rickshaw art রিকশা আর্ট Bangladesh x bfa x fxyz web

রিকশার বাইরে রিকশা আর্ট – পণ্যের পসরায়, ফ্যাশনে ও যাপনে

শিল্প কীভাবে পণ্য হয়ে ওঠে? এর উত্তরটা লেখা আছে পুঁজিবাদের হালখাতায়। ভোগবাদের মধ্য দিয়ে আমরা ভ্যান গখের স্টারি নাইট হোক বা যামিনী রায়ের আঁকা ছবি, সবকিছুকেই নতুনভাবে বিক্রির একটা চিন্তা করি।

ও সখিনা
গেসস কী না
ভুইলা আমারে
আমি এখন রিকশা চালাই
ঢাকা শহরে…

জনপ্রিয় এই গানের ভাষ্যে সখিনা তার সেই প্রিয়জনকে ভুলে যাক বা না যাক, ঢাকা শহরে থেকে আর যাই হোক রিকশাকে ভুলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ঢাকা শহর রিকশার শহর। এ শহরের অলিগলি, রাজপথে ঘুরে বেড়ায় সারি সারি রিকশা– আর তাতে চড়ে বেড়াই আমরা, সাথে নিয়ে নাগরিক জীবনের শত ঝুটঝামেলা। গল্পের মতো ইস্কুলবাড়ি, প্রথম প্রেমের মতো সাহসী হয়ে বসা পাশাপাশি ক্ষণ, অফিসের গন্তব্যে একটু দরাদরি করে কারো কারো প্রতিদিন চড়ে বসা- এই শহরের প্রতিটি মানুষের জীবনের বিন্দু থেকে প্রসারিত হয়ে উঠতে থাকা জীবনের প্রতি পরতে পরতে রিকশা লেগে আছে। সে নিছক কোনো বাহন নয়, আরও বেশি কিছু। তবে এই গল্পটা রিকশার চেয়েও, রিকশায় সেঁটে থাকা এক চিত্রিত গল্পের। যে গল্পে শাবানা রাজ্জাক জসিম সালমান শাহ রুবেল মৌসুমীরা এক্সপ্রেশন নিয়ে থাকতেন, বাহারি সব পশুপাখি ঝলমল করে উঠতো, কিংবা আল্পনার মতো কল্পনার কোনো ডিজাইনের সাথে লেখা থাকতো চিত্তাকর্ষক কোনো সংলাপ বা বাণী। হ্যা, রিকশা আর্ট -এর কথাই বলছি, এখন বেশ খানিকটা কমে গেলেও যার আলাপ ইদানীং রিকশার ঘেরাটোপের বাইরে বেশ প্রাসঙ্গিক।

দুপুরের তপ্ত রোদ কিংবা রাতের আলো-আঁধারি সিগন্যালে প্রায় প্রতিটি রিকশার পেছনে দেখা যায় রিকশাচিত্র। রিকশাচালকদের বিশ্রামের জায়গা, তাদের রুটিরুজির পথ বাতলে দেওয়া এই রিকশা। তাদের ঘামের সঙ্গে জুড়ে থাকা রোদ ঝলসানো এই আর্টগুলো একটা সময় শুধু রিকশার পেছনেই দেখা যেত। রিকশামালিকের বাহনটিকে নিজের করে তুলে ধরার একটা খায়েশ, জ্যামে আটকে থাকা মানুষজনের চোখের এক ঝলক আর আলোকচিত্রীদের পছন্দের সাবজেক্ট হিসেবে থাকা এই রিকশা কবে যে রাস্তার ক্যানভাস ছেড়ে আমাদের ঘরদোর, এমনকি স্টাইলেরও অংশ হয়ে উঠল– তা গত বেশ কিছু বছরের পথ পরিক্রমা হিসেবে দেখা যায়।

