হোগলা, যাকে বাংলায় ‘হোগলাপাতা’ বা ‘ধারী পাতা’ বলা হয়, ইংরেজিতে পরিচিত ‘ক্যাট টেইল’ (Cat Tail) নামে। এটি একটি জলজ উদ্ভিদ, যা নদী, খাল, ঝিলের কিনারে এঁটেল মাটিতে জন্মে। হোগলা পাতার জন্মটা বেশ নাটকীয়। আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষায়, যখন জল ছলছল করে, তখন এই উদ্ভিদ মাথা তুলে দাঁড়ায়। সারি সারি পাতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এর সবুজ চেহারা যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি এর ব্যবহারিক গুরুত্বও অপরিসীম। ৫ ফুট থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে সে যেন বলতে চায়, “আমি এসেছি, আমাকে কাজে লাগাও!” গ্রামের নারীরা তাই করেছে। তারা নদীর ধার থেকে এই পাতা কেটে আনে, রোদে শুকিয়ে নেয়, আর তারপর শুরু হয় তাদের কারুকাজ। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে জন্ম নেওয়া এই উদ্ভিদ কার্তিক থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত কাটা ও শুকানো হয়। মাদুর, হাতপাখা, ঝুড়ি, টুপি—এমন কিছু নেই যা তারা বানায় না। গরমে যখন বিদ্যুৎ নেই, তখন হোগলার হাতপাখা হয়ে ওঠে প্রাণ বাঁচানোর সঙ্গী। আর হোগলা পাতার পাটি? সেটা তো গ্রামের প্রতিটি ঘরের গল্প বলে—খাওয়া, নামাজ, ঘুম—সবকিছুর সাক্ষী।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। হোগলা শুধু ব্যবহারের জিনিস নয়, গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছে। একটা মাদুর বানাতে একদিন লাগে, বিক্রি হয় ২০০-৩০০ টাকায়। কেউ কেউ হোগল পাতা বাজার থেকে বান্ডেল কিনে এনে বানায়, পাতার বান্ডিলের দাম পড়ে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত যা থেকে ৪-৫টা মাদুর বেরিয়ে আসে, আর ঘরে ঢোকে সচ্ছলতা। প্রভাতি সরকার নামে এক নারীকে দেখুন—প্রতিদিন তিন/চারটি মাদুর বানিয়ে ১০০০-১৫০০ টাকা কামাচ্ছেন। পুরুষ যখন বাইরে কাজে ব্যস্ত, নারীরা তখন ঘরে বসে এই শিল্প দিয়ে সংসারে হাসি ফোটাচ্ছে। এ যেন এক নীরব বিপ্লব!
হোগলা পাতার ফুল
এবার আসি হোগলা পাতার একটা মশলাদার টুইস্টে। হোগলার শুধু পাতাই নয়, ফুলেও লুকিয়ে আছে রহস্য। বেড়ে ওঠার কিছুদিন পর এই গাছে ফুল ধরে, আর সেই ফুল থেকে তৈরি হয় এক হলুদ পাউডার। শুনতে অদ্ভুত লাগছে, তাই না? এই পাউডার পুষ্টিকর, সুস্বাদু, এমনকি কেক বানানোর কাজেও লাগে। কেজি প্রতি দাম পরে ৬০-৮০ টাকা। গ্রামের মানুষ এই ফুল কেটে পাউডার বানিয়ে বাজারে বেচে, আর সেখান থেকে আসে বাড়তি রোজগার। কে ভেবেছিল, এই সাধারণ গাছের ফুলে লুকিয়ে আছে এমন ধন!
হোগলা পাতার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
হোগলার পণ্য বিক্রি হয় স্থানীয় হাট-বাজারে। ব্যবসায়ীরা পাইকারি দরে এগুলো কিনে বরিশাল, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠান। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার জুরগাঁও হাটে সপ্তাহে দুই দিন হোগলার বড় বাজার বসে। তবে হোগলার গল্প শুধু গ্রামে থেমে নেই। এটা এখন বিশ্বের দরবারে পৌঁছে গেছে। বেলাব উপজেলার বিন্নাবাইদ গ্রাম থেকে হোগলার ঝুড়ি, ফুলের টব, লন্ড্রি বাস্কেট ইউরোপ-আমেরিকাসহ ২৮টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এই পাতা এতটাই পরিবেশবান্ধব যে পচে গিয়েও মাটির ক্ষতি করে না। জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে, যখন সবাই টেকসই জিনিস খুঁজছে, হোগলা যেন হঠাৎ করে সুপারহিরো হয়ে উঠেছে।
আপনার একটি শেয়ার এবং মন্তব্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️
তথ্যসূত্র: ঢাকা পোষ্ট, জাগোনিউজ২৪, রূপালি বাংলাদেশ

প্রাদা কিনছে ভার্সাচি: দুই আইকনের একত্রীকরণ
bdfashion archive
তেহারী ঘর: এক প্লেট নস্টালজিয়া
fayze hassanতেহারী ঘর: ঐতিহ্যের স্বাদে একটি অনন্য অভিজ্ঞতা যদি কখনো সোবহানবাগের পথে যান, তেহারী ঘরে একবার…

আড়াই হাত থেকে বারো হাত: গামছা -র ফ্যাশন বিবর্তন
fayze hassan
হোগলাপাতা: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প
fayze hassan
নারিকেলের মালা: বর্জ্য থেকে বর্তমানের গল্প
fayze hassan
নকশী পিঠা এক প্রকার লোকশিল্প
fayze hassanআমাদের সোশ্যাল মিডিয়া লিংক