হোগলাপাতা: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প

হোগলাপাতা সহজে পচনশীল হওয়ায় পরিবেশ দূষণের কোনো আশঙ্কা নেই। জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই পরিবেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যখন আলোচনায় তুঙ্গে তখন হোগলা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

হোগলাপাতা Narrowleaf cattail Plant x bfa (7)

হোগলাপাতা

Narrowleaf cattail Plant


নদীর কিনারে, খালের ধারে, ঝিলের কোলে সবুজের মাঝে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত জিনিস—হোগলা পাতা। দেখতে অনেটা মেরুদন্ডহীন তলোয়ারের মত। হোগলা নামটা শুনলেই গ্রামবাংলার ছবি চোখে ভেসে ওঠে, তাই না? হোগলা শুধু একটা জলজ গাছ নয়, এ যেন গ্রামের নারীদের হাতে গড়া এক জাদুকাঠি। যা গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং প্রচীনকাল থেকে চলে আসা একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্পের প্রতীক।

হোগলা পাতা সহজে পচনশীল হওয়ায় পরিবেশ দূষণের কোনো আশঙ্কা নেই। জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই পরিবেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যখন আলোচনায় তুঙ্গে তখন হোগলা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। অল্প পানিতে বছরে কয়েকবার ফলন দেওয়া এই উদ্ভিদ পরিবেশবান্ধব পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সক্ষম।


হোগলা, যাকে বাংলায় ‘হোগলাপাতা’ বা ‘ধারী পাতা’ বলা হয়, ইংরেজিতে পরিচিত ‘ক্যাট টেইল’ (Cat Tail) নামে। এটি একটি জলজ উদ্ভিদ, যা নদী, খাল, ঝিলের কিনারে এঁটেল মাটিতে জন্মে। হোগলা পাতার জন্মটা বেশ নাটকীয়। আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষায়, যখন জল ছলছল করে, তখন এই উদ্ভিদ মাথা তুলে দাঁড়ায়। সারি সারি পাতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এর সবুজ চেহারা যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি এর ব্যবহারিক গুরুত্বও অপরিসীম। ৫ ফুট থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে সে যেন বলতে চায়, “আমি এসেছি, আমাকে কাজে লাগাও!” গ্রামের নারীরা তাই করেছে। তারা নদীর ধার থেকে এই পাতা কেটে আনে, রোদে শুকিয়ে নেয়, আর তারপর শুরু হয় তাদের কারুকাজ। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে জন্ম নেওয়া এই উদ্ভিদ কার্তিক থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত কাটা ও শুকানো হয়। মাদুর, হাতপাখা, ঝুড়ি, টুপি—এমন কিছু নেই যা তারা বানায় না। গরমে যখন বিদ্যুৎ নেই, তখন হোগলার হাতপাখা হয়ে ওঠে প্রাণ বাঁচানোর সঙ্গী। আর হোগলা পাতার পাটি? সেটা তো গ্রামের প্রতিটি ঘরের গল্প বলে—খাওয়া, নামাজ, ঘুম—সবকিছুর সাক্ষী।

হোগলা পাতার ফুল

এবার আসি হোগলা পাতার একটা মশলাদার টুইস্টে। হোগলার শুধু পাতাই নয়, ফুলেও লুকিয়ে আছে রহস্য। বেড়ে ওঠার কিছুদিন পর এই গাছে ফুল ধরে, আর সেই ফুল থেকে তৈরি হয় এক হলুদ পাউডার। শুনতে অদ্ভুত লাগছে, তাই না? এই পাউডার পুষ্টিকর, সুস্বাদু, এমনকি কেক বানানোর কাজেও লাগে। কেজি প্রতি দাম পরে ৬০-৮০ টাকা। গ্রামের মানুষ এই ফুল কেটে পাউডার বানিয়ে বাজারে বেচে, আর সেখান থেকে আসে বাড়তি রোজগার। কে ভেবেছিল, এই সাধারণ গাছের ফুলে লুকিয়ে আছে এমন ধন!

হোগলা পাতার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

হোগলার পণ্য বিক্রি হয় স্থানীয় হাট-বাজারে। ব্যবসায়ীরা পাইকারি দরে এগুলো কিনে বরিশাল, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠান। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার জুরগাঁও হাটে সপ্তাহে দুই দিন হোগলার বড় বাজার বসে। তবে হোগলার গল্প শুধু গ্রামে থেমে নেই। এটা এখন বিশ্বের দরবারে পৌঁছে গেছে। বেলাব উপজেলার বিন্নাবাইদ গ্রাম থেকে হোগলার ঝুড়ি, ফুলের টব, লন্ড্রি বাস্কেট ইউরোপ-আমেরিকাসহ ২৮টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এই পাতা এতটাই পরিবেশবান্ধব যে পচে গিয়েও মাটির ক্ষতি করে না। জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে, যখন সবাই টেকসই জিনিস খুঁজছে, হোগলা যেন হঠাৎ করে সুপারহিরো হয়ে উঠেছে।

শেষে একটা প্রশ্ন রেখে যাই—হোগলার এই উত্থান কি শুধুই ভাগ্যের খেলা? নাকি এর পিছনে লুকিয়ে আছে গ্রামের নারীদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর প্রকৃতির গোপন আশীর্বাদ? উত্তরটা হয়তো আপনি খুঁজে পাবেন, যখন পরেরবার গ্রামের হাটে একটা হোগলার মাদুর হাতে নিয়ে তার গন্ধ শুঁকবেন।

গ্রামীণ জীবনে হোগলার ব্যবহার

হোগলাপাতা গ্রামবাংলার জীবনে একটি অপরিহার্য উপাদান। ঘরের বিছানা, খাদ্যশস্য রোদে শুকানো, মিলাদ-মাহফিল, পূজা-পার্বণে বসার জন্য মাদুর, নামাজের জায়নামাজ, হাতপাখা, ঝুড়ি, টুপি, কুশন, এমনকি ঘরের ছাউনি ও বেড়া তৈরিতে এর ব্যবহার লক্ষণীয়। বিদ্যুৎবিহীন গ্রামে তীব্র গরমে হোগলার হাতপাখা ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী। শীতল পাটি নামে পরিচিত হোগলার মাদুর গ্রামের সব শ্রেণির মানুষের খাওয়া, নামাজ পড়া ও ঘুমানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। এছাড়া, ফসল রাখার টুকরি ও ক্ষেতের বেড়া তৈরিতেও এটি সমান জনপ্রিয়।

আপনার একটি শেয়ার এবং মন্তব্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️


তথ্যসূত্র: ঢাকা পোষ্ট, জাগোনিউজ২৪, রূপালি বাংলাদেশ



আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া লিংক


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!