bibi russell বিবি রাসেল designer of bangladesh x bfa x fxyz

বিবি রাসেল: এক নারীর স্বপ্ন, একটি দেশের গর্ব

কে জানত, সেই মেয়ে একদিন কাপড়ের মধ্য দিয়ে শুধু নিজের নয়, গোটা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন! বিবি রাসেল: একজন বাংলাদেশি ফ্যাশন আইকন

bibi russell

চট্টগ্রামের ছোট্ট এক মেয়ে, নাম তার বিবি। মাথাভর্তি স্বপ্ন আর জেদ – “কিছু করব।” বাবা বলতেন, “তুমি সাংবাদিক হও”; মা চাইতেন, “নিজের পায়ে দাঁড়াও।” কিন্তু বিবির মাথায় তখন রঙ, সুতো আর নকশার দুনিয়া। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে নারী অধিকার এখনও সঠিকভাবে সকলের কাছে পৌঁছায়নি সেখানে তখন কে জানত, সেই মেয়ে একদিন কাপড়ের মধ্য দিয়ে শুধু নিজের নয়, গোটা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন!

বিবি রাসেল:
একজন বাংলাদেশি
ফ্যাশন আইকন

বিবি রাসেল ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মো: মোখলেসুর রহমান এবং শামসুন নাহারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ছোটবেলায় কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর ঢাকার আজিমপুরে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে অধ্যয়ন করেন।  বিবি ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম ছিলেন। তার মা যখন তার জন্য জামা সেলাই করতেন, তখন সেগুলো নিয়ে বিবির নিজের মতো কিছু একটা দাড় করার চেষ্টা থাকত। বাবার কাছে আবদার করে দশ বছর বয়সে পাওয়া সেলাই মেশিন দিয়ে নিজের পছন্দমতো কাপড় সেলাই করতে শুরু করেন। রান্নাঘরের হলুদ দিয়ে রঙ করা বা পুরোনো কাপড় কাটাকাটি করে নতুন কিছু তৈরি করা ছিল তার নেশা। ১৬ বছর বয়সে একদিন তার বাবার আনা একটা ম্যাগাজিনের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল ডিজাইনার কোকো শ্যানেলের সাথে পরিচয় হয়। তার কাজের সম্পর্কে জানতে পারে। আর সেখান থেকে অনুপ্রানিত হয়ে বিবি বাবাকে জানালেন তার স্বপ্নেন কথা – তিনি হতে চান ফ্যাশন ডিজাইনার।

১৯৭২ সাল, যখন ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের নাম শুনলেই অনেকেই বলত, “ওরে, এ আবার কোন পাগলামি?”, তখন বিবি ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলেন লন্ডন। বাংলাদেশি মেয়ে, লন্ডন কলেজ অফ ফ্যাশনে। চারপাশের সবাই তখন অবাক। লন্ডন কলেজ অফ ফ্যাশনে ভর্তি হওয়ার ছ’মাস আগেই চলে যান, কিন্তু ইংরেজি পাঠ্যক্রমের সার্টিফিকেট না থাকায় তার ভর্তির সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। প্রতিদিন কলেজ অফিসে ফোন দিয়ে নিজের আগ্রহ প্রকাশ করেন। অবশেষে মৌখিক পরীক্ষার সুযোগ পান। সেখানে বাংলাদেশের পোশাক ও ফ্যাশনের মৌলিক ধারণা উপস্থাপন করে নজর কাড়েন। তাকে অতিরিক্ত ক্লাসের শর্তে ভর্তি করা হয়।

লন্ডনে পড়ার দিনগুলো ছিল কঠিন। প্রতিদিন ভোর চারটায় উঠে ক্লাসের প্রস্তুতি নিতে হতো। পড়ালেখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক চাপ সামলাতে চিঠি বিলির কাজ করতেন। এসব কষ্টের কথা কখনো দেশে বাবা-মাকে জানাননি। তার অধ্যবসায় তাকে শুধু লন্ডন কলেজে স্নাতক ডিগ্রিধারীই করেনি, বরং তার মডেলিং ক্যারিয়ারেও নিয়ে যায়।

১৯৭৫ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর বিখ্যাত মডেল এজেন্ট ল্যারেইন এশটনের মাধ্যমে মডেলিং শুরু করেন। প্রথম কাজ ছিল ইতালীয় ডিজাইনার ভ্যালেন্তিনোর সাথে, এবং তারপর হারপার’স বাজারের জন্য মডেলিং করেন। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতা, তামাটে রঙ, লম্বা চুল, আর প্রাচ্যের সংস্কৃতির ছোঁয়া তাকে আলাদা করে তোলে। টয়োটা, জাগুয়ারের মতো ব্র্যান্ডের জন্যও কাজ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে, নিজের তৈরি পোশাকে যখন ক্যাটওয়াকে উঠলেন, দর্শকরা একবাক্যে বলল, “ব্রিলিয়ান্ট!” এরপর তো আর পেছনে তাকানো হয়নি। ভোগ, হারপার’স বাজার, কসমোপলিটন – এমন কোনো ম্যাগাজিন নেই, যেখানে বিবি রাসেলের নাম ওঠেনি। কোকো শ্যানেল, ইভস সেন্ট লরেন্ট থেকে শুরু করে বিএমডব্লিউ পর্যন্ত সবার সঙ্গেই কাজ করলেন তিনি। কাজের প্রতি আগ্রহ এবং নিজেকে নিত্যনতুনভাবে আবিষ্কার করার নেশা তাকে অনন্য করে তোলে। একবার একটি শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের জন্য উঁচু জাম্পবোর্ড থেকে লাফ দেওয়ার প্রয়োজন হলে, টানা ১০ দিন অনুশীলন করেন।

