নকশী পিঠার নিছক গল্প
নকশী পিঠার একটা সরল এবং প্রচলিত গল্প দিয়ে শুরু করি। নরসিংদীর মেঘনা নদীর কাছে এক গ্রামে, যেখানে সকালে কুয়াশা আর বিকেলে হাওয়া মিলে এক ম্যাজিকাল দিনে এক বালিকার হাতে জন্ম নিল নকশী পিঠা। গল্পটা শুরু হলো তার দুষ্টুমি দিয়ে। সে সেদ্ধ চালের গুঁড়োর মণ্ড নিয়ে খেলছিল আর টোকায়ে পাওয়া খেজুর গাছের কাঁটা দিয়ে তাতে আঁকিবুকি করছিল। হঠাৎ দেখা গেল, সে খেলার ছলে, একটা সুন্দর নকশা বানিয়ে ফেলেছে! গোল পিঠার ওপর ফুল, লতা, পাতার ছবি। তার মা-খালারা দেখে অবাক। গ্রামের লোকজনও এসে বললো, “এটা কী? খাবার, না দেওয়ালের সাজানো জিনিস?”
তখন গ্রামের এক খালা বললেন, “এত সুন্দর জিনিস দেওয়ালে ঝুলিয়ে কী হবে? ভেজে দেখি, খাওয়া যায় কি না!” তাই তেলে ভাজা হলো, তারপর গুড়ের সিরায় ডুবিয়ে খাওয়া হলো। স্বাদ এত ভালো লাগলো যে সবাই বললো, “এ তো শিল্প আর খাবার দুটোই!” তখন থেকে এর নাম হলো ‘নকশী পিঠা’। ব্রিটিশ আমল থেকে এই নাম ছড়িয়ে গেল, আর আজও আমরা এই গল্প বলে মজা পাই। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এটি ‘নকশি পিঠা’ নামে পরিচিতি পায়। তবে শুধু নরসিংদী নয়, দেশের নানা অঞ্চলে এটি ভিন্ন নামে পরিচিত। কুমিল্লায় একে বলা হয় ‘খান্দেশা’, দিনাজপুরে ‘ফুল পিঠা’, আর ময়মনসিংহে কিছু জায়গায় এর নাম ‘মছমছিয়া পিঠা’।
Nakshi Pitha, a form of traditional folk art
নকশী পিঠা এক প্রকার লোকশিল্প
নকশী পিঠা শুধু খাবার নয়, এটি একটি লোকশিল্প। এটি মেয়েলি শিল্প নামেও পরিচিত। বাঙালি নারীদের হাতের এই শিল্পকর্ম আলপনার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যেমন আলপনায় ফুল, লতা, পশু-পাখির ছবি আঁকা হয়, তেমনি নকশী পিঠার নকশাতেও এসব উঠে আসে। এটি তৈরির পেছনে যে ধৈর্য আর নিষ্ঠা লাগে, তা এই পিঠাকে আরও মূল্যবান করে তোলে। গ্রামে গ্রামে এটি মেয়েলি ব্রতের অংশ হিসেবেও দেখা যায়, যেখানে নারীরা তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে এটি বেছে নিয়েছেন। নকশী পিঠার এই ঐতিহ্য কেবল গ্রামেই সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক রন্ধনশিল্পীরাও এই পিঠার সঙ্গে তাদের সৃষ্টিশীলতার মেলবন্ধন ঘটাচ্ছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, এমনকি আন্তর্জাতিক ফুড ফেস্টিভ্যালেও নকশি পিঠা জায়গা করে নিচ্ছে।
নকশী পিঠার প্রস্তুতির কৌশল ও সংরক্ষণ
নকশী পিঠার একটা মজার বৈশিষ্ট্য হলো, এটাকে দুইবার ভাজতে হয়। প্রথমবার ভেজে মাসের পর মাস রেখে দেয়া যায়। দ্বিতীয়বার ভাজে গুড়ের সিরায় ডুবিয়ে গরম গরম পরিবেশন করা যায়। বলা যায় “এটা পিঠার জগতের ‘টু-ইন-ওয়ান সমাধান’—স্টোরেজ আর স্বাদ দুটোই পাওয়া যায়!”
নকশী পিঠা তৈরির প্রক্রিয়া অনন্য। চালের গুঁড়ো বা ময়দা সেদ্ধ করে কাই তৈরি করা হয়, তারপর তা বেলে পুরু রুটির আকার দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় আসল কাজ—নকশা তৈরি। নকশা তুলতে খেজুর বা বেলের কাঁটা, বাঁশের চাছ কিংবা হাতের দক্ষতাই যথেষ্ট। ফুল, লতা, পশু-পাখি, এমনকি বাংলা হরফ পর্যন্ত দেখা যায় এই পিঠার নকশায়। নকশা করা হয়ে গেলে প্রথমবার হালকা ভেজে রাখা হয়, যা দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য। আর খাওয়ার আগে এটি আবার ভেজে লালচে ব্রাউন আকার ধারন করলে গুড়ের বা চিনির সিরায় ডুবিয়ে গরম গরম কিংবা ঠান্ডা করেও খাওয়া যায়।
হাতের পরিবর্তে ছাঁচের সাহায্যেও পিঠাকে নকশাযুক্ত করা যায়। ছাঁচগুলি সাধারণত মাটি, পাথর, কাঠ বা ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি। এসব ছাঁচের ভিতরের দিকে গাছ, ফুল, লতা, পাতা, মাছ, পাখি প্রভৃতির নকশা অঙ্কিত থাকে। জনপ্রিয় কিছু মোটিফ, যেমন পদ্ম, বৃত্ত ইত্যাদিও পিঠার নকশায় ব্যবহূত হয়। এছাড়া কখনও কখনও নকশি পিঠার গায়ে ‘শুভ বিবাহ’, ‘গায়ে হলুদ’, ‘সুখে থেকো’, ‘মনে রেখো’, ‘কে তুমি’, ‘ভুলোনা আমায়’ প্রভৃতি লেখার ছাপ দেওয়া হয়।