সময়ের সঙ্গে বদলায় ফ্যাশন, ফ্যাশনের ভাষা, রঙ, চিত্র। আর সেই বদলে যাওয়া ফ্যাশনের একটা বড়সড় অংশ হিসেবে রিকশা আর্ট নিজের অন্য একটি জায়গা করে নিয়েছে। সেটি নামে রিকশার শিল্প হলেও এখন তা বহুমাত্রিক। রিকশা আর্ট যারা করেন, তারা বহু বছর ধরেই কম মজুরির কারণে আগের মতো উৎসাহ বোধ করেন না। তবে এই বহমান ঐতিহ্য বা লিভিং ট্র্যাডিশনটিকে ধরে রাখতে এগিয়ে এসেছেন বহু উদ্যোক্তা ও এনজিও সংগঠন। আর তাদের সেই পৃষ্ঠপোষকতা হোক বা চলমান ট্রেন্ডের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে রিকশা আর্টের জগত এখন শুধু সেই আয়তাকার টিনের পাতে নয়, আরো বহু স্থানে– বহু নামে।

রেস্তোরাঁর সাজে

বর্তমান সময়ে এর মূল ঠিকানায় অনেকটাই অবহেলিত এই আর্ট ফর্মটি বিভিন্ন উদ্যোগে নতুন রূপ পাচ্ছে বিভিন্ন পণ্য, দেয়ালচিত্রেও। এমনকি অনেক রেস্টুরেন্টেও রিকশা আর্টকে নতুনভাবে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এই তো সেদিন ধানমন্ডির ‘চাপ সামলাও’তে কাবাব-লুচির সঙ্গে নজর কাড়লো তাদের দেয়ালে আঁকা আমাদের পরিচিত বহু ঢালিউড তারকা।

জসিম কিংবা অঞ্জুদেরকে বড় পর্দায় দেখি না বহুদিন। তবে শহুরে এই রেস্তোরাঁর দেয়ালে ফুটে ওঠা রিকশা পেইন্টের আদলে এই তারকাদের দেখে মনে পড়ে গেল শৈশবে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে সাপ্তাহিক সিনেমা দেখার আসর। তারা বেশ ভালোই জমিয়ে রেখেছেন কাবারের গন্ধে ম ম করা এই আঙিনাটি– দেয়াল থেকে জানান দিচ্ছেন, বেশ জোরালোভাবে বলছেন, আর কত আরাম করে বসে থাকবে, এইবার ভোগান্তির জীবনের ভালোমতো ‘চাপ সামলাও!’ এই রেস্তোরাঁর মেন্যু কার্ডেও রাখা হয়েছে জলছাপ রিকশা আর্ট। কাজেই সেই জায়গা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আউট অব দ্য বক্স আর্টের কিংবা ব্র্যান্ড স্টেটমেন্ট যুতসই জমিয়ে দেওয়াতে রিকশার পেছনের সেই বিচিত্র চিত্রাবলী বেশ শক্তিশালী বটে!  

এছাড়াও বাংলাদেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ড যাত্রা‘র শোরুমে প্রবেশ করলে, ওয়াল জুড়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এবং লোকজ সংস্কৃতির চিত্র আকা রয়েছে। বিশেষ করে, বাংলার লোকজ শিল্প যেমন পটচিত্র, নকশিকাঁথা, এবং রিকশা পেইন্টের আদল দেয়ালে দেখা যায়।

বাটা তাদের শোরুমে উইন্ডো ডিসপ্লে হিসেবে

বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি এবং শহুরে জীবনের একটি আইকনিক প্রতীক রিকশাকে তুলে ধরেছেন। এই ধরনের ডিসপ্লে ব্যবহার করে বাটা হয়তো তাদের ব্র্যান্ডের সঙ্গে স্থানীয় ঐতিহ্যকে যুক্ত করতে চেয়েছে, যা ভোক্তাদের জন্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। রিকশার উপস্থিতি শপিং অভিজ্ঞতাকে স্থানীয় এবং নস্টালজিক অনুভূতির সঙ্গে সংযুক্ত করার একটি উপায় হতে পারে।

