হাসন রাজা Hason Raja x bfa x fxyz web

হাসন রাজা: আধ্যাত্মিক চেতনার বাউল কবি

লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নাই আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।


Dewan
Hason Raja
Chowdhury
.

হাসন রাজার এই গানে ধরা পড়ে এক আধ্যাত্মিক চেতনা এবং জীবনের অসারতা সম্পর্কে তার গভীর উপলব্ধি। বাংলা লোকসঙ্গীতের এই মহান শিল্পী শুধু গানেই নয়, তার জীবনের প্রতিটি বাঁকে প্রতিফলিত হয়েছে এক আধ্যাত্মিক সুর। তার গানে শুধু বিনোদনের জন্য সুর আর শব্দের ব্যবহার হয়নি; বরং তিনি গানকে ব্যবহার করেছেন জীবনের গভীর সত্য অনুসন্ধানের জন্য। তার সঙ্গীত সাধনার শুরু জমিদারি জীবনের একঘেয়েমি ও মানসিক শূন্যতা থেকে। জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, এবং পার্থিব ভোগ-বিলাসের অসারতা তাকে সঙ্গীতের গভীরে ডুব দিতে প্রেরণা জুগিয়েছে। হাসন রাজার জীবন ছিল বহুমাত্রিক। একদিকে তার শৌখিনতা ও বিলাসী জীবনধারা, অন্যদিকে তার সৃষ্টিশীলতার প্রতিভা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। জীবনের অনিত্যতা নিয়ে তার উপলব্ধি ও গানে প্রকাশিত দর্শন আজও অনন্য।অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি লালন শাহ্‌ এর প্রধান পথিকৃৎ ছিলেন। 

জন্ম ও শৈশব

পুরো নাম দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী যিনি হাসন রাজা ছদ্মনামে বেশী পরিচিত ছিলেন। তিনি ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ সালে সুনামগঞ্জ জেলার লক্ষ্মণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হাছন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তাঁর তৃতীয় পুত্র। মাতার নাম হুরমত জাহান বিবি। হাসন রাজার পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন, ফলে তিনি ধন-সম্পদ আর প্রতিপত্তির মধ্যে বড় হন।

যৌবনকাল

উত্তারাধিকার সূত্রে বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠা হাসন রাজা যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং চূড়ান্ত শৌখিন। তার জীবনধারা আর পছন্দের মধ্যে প্রতিফলিত হতো এই বিলাসিতা। রমণীদের সান্নিধ্যে তিনি ছিলেন অক্লান্ত এবং এ বিষয়ে নিজেই এক গানে উল্লেখ করেছেন:


“সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া”

হাসন রাজা

জীবদ্দশায় ক্যামেরায় তোলা হাসন রাজা একমাত্র ছবিটি কলকাতার একটি স্টুডিওতে তোলা হয়েছিল।

পাকা গোঁফ, চওড়া নাক আর মাথায় পাগড়ি—মরমি কবি হাসন রাজার একটি ছবি সবচেয়ে বেশি প্রচার পেয়েছে মুলত ছবিটি হাসন রাজার নয় বলে স্বজনেরা জানিয়েছেন । বহুল ব্যবহৃত , এটি মূলত প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে আঁকা কল্পিত একটি ছবি।


(তথ্যসূত্র: প্রথম আলো)

জমিদার জীবন থেকে বৈরাগ্যের দিকে যাত্রা

জীবনের শুরুর দিকে হাসন রাজা ছিলেন প্রচলিত জমিদারদের মতোই বিলাসী। তিনি সম্পদ, ক্ষমতা ও ভোগবিলাসে ডুবে ছিলেন। তবে জীবনের একপর্যায়ে তার মনোভাব বদলে যায়। কাছের মানুষের মৃত্যু, জীবনের অনিশ্চয়তা এবং পার্থিব জগতের অসারতা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি বুঝতে পারেন, মানুষের আসল সম্পদ পার্থিব নয়, বরং আধ্যাত্মিক।
এই উপলব্ধি থেকেই তিনি জমিদার জীবন থেকে ক্রমশ সরে এসে সাধক ও সঙ্গীতশিল্পীর পথে হাঁটতে শুরু করেন। জমিদারির দায়িত্ব পালন করলেও তিনি সঙ্গীত ও আধ্যাত্মিক সাধনায় বেশি মনোযোগী হন।

অন্য একটি ঘটনার কথা জানা যায়, ১৮৯৭ সালে একটি ৮.২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। যা গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক নামে পরিচিত। হাছন রাজার একটি পোষা হাতি ছিল যেটি ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট একটি ফাটলে পরে মারা যায়। এঘটনার পর হাছন রাজা মর্মাহত হন এবং তিনি এর পরে মরমী কবি হয়ে উঠেন।

( তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া )”

লালন সাঁইজী Fakir Lalon Shah

Fakir
Lalon
Shah

মনের মানুষের খোঁজে: লালন ফকিরের জীবন ও ভাবনা

লালন সাঁইজী বিশ্বাস করতেন সব মানুষের মধ্যেই বাস করে এক ‘মনের মানুষ’। আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে। দেহের ভেতরেই সেই মনের মানুষ বা যাকে তিনি ‘অচিন পাখি’ বলেছেন।

হাসন রাজার সঙ্গীত সাধনা:
আধ্যাত্মিকতার রূপায়ণ
.