bibi russell বিবি রাসেল

ছবি সূত্র: Bibi Russel facebook page

বিবির দেশের প্রতি ভালোবাসা
.

কিন্তু বিদেশি মঞ্চের আলো, খ্যাতি আর বিলাসিতা কিছুই বিবিকে আটকে রাখতে পারেনি। ১৯৯৪ সালে তিনি ফিরে এলেন বাংলাদেশে। কারণ একটাই, দেশের তাঁতিদের নিয়ে কাজ করতে হবে, দেশের জন্য কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্যাটওয়াক ছেড়ে বিবি গ্রামের তাঁতিদের কাছাকাছি চলে এলেন। সুতির কাপড়, খাদি, গামছা – এসব দিয়ে এমন ডিজাইন শুরু করলেন যে, বিশ্ব তাকিয়ে থাকল।

একবার প্যারিসের এক প্রদর্শনীতে তার পোশাক এত জনপ্রিয় হলো যে, তিরিশ হাজার বাংলাদেশি তাঁতির কর্মসংস্থান হয়ে গেল। গামছা দিয়ে ব্যাগ আর পোশাক বানিয়ে বিবি এমনকি ফ্যাশনের সংজ্ঞাই পাল্টে দিলেন। কেউ একজন প্রশ্ন করেছিল, “গামছা দিয়ে ফ্যাশন হয় নাকি?” বিবি উত্তরে বললেন, “আমার কাছে স্রেফ সুতার টুকরাও শিল্প।”

তার কাজ শুধু ফ্যাশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন – সব কিছুতেই তার ছাপ। একবার কম্বোডিয়ায় এইচআইভি পজিটিভ নারীদের নিয়ে কাজ করলেন। আবার স্পেনে বন্দি নারীদের জন্য ডিজাইন করলেন ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’।

বিবি রাসেলের ঝুলিতে পুরস্কারের অভাব নেই। ইউনেসকো তাকে ‘ডিজাইনার ফর ডেভেলপমেন্ট’ খেতাব দিয়েছে। লন্ডনের এল ম্যাগাজিন তাকে ঘোষণা করেছে ‘উইমেন অব দ্য ইয়ার’। এমনকি তিনি জাতিসংঘের শান্তি পুরস্কারও পেয়েছেন।

তবে সব পুরস্কারের ওপরে তার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো বাংলাদেশি তাঁতিদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরা। আজ বিদেশিরা যখন খাদি আর গামছা কিনতে ব্যস্ত, তখন আমরা গর্ব করে বলি, “এই কাজটি বিবি আপার।”

বিবি প্রোডাকশন

দেশে ফিরে ১৯৯৪ সালে বিবি রাসেল তার প্রতিষ্ঠান ‘বিবি প্রোডাকশন’ চালু করেন। তিনি খাদি ও অন্যান্য দেশীয় কাপড়কে বৈশ্বিক মঞ্চে উপস্থাপন করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশি তাঁতিদের কাজের আন্তর্জাতিক চাহিদা বৃদ্ধি পায়। গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা

বিবি রাসেল দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন।

১৯৯৭: এল ম্যাগাজিন কর্তৃক ‘উইমেন অফ দি ইয়ার’।

১৯৯৯: লন্ডন ইনস্টিটিউট থেকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ।
ইউনেস্কো: ‘বিশেষ শুভেচ্ছা দূত: ডিজাইনার ফর ডেভেলপমেন্ট’ খেতাব।

২০১০ সালের সেরা চলচ্চিত্র ‘মনের মানুষ’-এর পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার জিতে নেন।

২০১১: ‘আরবান এঞ্জেল অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘ভিশন অ্যাওয়ার্ড-২০১১’।

নারী দিবস ২০১৩: এশিয়ার একমাত্র ডিজাইনার হিসেবে বিশ্বসেরা ১০ নারী ফ্যাশন ডিজাইনারের তালিকায় স্থান পান।

২০১৫ সালে নারী জাগরণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিবি রাসেলকে বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত করেন।


তিনি জাতিসংঘের শান্তি পুরস্কার এবং স্বাধীনতাপদকসহ আরও অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।



July 6, 2021

বেগম রোকেয়া পদক ২০১৫

bdfashion archive

বেগম রোকেয়া পদক নারী জাগরণের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবিস্মরণীয় অবদান স্বীকৃতি উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারের একটি…

July 6, 2021

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!