coconut shell craft of Bangladesh নারিকেলের মালা হস্তশিল্প x bfa x fxyz V2

By products

নারিকেলের মালা: বর্জ্য থেকে বর্তমানের গল্প

পরিত্যাক্ত নারিকেলের মালা—যা একসময় বর্জ্য হিসেবে গণ্য হতো, আজ তা কারিগরদের হাতে রূপান্তরিত হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ও নান্দনিক হস্তশিল্পে।

STORY OF
coconut shell

নারিকেলের মালা:
আমার গল্প এবং শিল্প ধারনা

নারিকেলের মালার ( বরিশালে নারিকেলের আইচা নামে পরিচিত) শোপিসের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল যখন আমি ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি—বয়সটা ১৩-১৪ হবে। বরিশালে বৈশাখী মেলার ভিড়ে ঘুরছি, হঠাৎ একটা স্টলের সামনে পা আটকে যায়। স্টলের নামটা মনে নেই, কিন্তু যা দেখলাম, সেটা আমার মাথায় গেঁথে গেছে। নারিকেলের মালা দিয়ে বানানো কুড়ে ঘর, নারিকেলের মালার ভিতর গ্রামের দৃশ্য, ফুলদানি, গহনা, ল্যাম্প শেড—একেকটা জিনিস যেন চোখের সামনে জাদু ফুটিয়ে তুলছিল। “এটাও কী সম্ভব?” কেন এত অবাক হলাম? কারণ, আমার মাথায় এই আইডিয়া আগেও ঘুরেছে। বাসায় দেখেছি, ডাল-উঠানোর জন্য নারিকেলের মালা দিয়ে চামচ বানানো (উড়ি টাইপ কিছু একটা নামে ডাকা হত) , লবণ তুলছে নারিকেলের আইচা দিয়ে। এমনকি আমি নিজেও একবার শিক গরম করে মালায় ফুটো করে একটা কাঁচা-পাকা ল্যাম্প শেড বানিয়েছিলাম—যদিও সেটা দেখতে বেশি হাস্যকর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মেলায় যা দেখলাম, সেটা ছিল অন্য লেভেল—যেন কেউ আমার ছোট ছোট ভাবনা গুলো বাস্তবে দেখা যাচ্ছে।

মুগ্ধতা থেকে কৌতূহল জাগল। স্টলের লোকদের কাছ থেকে কারখানার ঠিকানা জোগাড় করলাম—“হাসিনা কুটির শিল্প”। একদিন দুপুরে, সাইকেলে প্যাডেল ঠেলে সেখানে হাজির। গিয়ে দেখি একটা ছোট্ট ঘর, চারপাশে নারিকেলের আইচার পাহাড়। এক কোণে কাটার মেশিন গর্জাচ্ছে, ধুলো উড়ছে, আর কয়েকজন কর্মী হাতে হ্যাকসো ব্লেড নিয়ে মালা কাটছে। গন্ধটা ছিল কাঠ আর নারিকেল মেশানো, একদম আপন আপন। মনে হচ্ছিল, আমি এখানে বসে পড়ি আর এদের সাথে কাটাকাটি শুরু করি। মালিকের সাথে দুয়েকটা কথা হলো—কী বলেছিলাম, ভুলে গেছি। তবে তিনি আমার হাতে কিছু ভাঙা শোপিসের টুকরো ধরিয়ে দিলেন, টাকা নিলেন না। ফেরার পথে একটা হ্যাকসো ব্লেড কিনে ফেললাম—ভাবলাম, বাড়ি গিয়ে কিছু একটা বানাবই। কী বানিয়েছিলাম, সেটা মনে নেই, তবে হাত কেটে ফেলার ভয়ে কাটাকাটি বেশি দূর এগোয়নি।

স্টলে আরেকটা জিনিস চোখে পড়েছিল। আমার থেকে দুই-তিন বছরের বড় একটা ছেলে, আরিফ নাম তার। কারখানায় গিয়েও তার সাথে দেখা। পরে জানলাম, সে মালিকের ছেলে। তারপর অনেক গুলো বছর কেটে গেল। ২০১২/১৩ সালের কথা, তখন আমি কালের স্রোতে আড়ং-এ ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করি। একদিন আড়ং-এ অফিসে হঠাৎ আরিফ ভাইকে দেখি। ১৫-২০ বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু তার চেহারাটা মাথায় ছিল—এক নজরে চিনে ফেললাম। কথা হলো। জানলাম, “হাসিনা কুটির শিল্প” প্রায় ৩০ বছর ধরে আড়ং-এর সাথে যুক্ত। তাদের বানানো শোপিস এখন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। সেদিন বুঝলাম, আমার ছোট্ট মুগ্ধতা শুধু স্বপ্ন ছিল না—এটা একটা বড় সম্ভাবনার শুরু ছিল।

নারিকেলের মালা নিয়ে আমার ছোট্ট স্বপ্নগুলো যেন আরিফদের কারখানায় গিয়ে বাস্তব হয়ে উঠেছিল। আর এই অভিজ্ঞতার শেষে আমি যোগ করতে চাই “হাসিনা কুটির শিল্প” নিয়ে লেখা একটি আর্টিকেলের অংশ। এটি ২০১৪ সালে কালের কণ্ঠ-এ প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে মালিক আনোয়ার হোসেন মন্টুর গল্প ফুটে উঠেছে আর কিছু তথ্য আরিফ ভাইয়ের কাছ থেকে জানা।