শুভেচ্ছায়, উপহারে

যারা উপহারের বেলায় নান্দনিকতাকে সবচেয়ে উপরে রাখেন, তাদের মধ্যে অনেকেই জন্মদিন, বিয়ে বা যেকোনো উপলক্ষে হাতে খুব কম সময় থাকলে আড়ং কিংবা যাত্রা -তে এক ঢুঁ মেরে আসেন। আর বিভিন্ন উপহার পণ্যের মাঝে দেয়ালে ঝুলন্ত ফ্রেমে আঁটা রিকশা পেইন্টিং ধাঁচের ছবিগুলো এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে এগিয়ে থাকে। যাকেই উপহার দেওয়া হোক না কেন, শোবার ঘরে, বসার ঘরে, নিজের শখের কফি কর্নারে এই ছবিগুলো খুব সুন্দর মানিয়ে যায়। দামের দিক দিয়ে হাজারের কাছাকাছি মূল্যের এই ছবিগুলো বেশ ট্রেন্ডিও বটে। অবশ্য শুধু ছবিই নয়, রিকশা পেইন্টিংয়ের আদলে তৈরি কাগজের ফ্রেমে বাঁধানো আয়নাগুলোও এক্ষেত্রে নজর কাড়ে। তাইতো হাতব্যাগ থেকে বের করে টুক করে সাজটা দেখে নেয়া যায়, এমন ছোটখাটো আয়নাগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় লাল-হলদে, নীল-সবুজ রঙের ঔজ্জ্বল্যে মাখামাখি রিকশা আর্ট ফ্রেম।

রিকশা আর্ট rickshaw art x bfa x fxyz

বাহারি পণ্যের পসরা

রিকশা আর্ট এখন আর শুধু রিকশার পেছনে নয়। আছে আমাদের নিত্য ব্যবহৃত বহু পণ্যে। নান্দনিক ডিজাইনে সানগ্লাস, পোশাক-আশাক, চায়ের গ্লাস, সবকিছুতেই রিকশা আর্টের ছড়াছড়ি। বাদ যায়নি পায়ের জুতো, সাজগোজের অনুষঙ্গ গয়না কিংবা গয়নার বাক্স। রিকশা আর্টের মধ্যে থাকা ভাইব্রেন্ট রঙগুলোই এর চমককে ধরে রাখে সবচে বেশি। এখন পর্যন্ত তাই বোধহয় কোথাও সাদা-কালো রিকশা আর্টের দেখা পাইনি। না রিকশায়, নাইবা অন্য কোনো পণ্যের পসরায়।

এখন আমরা যেমন ভ্রমণে যাবার আগে স্যুটকেস গোছাই, একটা সময় আমাদের বাবা-মায়েরা গোছাতেন বিশাল সব ট্রাংক। সেই ট্রাংকের ব্যবহার এখন আর হয় না বললেই চলে। তবে পুরনো বহু জিনিসের মতো তা ঘরের শোভা বর্ধনে ব্যবহৃত হয়। ট্রাংকের জমিন জুড়ে আঁকা রিকশা আর্ট যে তার শোভা আরো কয়েক গুন এমনিতেই বাড়িয়ে দেয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘ফিনারি’ ব্র্যান্ডটি এর অন্য অনেক পণ্যের পাশাপাশি কাজ করছে রিকশা আর্টের নকশায় আঁকা ছোট থেকে বড় বিভিন্ন আকারের ট্রাংক নিয়েও। অনেকেই সেই ট্রাংকগুলো ব্যবহার করছেন স্টোরেজ কিংবা চায়ের টেবিল হিসেবে। চায়ের কথা বলতে মনে পড়ে গেল ফেসবুকে দেখা একখানা কেতলির কথা। রাপা প্লাজার জয়িতা হোক বা অনলাইনে ঘুরে বেড়ানো ‘ফিনারি’র পণ্য তালিকা। রিকশা চিত্রের আদলে সাজানো এসব কেতলি অনেক বেশি জনপ্রিয় উপহার হিসেবেও। আদতে চুলায় চড়ালে সেসব কেতলি কতটা কাজে লাগবে, সে নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যায় কম মানুষকেই। কার্যকারিতার চেয়ে এখানে চোখের আরামটাই বেশি প্রাধান্য পায়।
 

