বিদায়ী শীতের পরে যখন বসন্ত বাতাস বইছিল চারিদিকে, তখন-ই হঠাৎ ইচ্ছে হল দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাচুর্যে ভরপুর উত্তরবঙ্গের নওগাঁ জেলা ঘুরে আসতে। যে ভাবা সেই কাজ, এ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে সাথে ছোট ভাই মেহেদীকে নিয়ে ঢাকা থেকে রাতের দ্রুতযান ট্রেনে চেপে সোজা চলে গেলাম সান্তাহার জংশনে। কাকডাকা হিমশীতল ভোরে নওগাঁ জেলা পুলিশ থানা মোড়ের সামনে থেকে চায়ের কাপে চুমুকের ফিল নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম মান্দা’র দিকে। সকালের ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়ক পাড়ি দেওয়ার অনুভূতি ছিল মন ভোলানো। ঘন্টা দেড়েক পর পৌঁছে গেলাম প্রাচীন কারুকাজ ও অনন্য শিল্পছোঁয়া মন্ডিত বরেন্দ্র বাংলার বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ -এ।
মসজিদের বর্ণনা
৪৫৮ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে নওগাঁর মান্দা উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ। স্বচ্ছ সলিলা দিঘির পশ্চিম পাড়ে ধূসর বর্ণের এই কুসুম্বা মসজিদ, যা জেলার ইতিহাস ও মুসলিম ঐতিহ্যের উজ্জ্বল নিদর্শন। মসজিদসংলগ্ন উত্তর-দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৭৭ বিঘা বিশিষ্ট একটি বিশাল দিঘি। গ্রামবাসী ও মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল ও অজুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এ দিঘিটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
এর পাড়েই তৈরি করা হয়েছে কুসুম্বা মসজিদ। কুসুম্বা মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা, চওড়া ৪২ ফুট। চারদিকের দেয়াল ৬ ফুট পুরু। মসজিদের সামনের দিকে রয়েছে তিনটি দরজা। দরজাগুলো খিলানযুক্ত মেহরাব আকৃতির। মসজিদের চার কোনায় রয়েছে চারটি মিনার। মিনারগুলো মসজিদের দেয়াল পর্যন্ত উঁচু ও আট কোনাকার। ছাদের ওপর রয়েছে ছয়টি গুম্বজ।
১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে তিনটি গুম্বজ নষ্ট হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পরে মসজিদটি সংস্কার করে। মসজিদের ভিতরে রয়েছে দুটি পিলার। উত্তর দিকের মেহরাবের সামনে পাথরের পিলারের ওপর তৈরি করা হয়েছিল একটি দোতলা ঘর। এ ঘরটিকে বলা হতো জেনান গ্যালারি বা মহিলাদের নামাজের ঘর।
এখানে মহিলারা নামাজ পড়তেন। মসজিদের ভিতরে পশ্চিমের দেয়ালে রয়েছে তিনটি চমৎকার মেহরাবের ওপর ঝুলন্ত শিকল, ফুল ও লতাপাতার কারুকার্য। মসজিদের সামনের ভাগে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ ও পাথর বসানো সিঁড়ি, যা দিঘিতে গিয়ে নেমেছে।
মসজিদের উত্তর দিক ঘেঁষে উঠেছে এক বিশাল আকারের তেঁতুল গাছ। প্রবেশপথের একটু দূরে বাক্স আকৃতির একখণ্ড কালো পাথর দেখা যায়। একে অনেকে শিশুর কবর বলে মনে করেন।
মসজিদের ইতিহাস
জানা যায়, জনৈক কৃষক হালচাষের সময় তার জমিতে পাথরটির সন্ধান পান। সম্ভবত তার প্রচেষ্টায় জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়েছে। এ পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবি লিপি রয়েছে। আল মালিকু মা হুমম মোকাররামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন। অর্থাৎ তিনি শাসক যিনি পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হোসেনের ছেলে আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ। এ থেকে বোঝা যায় প্রস্তুরখণ্ডটি হুসেন শাহের স্মৃতিবিজড়িত। ইতিহাসবিদদের মতে, কুসুম্বা মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যকলার এক অনুপম নিদর্শন। সবরখান বা সোলায়মান নামে ধর্মান্তরিত এক মুসলিম মসজিদটি নির্মাণ করেন। মূল প্রবেশপথে শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় এ মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি বা ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দিন বাহাদুরের শাসনামলে (১৫৫৪-১৫৬০) নির্মিত। সে হিসাবে মসজিদটির বর্তমান বয়স ৪৬৪ বছর। কেন্দ্রীয় মেহরাবের ওপরাংশ শেরশাহের শাসনামলে নির্মিত।
রাজশাহী জেলা পরিষদের ওভারশিয়ার সুরেন্দ্র মোহন চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কুসুম্বা গ্রামের প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি শিলালিপি আবিষ্কার করেন। শিলালিপিটি বর্তমানে রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে রয়েছে। এটি পাঠে জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে তার মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা রামণ দল ৯০৪ হিজরি বা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। নির্মাণকাজ শেষ কবে হয় তার সঠিক কোনো সাল বা তারিখ জানা যায়নি।
মসজিদের অবস্থান
আত্রাই নদীর পশ্চিম তীরে, নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলা থেকে ৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে মান্দা-নওগাঁ সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে এই ঐতিহাসিক মসজিদের অবস্থান।
পাঁচ টাকার নোটের মসজিদ
সাড়ে চারশ বছরের ঐতিহ্য ও স্মৃতি ধারণ করা ‘কুসুম্বা মসজিদ’ ২০১১ সালের ৯ আগস্ট বাংলাদেশের বর্তমান ৫ টাকা মূল্যমানের কাগজী নোটের পেছনে এই মসজিদটির ছবি মূদ্রণ করা হয় ।