তার সঙ্গীত সাধনার শুরু জমিদারি জীবনের একঘেয়েমি ও মানসিক শূন্যতা থেকে। জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, এবং পার্থিব ভোগ-বিলাসের অসারতা তাকে সঙ্গীতের গভীরে ডুব দিতে প্রেরণা জুগিয়েছে। হাসন রাজার গানগুলো ছিল তার আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন। তার গানগুলো মূলত বাউল ঘরানার হলেও সেগুলোর মধ্যে পার্থিব জীবনের অসারতা, ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন এবং আত্মানুসন্ধানের বিষয়টি গভীরভাবে ফুটে ওঠে। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে অনেক গান আজও বাংলা লোকসঙ্গীতের অমূল্য সম্পদ।

তার গানগুলোতে তিনটি প্রধান বিষয় লক্ষ্য করা যায়:

গানগুলোতে তিনটি প্রধান বিষয়

আত্মজিজ্ঞাসা: তার গানে বারবার উঠে এসেছে নিজ সত্তা ও আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের তাগিদ। তিনি প্রশ্ন করেছেন, “কী হবে এই জীবনের ঘরবাড়ি দিয়ে?”

পার্থিব জীবনের অসারতা: হাসন রাজার অনেক গানেই উঠে এসেছে ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, ও ভোগবিলাসের প্রতি বিতৃষ্ণা।
উদাহরণস্বরূপ:
“এই মাটির দেহ, মাটিতে পইড়া রবে,হায়রে মানুষ, হাসন বলে, তুই কি করলি?”

আধ্যাত্মিক প্রেম: তার গানে ইশ্বর ও আত্মার মাঝে এক ধ্রুপদী প্রেমের প্রকাশ ঘটে। এই প্রেমকে তিনি ‘মনের মানুষ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

গানের ভাষা ও রূপ

হাসন রাজার গানগুলো সহজ-সরল ভাষায় রচিত। তিনি তার গানগুলোর জন্য স্থানীয় উপভাষা ব্যবহার করতেন, যা তার গানের সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছে। তার গানে গ্রামীণ জীবনের চিত্র এবং আধ্যাত্মিকতা একসূত্রে গাঁথা। এই সরলতা ও আন্তরিকতা তার গানকে বাংলার লোকজ সঙ্গীতের এক অনন্য স্তরে নিয়ে গেছে।

লোকসঙ্গীতে হাসন রাজার প্রভাব

হাসন রাজার গানগুলো মূলত বাউল সঙ্গীত, তবে তার গানগুলোর মধ্যে বাউল গান ছাড়াও কবিগান, মুর্শিদি, মারফতি এবং দেহতত্ত্বের গভীর প্রভাব রয়েছে। বিশেষত তার গানের দেহতত্ত্ব অংশে আত্মার কথা বলা হয়েছে, যা বাউল দর্শনের অন্যতম ভিত্তি।

সংগীতের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক বার্তা

হাসন রাজা সঙ্গীতকে আধ্যাত্মিকতার এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তার গানগুলো কেবল মাটির পৃথিবীর গানে সীমাবদ্ধ নয়; এগুলো আত্মার মুক্তি, ভালোবাসা, এবং চূড়ান্ত সত্যের পথে যাত্রার প্রতিচ্ছবি।

গানের উত্তরাধিকার

হাসন রাজার গান শুধু তার সময়েই নয়, আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তার গানগুলো পরবর্তী প্রজন্মের গায়ক-সাধকদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আজও তার গান বিভিন্ন লোকসঙ্গীত উৎসব এবং গ্রামীণ মেলায় পরিবেশিত হয়।


আপনার মন্তব্য এবং একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️


মৃত্যুর পর

ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর।
হাসন রাজারে বান্ধিয়া রাখ দিলারাম তোর ঘর।।


তার সাধনসঙ্গিনী কে গানের মধ্যে দিকে বান্ধিয়া রাখতে বললেও হাসন রাজা ৭ই ডিসেম্বর ১৯২২ সালে নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন। সুনামগঞ্জ পৌর এলাকাধীণ গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে রয়েছে তার সমাধি করা হয়। তার মৃত্যুতে বাংলা লোকসঙ্গীত হারায় এক মহীরুহ। তবে তার গান আজও বাংলার মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছে।