পোশাকের কারুকাজে

বাংলাদেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ড যাত্রা বরাবরই দেশের লোকজ সংস্কৃতি ও নান্দনিকতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করে থাকে, আর এর মধ্যে একটি অন্যতম উপাদান হলো রিকশা আর্ট। যাত্রা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে তাদের পোশাক ও অন্যান্য পণ্য ডিজাইনে স্থান দিয়ে রিকশা আর্টকে নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে আসে। যাত্রার পণ্যগুলোতে রিকসার উজ্জ্বল রঙ, মোটিফ, এবং লোকজ প্যাটার্ন ব্যবহার করে যা রিকশা আর্টের বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

এছাড়া একটি অনলাইন ব্রান্ড ‘স্বপ্নযাত্রা’ -র একটি সিগনেচার শাড়ির ছবি মাঝে মাঝেই ভেসে নিউজফিডে। জমিনের পুরোটা জুড়ে সাদার মধ্যে খেলা করছে চোখ ধাঁধানো সব রং। পাড়ের কাছ জুড়ে সুন্দর লতায় পাতায় সাজানো আঙিনা, আর ওরই মাঝে আঁচলের দিকটায় রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে দুটো ময়ূর। পেখম মেলা। মন মাতানো রঙিন খেলায় নীল, সবুজ, লাল– সব রঙই বেশ ভালো ফুটেছে সাদার কোমলতায়। শাড়িটি সুন্দর, তাতে সন্দেহ নেই। তবে এর সৌন্দর্যের চেয়েও যে বিষয়টি বেশি মন কাড়লো, তা হচ্ছে এই অতি পরিচিত আর্ট ফর্ম ও বহুবার দেখা এই একই ছবি। সেই ছোটবেলা থেকে বহু রিকশার পেছনে দুই ময়ূরের এই আসীন ভঙ্গিটি দেখে এসেছি। শাড়িখানা দেখে মনে হয় রিকশার পেছনে থাকা সেই দৃশ্যটি নিখুঁতভাবে ডিজিটাল প্রিন্টের মাধ্যমে তুলে আনা হয়েছে কাপড়ের মধ্যে। মনে মনে আরো একবার প্রযুক্তির তারিফ না করে পারলাম না।

চায়ের টং দোকানগুলোতে রিকশা পেইন্টের আদলে চিত্রায়ণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকাকে আরও নান্দনিক ও সৃজনশীল করে তুলতে আশেপাশের চায়ের টং দোকানগুলোতে রিকশা পেইন্টের আদলে চিত্রায়ণ করা হয়েছিল। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সাধারণ চায়ের দোকানগুলো পরিণত হয়েছিল একটি জীবন্ত শিল্প প্রদর্শনীতে। রিকশা পেইন্টের বর্ণিল রঙ ও চিত্রকর্মের মাধ্যমে দোকানের টেবিল, দেয়াল এবং বিভিন্ন কাঠামোতে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, যা স্থানীয় এবং বিদেশি দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত এবং তাদেরকে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রিকশা শিল্পের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিত। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকার রাস্তায় প্রচলিত রিকশা শিল্পকে তুলে ধরা এবং একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিল্পকলার প্রতি আগ্রহ বাড়ানো।

বৈশাখী উৎসবে রিকশা পেইন্ট

২০২৩ সালে রিকশা এবং রিকশা পেইন্টকে UNESCO কর্তৃক বাংলাদেশের অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই স্বীকৃতির ধারাবাহিকতায়, ২০২৪ সালের ঢাকা চারুকলার বৈশাখী উৎসবে রিকশা পেইন্টকে মূল মোটিফ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রিকশা শিল্পকে আরও বেশি মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়, যা ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানায় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিল্পকলার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

রিকশার প্রতিটি অংশে রঙিন চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তোলা হয়, যা ফুল, পশুপাখি, ঐতিহাসিক ঘটনা, জাতীয় নায়ক, সিনেমার তারকা, এবং বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়। এভাবে রিকশা শুধু একটি যানবাহন হিসেবে নয়, বরং শহরের চলমান একটি প্রদর্শনী হিসেবেও পরিগণিত হয়, যা ঢাকার জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।

