shokher hari A Folk Art Piece of Bangladesh শখের হাঁড়ি x bfa x fxyz

শখের হাঁড়ি – রাজশাহীর এক নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য

জয়নুল মেলা কিংবা ঢাকা মার্কাস—দুই মেজাজের দুই ইভেন্ট। তবু দু’জায়গাতেই খুঁজে পাওয়া যায় শখের হাঁড়ি।

শখের হাঁড়ি !

শুনলেই মনে হয়, এটি যেন কোনো শখের বস্তু। আসলেই তাই। শৌখিন কাজে ব্যবহৃত হয় বলেই এর এমন নাম। এটি ব্যবহারিক জিনিস হলেও, এর সৌন্দর্য ও শৈল্পিকতার কারণে এর নামেই জড়িয়ে আছে মুগ্ধতা।

শখের হাঁড়ি
মৃৎশিল্পের একটি শাখা
.

জয়নুল মেলা কিংবা ঢাকা মার্কাস—দুই মেজাজের দুই ইভেন্ট। তবু দু’জায়গাতেই খুঁজে পাওয়া যায় শেকড়ের গল্প। মাটির সেই ঘ্রাণ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের সেতু হয়ে কাজ করে। কখনো জয়নুল মেলা বা ঢাকা মার্কাসের মার্কেটপ্লেসে গিয়ে কি রঙিন সিকায় সাজানো রঙিন হাঁড়িগুলো দেখেছেন? সেগুলো আপনাকে কাছে টানবে, ছুঁড়ে দেবে প্রশ্ন—এই হাঁড়িগুলো শুধু পাত্র নয়, বরং একেকটি গল্প বলছে। বলছি রাজশাহীর শখের হাঁড়ির কথা। এটি শুধু মাটি আর রঙের খেলা নয়; এটি বাংলার সংস্কৃতির এক অপূর্ব অভিব্যক্তি। এবারের বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর আয়োজনে ঢাকার চারুকলার বাইরে দেয়ালচিত্রে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাড়ির মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। যা আমাদের লোকশিল্পের ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রয়াস। এই বৈশাখে নতুন রূপে ফুটে উঠেছে আমাদের শিকড়ের গল্প যা আনন্দ শোভাযাত্রার নামের পুনঃউদ্ধারও আমাদের শিকড়ের সাথে গভীর সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

শখের হাঁড়ি মৃৎশিল্পের একটি শাখা। বিশেষ শৈল্পিক উদ্দেশে মাটির হাঁড়িতে চিত্রিত লোকশিল্প। রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের জীবনের সঙ্গে এ মৃৎশিল্প গভীরভাবে জড়িত। শখের হাঁড়ি শুধু শৈল্পিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে না, এটি এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। চলুন, এই অনন্য শিল্পের ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য, ও প্রাসঙ্গিকতার দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করি।

শখের হাঁড়ি
নামের উৎপত্তি
শখের হাঁড়ি

বাংলার মানুষ এই হাঁড়িকে শুধু ব্যবহারযোগ্য পাত্র হিসেবে নয়, বরং শৌখিনতার প্রতীক হিসেবেই দেখেছে। আর এখান থেকেই এর নাম—শখের হাঁড়ি।


এটি দৈনন্দিন ব্যবহারিক পাত্র হলেও শৈল্পিক নকশা ও রঙের কারণে এর নামকরণে শৌখিনতার ছাপ স্পষ্ট। প্রাচীন সভ্যতায় যেমন হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে ধূসর রঙিন মৃৎপাত্র পাওয়া যায়, যা এক প্রকার শখের হাঁড়ি। ১৪০৬ সালে চীনা পর্যটক মা-হুয়ানের ভ্রমণসাহিত্যে প্রথম এই শখের হাঁড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়।


শৌখিন জিনিস হলেও প্রাত্যহিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা ছিল অনস্বীকার্য। মূলত খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ ও পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হতো চিত্রিত শখের হাঁড়ি। রান্না বা শোবার ঘরের চালে পাটের তৈরি শিকায় ঝুলিয়ে রাখা হতো এ হাঁড়ি। তাতে রাখা হতো বিভিন্ন ধরনের খাবার। এ ছাড়া নতুন আত্মীয়ের বাড়িতে মিষ্টি ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য উপহার হিসেবে নিয়ে যাওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হতো এটি।

ঘরের চালে পাটের তৈরি শিকায় ঝুলিয়ে রাখা হতো এই হাঁড়ি। তাতে রাখা হতো বিভিন্ন ধরনের খাবার। এ ছাড়া বিয়ে ও আচার-অনুষ্ঠানে মিষ্টি, পিঠাসহ শখের হাঁড়ি আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে উপহার হিসেবে পাঠানো হতো। উৎসব, পালা-পার্বণ, পূজা ও গ্রামীণ মেলাগুলোতে শখের হাঁড়ি দেখা যায়।