অঞ্চল ভিত্তিক নকশী পিঠার নামকরণ নিয়ে তো আরেক মজার ব্যাপার। বিভিন্ন অঞ্চলে নকশী পিঠার নামও আলাদা। গাজীপুর ও নরসিংদীতে এটি ‘নকশী পিঠা’, কুমিল্লায় ‘খান্দেশা’, রংপুর-দিনাজপুরে ‘ফুল পিঠা’, আর ময়মনসিংহে ‘মছমছিয়া পিঠা’। আমার ধারণা, এই নামগুলো শুনলে মনে হবে যেন পিঠার জগতে একটা ফ্যাশন শো চলছে! এই বৈচিত্র্য প্রমাণ করে যে, নকশী পিঠা শুধু একটি খাবার নয়, এটি স্থানীয় সংস্কৃতির একটি অংশ।
আপনার একটি শেয়ার এবং মন্তব্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️







Traditional Pithas part of life and culture of Bengali people
বাংলাদেশি সেরা দশ পিঠা
হাতের কাঁকন দিয়ে কেনা দাসী কাঁকনমালার কূটবুদ্ধিতে পরাজিত হলে রাণী কাঞ্চনমালার জীবনে নামে ঘোর অন্ধকার, কষ্ট। কিন্তু পাটরানির আভিজাত্য তো আর চলে যায়নি! হারানো সম্মান ফিরে পেতে অনেক চেষ্টাই করেছিলো এই কাঞ্চনমালা। শেষে এক সুতাওয়ালার সাহায্যে চন্দ্রপুলী, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী পিঠা বানিয়ে কাঞ্চনমালা প্রমাণ করেন যে তিনিই প্রকৃত রাণী! ঐতিহ্যবাহী পিঠা মূলত বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশি সেরা দশ পিঠা নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন এই লিংকে –
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া

প্রাদা কিনছে ভার্সাচি: দুই আইকনের একত্রীকরণ
bdfashion archive
তেহারী ঘর: এক প্লেট নস্টালজিয়া
fayze hassanতেহারী ঘর: ঐতিহ্যের স্বাদে একটি অনন্য অভিজ্ঞতা যদি কখনো সোবহানবাগের পথে যান, তেহারী ঘরে একবার…

আড়াই হাত থেকে বারো হাত: গামছা -র ফ্যাশন বিবর্তন
fayze hassan
হোগলাপাতা: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প
fayze hassan
নারিকেলের মালা: বর্জ্য থেকে বর্তমানের গল্প
fayze hassan