এই শিল্পের গুরুত্ব কেবল ঢাকা শহরের জন্য নয়, বরং এটি একটি সার্বজনীন ঐতিহ্য যা বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়

রিকশা আর্টের ভিজ্যুয়াল ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম চারুকলার প্রাঙ্গণ

ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের প্রতি সম্মান জানাতে চট্টগ্রাম চারুকলার প্রাঙ্গণকে রিকশা আর্ট দিয়ে সাজানো হয়েছিল। এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল রিকশা আর্টের প্রতি আগ্রহ বাড়ানো এবং এর সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক গুরুত্বকে তুলে ধরা। চারুকলা প্রাঙ্গণের বিভিন্ন অংশে রিকশার পেছনের অংশে ব্যবহৃত টিনের পাতে আঁকা রঙিন মোটিফ, সিনেমার দৃশ্য, ফুল-পাতার ডিজাইন, এবং বাণীসংবলিত চিত্রগুলো শোভা পাচ্ছে।

এই শিল্পকর্মগুলো রিকশার ঐতিহ্য ও কল্পনাশক্তির প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যা মূলত ঢাকা শহরের রাস্তাগুলোতে দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে এটি একটি স্বতন্ত্র শিল্পের জায়গা দখল করেছে, এবং চট্টগ্রামের চারুকলার এই উদ্যোগের মাধ্যমে রিকশা আর্টকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষার্থী, শিল্পী, এবং সাধারণ দর্শকদের কাছে রিকশা আর্টের ভিজ্যুয়াল ঐতিহ্য এবং এর সঙ্গে জড়িত সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এটি এশিয়ার অন্যতম প্রাণবন্ত লোকশিল্পকে উদযাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে।

রিকশা আর্ট

রিকসা আর্ট আদলে নান্দনিক গ্রাফিতি।

অনাকাঙ্ক্ষিত পোস্টার লাগানো ও বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংবলিত লেখা বন্ধ করতে ঢাকায় নান্দনিকতার জায়গা থেকে ফ্লাইওভারের খুটিগুলোতে চিত্রকর্ম আঁকার উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। প্রথমে মগবাজার ফ্লাইওভারে এ কাজ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ফ্লাইওভার ও মেট্রো রেলের খুটিতেও চিত্রকর্ম করা হবে।

এর ধারাবাহিকতায় ঢাকার মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচের অংশে দৃষ্টিনন্দন 
 চিত্রকর্ম
 বা গ্রাফিতি আঁকা শুরু হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উদ্যোগে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের সহযোগিতায় বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে ২০২৩ -এ মহাখালী ফ্লাইওভারে নান্দনিক গ্রাফিতি শুরু হয়। শহরকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করতেই এই উদ্যোগ।

রিকসা আর্ট সাংহাই ফ্যাশন উইক ২০২৪ -এ

সাংহাই ফ্যাশন উইক ২০২৪-এ বাংলাদেশের ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াত আর্নি অংশগ্রহণ করে সাসটেইনেবল ফ্যাশনের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছেন। এবারের ফ্যাশন উইকের মূল থিম ছিল ‘সাসটেইনেবল হাই ফ্যাশন,’ যা আর্নির কাজের সঙ্গে গভীরভাবে মিল ছিল। তিনি জামদানি, নকশিকাঁথা, গামছা, খাদি, এবং রাজশাহী সিল্কের মতো বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাপড় ব্যবহার করে চমৎকার ডিজাইন তৈরি করেছেন।

আর্নি তার ডিজাইনগুলোতে বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন, বিশেষ করে রিকশা পেইন্টের মোটিফের মাধ্যমে। তার এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি শুধু ঐতিহ্যকে তুলে ধরেননি, বরং সমসাময়িক বিষয়ও যুক্ত করেছেন। ডিজিটাল প্রিন্টের মাধ্যমে খাদি কাপড়ে তিনি ‘জুলাই আন্দোলন’কে প্রতিফলিত করেছেন, যা সাম্প্রতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ।