হাসন রাজার
গানে আঞ্চলিক শব্দ

হাছন রাজার গানে আঞ্চলিক বুলি, প্রবচন ও বাগ্‌ধারার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তার গানের ভাষাভঙ্গি ভাষাতাত্ত্বিকদের পর্যালোচনার আকর্ষনীয় উপকরণ হতে পারে। তবে হাছনের গান ও তার প্রকাশভঙ্গিতে গ্রামীণ সাবলীল ভাষা প্রকাশ পেয়েছে, যা শহুরে “ভদ্রলোক” সমাজের কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে। হাছন রাজার গানে ব্যবহৃত কিছু আঞ্চলিক শব্দ ও বাগ্‌ধারার তালিকা নেয়া হলো উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

স্বামীর সেবা না করিলে, ধরাইব নি লাঙ্গে।।

লাঙ্গের সঙ্গে মন মজাইয়া হারাইলায় নিজ পতি।।

বুড়ি বড় হারামজাদা, ডাকে মোরে দাদা দাদা।।

হাসন রাজায় যায় তোদের মুখেতে হাগিয়া।।

মুতিয়া দে তোর বাপের মুখে, তার মুখে দে ছাই।।

আক্কল
জিয়ন
ভালা
ঠেকাইলায়
মুঞ্জিয়া
গানা
বেসক
বাড়ৈ
খেইড়
বন্ধে
লাঙ্গ

নাতিন
বুচা
লেইনজ
আজল
হাড়ুয়া পোক
মাড়ইল
গুড্ডি
ডুরি
হাউস
রেকি
উন্দা কল
মুস্করিয়া
টাটি

ছঙ্গাসন
খেওয়ানী
টন্‌কাইলে
আঞ্জা
খুবী
খেশ
ঢেন্ডুরা
ঠমকাইয়া
নাছন
গছে
ফাল্‌
পুতলা

ভৈসাল
জুংরা
সামাইল
লাইন্তি
চিনিবায়
কহন
বিকে
চিড়াবারা
কারাকারা
তারাবারচ
আঙ্গে আর ডাঙ্গে
আন্ধাইর গুন্ধাইর


তথ্যসূত্র

  1. হাসন রাজা: জীবন ও দর্শন। রেজওয়ান, মো. (২০১০)।
  2. হাসন রাজার গানের সংকলন।
  3. বাংলা লোকসঙ্গীতের ইতিহাস।
  4. উইকিপিডিয়া


December 20, 2024
zainul abedin জয়নুল আবেদি post bfa x fxyz web

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন । Zainul Abedin

bdfashion archive
“এখনতো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোন ছবি হয়না।” এটি বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন…
December 20, 2024
December 13, 2024
Helal Hafiz কবি হেলাল হাফিজ x bfa x fxyz web

কবিতায় আগুন জ্বালিয়ে রাখা এক কবি: হেলাল হাফিজ

bdfashion archive
ব্যক্তিজীবনে খুব শান্ত আর অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ হলেও তিনি ছিলেন প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন, কিন্তু চরিত্রে ছিলেন বোহেমিয়ান। বিয়ে করেননি কোনদিন।
December 13, 2024
December 6, 2024
হাসন রাজা Hason Raja x bfa x fxyz web

হাসন রাজা: আধ্যাত্মিক চেতনার বাউল কবি

bdfashion archive

লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নাই আমারকি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝারভালা কইরা ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আরআয়না দিয়া চাইয়া দেখি,…

December 6, 2024
November 15, 2024
Bari Siddiqui বারী সিদ্দিকী x bfa x fxyz

বাংলার বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী: লোকগানের এক অমর অধ্যায়

bdfashion archive
হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে বারী সিদ্দিকী বাঁশিবাদক থেকে লোকগান এবং আধ্যাত্মিক গানের জন্য পরিচিতি পেয়েছিলেন। বারী সিদ্দিকী সবসময় নিজেকে . . .
November 15, 2024
November 9, 2024
Humayun Ahmed হুমায়ূন আহমেদ x bfa x fxyz 2

বাংলা সাহিত্যে স্বপ্ন ও সংলাপের জনক: হুমায়ূন আহমেদ

bdfashion archive
হুমায়ূন আহমেদ তার গানের মত করেই অচিন দেশে, অচিন কোনো গাঁয়ে চলে গেছেন ২০১২ সালের ১৯ জুলাই এক অমাবস্যা রাতে। যদিও তার আকুতি…
November 9, 2024



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!