব্যাবহারিক দিক দিয়েও, হারায় পাটের ব্যাগ, আসে পলিথিন, হারায় পাতার মোড়ক আসে প্লাস্টিক, হারায় কাসার বাসন আসে সস্তা এলুমিনিয়াম। একটু চটজলদি ‘নগুরে’ নাগরিক হবার আশায় আমরা আপন করেছি সস্তা অপরিবেশবাদী বিষয়গুলো হারিয়েছি আমাদের দিপ্তীকে, নিজস্বতাকে, ঐশ্বর্যকে…… এমনি অপরিনামদর্শী এক জাতি আমরা।

সুকান্ত বণিক

Story of Sukanta
Banik

সুকান্ত বণিকের নেপথ্যকথা

ঢাকার উত্তর-পশ্চিমে ৩৯ কিলোমিটার দূরে ধামরাই গ্রামে যদি যান, আপনি চিরপরিচিত রথটির বামদিকে একটি পুরানো প্রাসাদপ্রতিম বাড়ি দেখতে পাবেন যা ১০০ বছরেরও পুরানো, ওটিই “সুকান্ত’স ধামরাই মেটাল ক্রাফটস” এর কর্মক্ষেত্র। স্বত্বাধিকারী সুকান্ত বণিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে অন্য কোনো পেশায় না গিয়ে ঠিক করেন, পিতৃপুরুষের কাঁসা-পিতলকে নিয়েই এগিয়ে যাবেন। প্রায় ২০০ বছর ধরে তার পূর্বপুরুষেরা এ পেশার সাথে জড়িত।  তিনি  নিজেই এখন যুগপুরাতন পারিবারিক ব্যবসায়ের রথী হিসেবে এই ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

কিভাবে ব্যবসায় আসা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার বণিক পরিবার ধাতব শৈলীতে ছিলেন অগ্রণী। আমার প্রপিতামহ শরৎচন্দ্র বণিক এর সূচনা করে্ন এবং আমার পিতামহ সর্বমোহন বণিক এবং আমার বাবা ফণী ভূষণ বণিকের পথ ধরে, এখন আমি ২০০০ সালে পারিবারিক ব্যবসায়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলাম।“

“আমি যখন যোগ দিয়েছিলাম, তখন প্রবাসী ও বিদেশী গ্রাহকদের কাছ থেকে চাহিদা কমার কারণে ব্যবসায়টি খারাপ অবস্থায় ছিল। এটি ১৯৯৩-২০০০ অবধি স্থায়ী। এখন ব্যবসাটি আমার বাবা এবং আমি চালাচ্ছি।“

সুকান্তের কার্যালয়

প্রাসাদপ্রতীম পুরো বাড়িতে মোট সাতাশটি কক্ষ। তারমধ্যে গোটা সাতেক তামা পিতলের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত।  সাত কামরার প্রদর্শন কক্ষের দুইটির মধ্যভাগে আছে দুইটি দাবার বোর্ড, সেখানে রাজারাণি নৌকা হাতির স্থানে দখল করেছে শিব পরিবার, আরেকটিতে সৈন্য সমেত যুদ্ধবেশে রাজা। পুরো ওয়ার্কশপ ভর্তি পৌরানিক চরিত্রগণ, ফোক মোটিফের জীবজন্তু, ডোকরা আর্টের ফিগার, প্রাচীণপন্থী তৈজসপত্র, প্রদীপ ঘন্টার মতো নান্দনিক জিনিস পত্রে। শোরুমে বিভিন্ন ধরণের বৌদ্ধ, জৈন এবং হিন্দু মূর্তি, বাটি, আলংকারিক আইটেম এবং ধাতু দিয়ে তৈরি পাত্রগুলি প্রদর্শিত। বেচা বিক্রির কথা জিজ্ঞেস করলে সুকান্ত বণিক জানান বাজারে চলছে দীর্ঘমেয়াদী মন্দা। তবে হাল ছাড়ার পাত্র নন তিনি। পিতৃপুরুষের কাঁসা-পিতলই  তাঁর পেশা, নেশা ও ধ্যান। বাঙলার সেই ঐতিহ্যগত নিদর্শনগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চেনাতে স্ব-উদ্যোগে কাজ করে যাচ্ছে ধামরাই মেটাল ক্রাফটস। শুধুমাত্র ছবি দেখে পাল রাজাদের বানানো কাঁসা-পিতলের মূর্তি বানাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া এই কারখানা বা ওই প্রাচীন ডিজাইনের বাড়িটিতেই হবে কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্রের একটি জাদুঘর। আর সুকান্তের মূল লক্ষ্য ঐতিহ্যগত এই কাঁসা-পিতলের পণ্যগুলোকে টিকিয়ে রেখে বাঙালী প্রাচীন সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করা।