এই প্রদর্শনীতে তার পোশাকগুলো পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যা টেকসই ফ্যাশনের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করে। আর্নি এই কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প ও ফ্যাশনকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ফ্যাশন শোয়ের পর তিনি পেরু, জিম্বাবুইয়ে, ইন্দোনেশিয়া সহ বেশ কিছু দেশ থেকে তার সংগ্রহ প্রদর্শনের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। এ মাসেই তার পরবর্তী শো মায়ামিতে অনুষ্ঠিত হবে।

rickshaw art x Aroj Ali Baul From Netrokona,Durgapur x bfa x fxyz

নববর্ষের মঞ্চ মাতালেন দুর্গাপুরের বাউল আরজ আলী: গ্রামীণ সুর ও আরবান ফিউশনের অপূর্ব মিলন
.

বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এ রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে আয়োজিত বিশাল কনসার্টে সুরের জাদু ছড়ালেন নেত্রকোণার দুর্গাপুরের বাউল শিল্পী আরজ আলী। জীবনে প্রথমবার এত বড় মঞ্চে গান গেয়ে তিনি যেন নিজের স্বপ্ন পূরণ করলেন।

এই কনসার্টে আরজ আলীর উপস্থিতি কেবল সঙ্গীতের কারণেই নয়, তার অনন্য পোশাকের জন্যও আলোচনায় ছিল। তিনি পরেছিলেন রিকশা আর্টের অনুপ্রেরণায় তৈরি একটি রঙিন জ্যাকেট এবং রিকশা পেইন্ট স্টাইলে ডিজাইন করা কালো চশমা। এই “আল্টা ফিউশন” পোশাক ছিল ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক নিখুঁত সমন্বয়। যদিও জ্যাকেটটির ডিজাইনার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি, তবে এটি আরজ আলীর ব্যক্তিত্ব ও পরিবেশনার সঙ্গে এতটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল যে দর্শকরা মুগ্ধ না হয়ে পারেননি। এই আউটফিটে আরজ আলী শুধু একজন শিল্পীই নন, সংস্কৃতির একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে উঠেছেন।

সুসঙ্গ দুর্গাপুরের সাদামাটির পাহাড়ের মাঝে গান গেয়ে বেড়ানো আরজ আলীর রাজধানীর মঞ্চে পৌঁছানোর গল্প যেন এক রূপকথা। একসময় নেত্রকোণার পথে-প্রান্তরে গান গাইতেন তিনি, আর আজ তিনি রীতিমতো একজন সেলিব্রেটি। পহেলা বৈশাখের এই কনসার্টে দেশের জনপ্রিয় শিল্পী ও ব্যান্ডদলের সঙ্গে একই মঞ্চে গান পরিবেশন করে তিনি দর্শকদের মন জয় করেছেন। জাহিদ নীরব ফিচারিং আরজ আলী ও রাকিব হাসানের গানে গলা মিলিয়েছেন হাজারো শ্রোতা।
এই অসাধারণ যাত্রায় আরজ আলীর পাশে বড় ভূমিকা পালন করেছেন শিল্পী রাকিব হাসান। তিনিই এই গ্রাম্য বাউলকে রাজধানীর মঞ্চে পরিচিত করেছেন। ঢাকায় একসঙ্গে গানের চর্চা, আড্ডা, আর কথার ঝড়ের মধ্য দিয়ে তাদের বন্ধন আরও গভীর হয়েছে। অবশেষে একই মঞ্চে দর্শক মাতানো তাদের এই যাত্রাকে যেন এক কাল্পনিক গল্পের মতো করে তুলেছে।

এই আয়োজনের পর আরজ আলীর মতো প্রতিভাবান শিল্পীদের জন্য আরও বড় সুযোগ তৈরি করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের মতো দেশে গ্রামীণ প্রতিভার অগাধ সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের জন্য একটি কাঠামো তৈরি করা গেলে এটি দেশের ইমেজ বিল্ডিং এবং শিল্পীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