রঙ ও
মোটিফের
গল্প

শখের হাঁড়ি তৈরির জন্য রঙের প্রাচীন পদ্ধতি ছিল খুবই আকর্ষণীয়। আতপ চালের গুঁড়া থেকে তৈরি হতো সাদা রং, আর চুলার কালো ছাই দিয়ে তৈরি হতো কালো রং। লাল রং আসতো ইটের গুঁড়া থেকে। তবে এখন এগুলোর জায়গা নিয়েছে অ্যাক্রিলিক রং। তবু মোটিফগুলো একই রয়ে গেছে — মাছ, পাখি, পদ্ম, ধানের ছড়া। এগুলো যেন বাংলার মাটি ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য।

shokher hari শখের হাঁড়ি x bfa x fxyz (11) edit
সংগ্রাহক: ইমরান উজ জামান
Shokher hari_
A Folk Art Piece of Bangladesh

শখের হাঁড়ির বিভিন্ন
রকমফের ও নাম
.

গড়ন ও ব্যবহার ভেদে শখের হাঁড়ির বিভিন্ন রকমফের ও নাম রয়েছে। যেমন—মঙ্গল হাঁড়ি, সাপুড়ে হাঁড়ি, বালির হাঁড়ি, ঝরা হাঁড়ি, ফুল হাঁড়ি, জাগরণ হাঁড়ি, গর্ভ হাঁড়ি, আইবুড়ো হাঁড়ি, বাকু হাঁড়ি প্রভৃতি।

এই হাঁড়িগুলোয় আবার অঞ্চলভেদে নকশার ভিন্নতা দেখা যায়। রাজশাহীর বাঁয়া, বসন্তপুর ও নবাবগঞ্জের বারোঘরিয়ায় তৈরীকৃত হাঁড়িতে হলদে জমিনের ওপর লাল, নীল, সবুজ ও কালো রঙে আঁকা হয় হাতি, ঘোড়া, মাছ, শাপলা, পদ্ম, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, পেঁচা, কবুতর ইত্যাদি।

নওগাঁর বাঙ্গালপাড়ায় তাদের শখের হাঁড়িগুলোতে লাল রঙের ওপর সাদা-কালো ও সরষে ফুলের রঙে আঁকা হয় মাছ, পাখি, পদ্মফুল।



সুশান্ত কুমার পাল shokher hari শখের হাঁড়ি x bfa x fxyz (11) edit

সুশান্ত কুমার পালের সংগ্রামের গল্প

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শখের হাঁড়ি তৈরি হলেও রাজশাহীর বাঁয়া, বসন্তপুর এবং নবাবগঞ্জের বারোঘরিয়া শখের হাঁড়ির জন্য বিখ্যাত। নাটোরের বাঙালপাড়া ও পাইনবাবগঞ্জের বারঘরিয়া এই শিল্পের পুরনো কেন্দ্র। কিন্তু আজ এসব জায়গায় শখের হাঁড়ি তৈরির ঐতিহ্য টিকে আছে কেবল হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারের মাধ্যমে।

রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বসন্তপুর গ্রামের মাত্র একটি পরিবার এখন শখের হাঁড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত। এই পরিবারের প্রধান সুশান্ত কুমার পাল। এই একটি পরিবারই এখন রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শিল্প শখের হাঁড়িকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এবং নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহন করে এই ঐতিহ্য কে সবার কাছে পৌছে দিতে। মাটির গুণমান থেকে শুরু করে রঙের মিশ্রণ এবং নকশার দক্ষতায় তারা প্রাচীন ঘরানার শখের হাঁড়িকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। তাদের শ্রম ও ভালোবাসা এই শিল্পকে এখনও জীবন্ত রেখেছে।

এক জয়নুল মেলায় দেখা তার সাথে। তিনি বলেন- তার পূর্বপুরুষেরা কেবল হাঁড়ি বানাতেন না; তারা এতে ভালোবাসা ও সংস্কৃতির ছাপ রেখে যেতেন। মাটি জোগাড় থেকে শুরু করে নকশা আঁকা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ছিল তাদের যত্ন। “আমার দাদু বলতেন, মাটি ঠিক হলে হাঁড়ি সুন্দর হবে। আর হাঁড়ি সুন্দর হলে মানুষের মন ভরবে।” —সুশান্ত কুমার পালের কথাগুলো এখনো তার কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।

শখের হাঁড়ি আমাদের শেকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার একটি স্মারক। সুশান্ত কুমার পালের মতো শিল্পীরা নিজেদের জীবন দিয়ে এটি রক্ষা করছেন। কিন্তু এই শিল্প বাঁচাতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শখের হাঁড়ি শুধু একটি বস্তু নয়; এটি বাংলার মাটি, কৃষ্টির গল্প। এটি আমাদের ভালোবাসা ও সম্মানের সঙ্গে আগামীর জন্য টিকিয়ে রাখা জরুরি।


আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া লিংক


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!