প্রকৃতির উপহার থেকে সৃজনশীলতার উৎস

প্রকৃতি আমাদের কাছে এমন একটি ভাণ্ডার, যেখান থেকে আমরা শুধু জীবনধারণের উপকরণই পাই না, বরং সৃজনশীলতার অফুরন্ত অনুপ্রেরণাও পাই। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সেই সাধারণ জিনিসগুলো, যেগুলো আমরা প্রায়ই অবহেলায় ফেলে দিই, সেগুলোই কখনো কখনো নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। এরই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো পরিত্যাক্ত নারিকেলের মালা—যা একসময় বর্জ্য হিসেবে গণ্য হতো, আজ তা কারিগরদের হাতে রূপান্তরিত হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ও নান্দনিক হস্তশিল্পে। এই গল্প শুধু শিল্পের নয়, বরং প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতা, সৃজনশীলতা এবং মানুষের জীবনে নতুন আশারও।

coconut shell craft নারিকেলের মালা x bfa

নারিকেলের মালা:
একটি অবহেলিত উপাদান

নারিকেল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর জল আমাদের তৃষ্ণা মেটায়, শাঁস আমাদের খাবারে স্বাদ যোগ করে, আর তেল আমাদের রান্নাঘর থেকে শুরু করে ত্বকের যত্নে কাজে লাগে। কিন্তু নারিকেলের মালা? ইংরেজি নাম কোকোনাট শেল (coconut shell)। নারিকেলের বাই প্রোডাক্টস (By products)। অনেক দেশে ইন্ডিয়ান নাট নামেও পরিচিত। সে যাই হোক, বেশিরভাগ সময় এটি আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়, ফেলে দেওয়ার জিনিস। বাড়িতে গোটা নারিকেল এলে আমরা শাঁস বের করে খাই, আর মালাটা? অভ্যাসবশত ফেলে দিই। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, এই মালার মধ্যেও কি কোনো সম্ভাবনা লুকিয়ে নেই?

বাসার মা-বোনরা হয়তো কখনো ভাবেননি যে, এই মালা দিয়ে তিনি একটি ছোট বাটি বানিয়ে ফেলতে পারেন। এর গুণের কথা বলতে গেলে, নারিকেলের মালা শক্ত, টেকসই এবং সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। তবু আমরা এটিকে অবহেলা করি। কিন্তু যারা এর মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছেন, তারা এই পরিত্যাক্ত মালাকে রূপান্তরিত করছেন এমন সব শিল্পকর্মে, যা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি পরিবেশের জন্যও উপকারী।

পুনর্ব্যবহারের শিল্প:প্রক্রিয়া ও সৃজনশীলতা

নারিকেলের মালা থেকে হস্তশিল্প তৈরির প্রক্রিয়াটি যতটা সহজ শোনায়, ততটাই পরিশ্রম আর ধৈর্যের প্রয়োজন। প্রথমে মালাগুলো সংগ্রহ করা হয়—যেগুলো সাধারণত নারিকেল ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়। এরপর সেগুলো ভালো করে পরিষ্কার করে শুকানো হয়। শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেলে মেশিন বা হাতের সাহায্যে ঘষে মসৃণ করা হয়। এই প্রক্রিয়াজাত মালা থেকেই তৈরি হয় নানা রকমের পণ্য—গহনা, গৃহসজ্জার সামগ্রী, দেয়ালের শোপিস, এমনকি দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র।

নারিকেলের মালা দিয়ে
বৈচিত্র্যময় পণ্য

নারিকেলের মালা থেকে তৈরি পণ্যের তালিকা বিশাল। শুধু প্রয়োজনটা বুঝে কাজে লাগালেই হলো। নারিকেলের মালা থেকে তৈরি হচ্ছে:

গহনা:
মালা, ব্রেসলেট, কানের দুল—যা পরতে হালকা এবং দেখতে আকর্ষণীয়। এছাড়া আরবান সোসাইটিতে নারিকেলের মালার বাটন খুব জনপ্রিয় যা এখন বিদেশেও রপ্তানি হয়।

গৃহসজ্জা:
ফুলদানি, ল্যাম্প শেড, মোমবাতির স্ট্যান্ড, ঝুড়ি।

দৈনন্দিন ব্যবহার:
বাটি, চামচ, কলমদানি, এমনকি রান্নার পাত্র।

শোপিস:
দেয়ালে ঝোলানো ভাস্কর্য, টেবিলপিস, পাখির বাসা।

এই পণ্যগুলো শুধু সুন্দরই নয়, বরং টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব। প্লাস্টিক বা অন্যান্য দূষণকারী উপাদানের বিকল্প হিসেবে এগুলো বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে। তৈরির পর এগুলো বার্নিশ করে আরও আকর্ষণীয় ও দীর্ঘস্থায়ী করা হয়।

একটি টেকসই ভবিষ্যতের পথে

নারিকেলের মালা থেকে হস্তশিল্প তৈরির এই উদ্যোগ আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে আমরা মূল্যবান করে তুলতে পারি। এটি পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি সৃজনশীলতা ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার এক নতুন দৃষ্টান্ত। আমরা যখন প্রকৃতি থেকে সুবিধা নিচ্ছি, তখন তার সুরক্ষার দায়িত্বও আমাদের। এই ছোট্ট উদ্যোগটি প্রমাণ করে যে, একটু চিন্তা আর পরিশ্রম দিয়ে আমরা পরিবেশ ও সমাজের জন্য বড় পরিবর্তন আনতে পারি।

পরের বার যখন আপনি নারিকেলের মালা ফেলতে যাবেন, একটু থেমে ভাবুন। হয়তো এই সাধারণ জিনিসটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটি নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা। কে জানে, আপনার হাতেই হয়তো জন্ম নেবে একটি দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম, যা শুধু আপনার ঘর সাজাবে না, প্রকৃতির প্রতিও আপনার ভালোবাসার প্রমাণ রাখবে।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!