কনসার্টের সমাপ্তিতে আরজ আলীর আবেগ তার কথায় ফুটে উঠল। তিনি বললেন, “সকলের প্রতি আমার সালাম। ভালো থাকবেন। আবার দেখা হবে।” তার কণ্ঠে ছিল কৃতজ্ঞতা ও আনন্দের মিশ্রণ। তার পরিবেশনা ছিল সঙ্গীতের শক্তির এক প্রমাণ, যা মানুষকে একত্রিত করে, অনুপ্রাণিত করে এবং সীমানা অতিক্রম করে।

আমাদের যা কিছু মনে ধরে, যা কিছু দেখে মনে হয়– সুন্দর, সুবর্ণ, তার বেশিরভাগ নকশাই আমরা গায়ে জড়িয়ে রাখতে পছন্দ করি। হোক তা পছন্দের ব্যান্ড বা তারকা, প্রিয় কোনো কবিতার লাইন। টিশার্টে, শাড়িতে যেভাবে ফেলে আসা গান-কবিতারা উঠে আসে, তেমনি আসেন যামিনী রায়। বাদ যায় না আমাদের স্কুল পালানো জীবনের ঐতিহ্যকে তুলে আনা, পাড়ার সিনেমা হলে লুকোচুরি সাক্ষাতের স্মৃতির রিকশা পেইন্টিংও। তাইতো আবহমান বাঙালি নারীর শাড়ি হোক বা ঝুটঝামেলাবিহীন কুর্তি, পাজামায়, রিকশা পেইন্টিংকে ডিজাইনাররা নিজের মতো করে ফুটিয়ে তোলেন ডিজিটাল প্রিন্টের মাধ্যমে। অনেকে হাতে তুলিও তুলে নেন, রিকশা আর্টকে ঢেলে সাজান নিজের আঁকার খাতায়। কেউবা দ্বারস্থ হন প্রকৃত রিকশাচিত্রীদের। সাধারণত রিকশা পেইন্টিং করে দিনে যত উপার্জন হতো, এই শিল্পীরা তার চেয়ে একটু বেশিই পান এই কাজগুলো করে। পেট চলে যায়, দিন কেটে যায়। নতুন নতুন রূপে আবারো শিল্প বেঁচে থাকে, সে নাহয় উপরি পাওনা।

Unesco recognizes rickshaws and rickshaw paintings in Bangladesh as intangible cultural heritage

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইউনেস্কো রিকশা আর্টকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেয় ‘ইনট্যাঞ্জিবল আর্ট’ ক্যাটাগরিতে।

বিশ্বদরবারের সাথে সাথে রিকশা আর্টের মর্ম বাঙালিও যেন আরো একবার নতুন করে বুঝতে পেরেছে। আরো নতুন করে আবিষ্কার হয়েছে এর উপযোগিতা। সে সময় অনেকেই আবারো রিকশা আর্টকে নিজের মতো করে গ্রহণ করছেন, অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ফেসবুকের কল্যাণে দেখা গিয়েছিল ‘অতিবেগুনী’ নামের একটি স্টোরিটেলিং প্ল্যাটফর্মকে রিকশা আর্টের নকশায় নিজেদের কভার ফটো দিতে। এমন করে বহু মতে, বহু পথে এই বহমান শিল্পকে চর্চার মধ্যে দিয়ে বয়ে নিয়ে, একটি নিরবচ্ছিন্ন স্রোতের মতোই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এর সাথে জড়িয়ে থাকা কারিগর ও পৃষ্ঠপোষকেরা।

আমেরিকান লেখক আর্সুলা লি গুইনের এই উক্তির লেন্সে যদি রিকশা আর্টকে ফেলি, তবে তা বোধহয় শিল্পের লাভ ও স্বাধীনতা দুটি বৈশিষ্ট্যকেই মহিমান্বিত করতে পেরেছে।

“পরিবর্তনের শুরুটা প্রায় সময়ই শিল্পে ঘটে। আর সেই শিল্পের প্রকৃত পুরস্কারটা লাভ নয়, বরং স্বাধীনতা।”