মুলত এর ক্রেতা কারা? জানা যায়, হিন্দু বিয়ের উপলক্ষ  কিংবা সৌখিন ক্রেতা। ২০০০ সালের দিকেও এখানে ছিল ২০টি কারখানা। ধীরেধীরে সব বন্ধ হয়ে গেছে। হাতেগোনা যা আছে তাও তেমন লাভের মুখ দেখছে না। চাহিদা কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রথমত জানান বিকল্প তৈরী হওয়া। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্লাস্টিক, লোহা ও স্টিলের তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হওয়ায় কাঁসা-পিতল কেনায়  ভাটা পড়েছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো রক্ষণাবেক্ষণ। তামা কাসার পণ্য পরিষ্কারের ঝক্কি নিতে চায়না অনেকেই। তাই দৃষ্টি প্রশান্তিকর হলেও একে নিত্যব্যবহার্যে রুপান্তরে অনেকেই রাজী নন।

সুকান্তের প্রাপ্তির ঝুলি

শুধু ব্যবসাই করে যাননি সুকান্ত, বেশ কিছু প্রাপ্তিও রয়েছে তার। ২০০১ সালে একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। তখন বিদেশিদের নিজের কাজ দেখানোর সুযোগ পান তিনি। ২০০২ সালে মার্কিন দূতাবাস থেকে কাঁসা-পিতলশিল্প সংরক্ষণের জন্য ১৪ হাজার ৩০০ ডলার অনুদান পান তিনি। সেই টাকায় তৈরি হয় একটি তথ্যচিত্র। ২০০৭ সালে তথ্যচিত্রটি সুইজারল্যান্ডে প্রদর্শিত হলে সাড়া পড়ে যায়। পিতল বা কাসার মুর্তি দামের দিক দিয়ে অনেক বেশী কেনো এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন ভারতের তুলনায় এখানের দাম বেশী কারণ এখানে সিঙ্গেল মোল্ড কাস্টিং করা হয় যা উপমহাদেশের অন্য কোথাও করা হয়না।

বিশ্ববাজারে ধামরাইয়ের পিতলশিল্প

বর্তমানে বিশ্ববাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও সঠিক প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাজার পাচ্ছে না এই শিল্প। শুধু নাম হলেই কি চলে? বেচা বিক্রি লাগবে না? সেটা হচ্ছে না। কারন এগুলোর মুল ক্রেতা বিদেশীরা অথচ বিদেশ নেয়া অনেক ঝামেলার। প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের পারমিশন নিতে কালঘাম ছুটে যায়। আর তাই বিদেশীরা ওপথ মাড়ান না। ভারত থেকে কিনে নেন। লোকাল বায়ারও কমে গেছে অনেক। পুরো ধামরাইতে ১০০ এরও বেশী কারখানা ছিলো। প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু ধুকে ধুকে টিকে আছে ৩ টি কারখানা পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে হারিয়ে যেতে বসা এই শিল্প বিদেশে রপ্তানীর গলার কাটা তামা কাসার পণ্যকে এন্টিক ঘোষণা করা। পুরাতাত্ত্বিক বস্তু ভেবে এর নান্দনিক মুর্তিসমুহ কাস্টমসে বাজেয়াপ্ত হবার ঘটনাও রয়েছে।

পিতল শিল্পের বর্তমান খুটিনাটি

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, “বর্তমান সময়ে কাসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার দেশে একেবারে নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র উপমহাদেশের সনাতন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ও কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষদের কাছেই বেঁচে আছে পণ্যগুলো। যে কারণে ভারত এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখে সুনাম কুড়ালেও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। কেননা ঐতিহ্যগত জিনিসপত্র যে কোন দেশের সুনাম বাড়ায়।দেশের কাঁসা-পিতল শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, কাঁসা-পিতল শিল্প বাংলাদেশ একটি রুগ্ন শিল্প না এটি একটি মৃত শিল্প।

আবারও স্বপ্ন দেখি

ধামরাইয়ের আশেপাশের গ্রামে প্রচলিত ধাতব শিল্পের প্রাচীন ঐতিহ্যটি পাল রাজবংশে ফিরে আসে (৮০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ) যখন এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিকাশ ঘটে। এই সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাস এখনও বাংলাদেশের এই মনোরম অঞ্চলে দক্ষ এবং নিবেদিত কারিগরদের দ্বারা উৎপাদিত ধাতব কারুশিল্পে প্রতিফলিত হয়। কাঁসা পিতল দিয়ে পাল রাজাদের আমলের ঐতিহাসিক মূর্তি নতুন করে নিজ উদ্যোগে তৈরি করছেন সুকান্ত বণিক। সাভারের ধামরাইয়ের দুই’শ বছরের পুরনো কারখানায় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টি মূর্তি বানানো হচ্ছে। যা বানাতে সময় লাগবে প্রায় এক বছরের বেশি।




সুকান্ত বনিক এর ফেসবুক লিঙ্ক : Sukanta Banik

সুকান্ত বনিকের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ : ধামরাই মেটাল ক্রাফটস


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Instagram did not return a 200.
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!