শিল্প কীভাবে পণ্য হয়ে ওঠে? এর উত্তরটা লেখা আছে পুঁজিবাদের হালখাতায়। ভোগবাদের মধ্য দিয়ে আমরা ভ্যান গখের স্টারি নাইট হোক বা যামিনী রায়ের আঁকা ছবি, সবকিছুকেই নতুনভাবে বিক্রির একটা চিন্তা করি। সেই বিক্রয়ের ক্রেতার সংখ্যাও অসংখ্য, তাই শিল্পের বাজার বেশ ভালোই ছুটে চলে। শিল্প যখন পণ্যের রূপে নিজের স্থান করে নেয়, তখন কোনো না কোনোভাবে এর মূল জায়গাটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়। তবে রিকশা আর্টের ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। বরং মুটে-মজুরের শিল্প যেন বনেদী ঘরের আঙিনায় ঢুকে পড়েছে তার চোখ ঝলসে যাওয়া রঙ আর নকশায়। এই যে অতিক্রম করার বিষয়টি, তাই যেন রিকশা আর্টকে সর্বজনের করে তুলেছে। তা সে কিছু টাকা জমিয়ে কেনা একলা ব্যাচেলরের প্রিয় চাপের কাপ-পিরিচে হোক বা জমিয়ে আড্ডা দিতে বসা তরুণ দলের ফটো সেশনের পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডে।



আরও পড়ুন

রিকশা আর্টের উত্থান: গণমানুষের ক্যানভাস থেকে এলিট শোকেসে

হরের প্রতিটি কোণায় এই বর্ণাঢ্য রিকশা আর্ট গুলো যেন এক একটা ভ্রাম্যমাণ ক্যানভাস। একটি উজ্জ্বল এবং অনন্য শিল্পরূপ

যাত্রা

রিকশা পেইন্ট নকশায় ফ্যাশন ব্রান্ড যাত্রার কালেকশন।

পুরো কালেশন এই লিংকে-
যাত্রা | Jatra-a journey into craft

Aarong
PAHELA BAISHAKH 2016 

রিকশা পেইন্ট নকশায় ২০১৬ সালে বৈশাখে বাংলাদেশের ফ্যাশন ব্রান্ড আড়ং -এর কালেকশন।

পুরো কালেশন এই লিংকে-
পোশাকে বৈশাখ | PAHELA BAISHAKH 2016

PAHELA BAISHAKH COLLECTION |

Bibiana
PAHELA BAISHAKH 2014 

রিকশা পেইন্ট নকশায় ২০১৪ সালে বৈশাখে বাংলাদেশের ফ্যাশন ব্রান্ড বিবিআনা -এর কালেকশন।

পুরো কালেশন এই লিংকে-
পোশাকে বৈশাখ | PAHELA BAISHAKH 2014

Texmart
PAHELA BAISHAKH 2016

রিকশা পেইন্ট নকশায় ২০১৬ সালে বৈশাখে বাংলাদেশের ফ্যাশন ব্রান্ড টেক্সমার্ট -এর কালেকশন।

পুরো কালেশন এই লিংকে-
পোশাকে বৈশাখ | PAHELA BAISHAKH 2016

Nipun
PAHELA BAISHAKH 2018

রিকশা পেইন্ট নকশায় ২০১৮ সালে বৈশাখে বাংলাদেশের ফ্যাশন ব্রান্ড নিপুন -এর কালেকশন

পুরো কালেশন এই লিংকে-
পোশাকে বৈশাখ | BAISHAKH COLLECTION 2018

রিকশা পেইন্ট নকশায় ।কামিজ এবং শাড়ি : Nipun । ২০১৮

রিকশা আর্ট গ্যালারি

রিকশাচিত্র শুধু একটি শিল্প নয়, এটি মানুষের সমকালীন জীবনের গল্প বলার চলমান ক্যানভাস।

রিকশা আর্ট rickshaw art x bfa x bipul (10)
রিকশা আর্ট
বাটা তাদের শোরুমে উইন্ডো ডিসপ্লে হিসেবে একটি আস্ত রিকশা বসিয়েছেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Instagram did not return a 200.
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!