দেশ সদ্যমাত্র প্রাণভরে বিজয়ের স্বাদ নিচ্ছে। বাহাত্তরের কোনো এক স্বাধীন ও প্রাণবন্ত সকালে চাঁপাইয়ের চাষা ভাই সোনা ফলা মাঠে যাচ্ছেন হালচাষের জন্য। লাঙল দাবাতেই খেয়াল করলেন শক্ত কি যেন একটা ফলার সাথে আঘাত লাগলো। হাতে নিয়ে চক্ষু চড়কগাছ! সে কি! এ যে আবীর রঙা নকশাদার ইট! চিন্তার ভাঁজ কপালে পড়লেও এলাকায় গিয়ে সবাইকে দেখালেন। এ-কান সে-কান করতে করতে স্থানীয় প্রশাসন খবর পেয়ে মাটি খোঁড়া শুরু করলো। বেরিয়ে এলো কালের বিবর্তে হারিয়ে যাওয়া বঙ্গদেশের প্রথম প্রাচীন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিধায় অভিহিত ‘ দারাসবাড়ি মসজিদ ‘ ও মাদ্রাসা।
গল্প শুনে নয়, ভাবলাম এরুপ স্থাপত্যশিল্প নিজের চোখে না দেখলে নিজেদের সিলসিলা সম্পর্কে অজ্ঞ-ই থেকে যেতে হবে। পবিত্র শা’বানের প্রথম সপ্তাহান্তেই ছুটে গেলাম বাংলার এক ব্যতিক্রমী ভূখন্ড,স্রোতস্বিনী মহানন্দার তীরস্থ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
মসজিদটি নির্মাণকাল ছিল ক্রিস্টাব্দ ১৪শ শতাব্দীতে বাংলার আদি রাজধানী গৌড়ের ফিরোজপুরে। তখনকার শাসক শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের আদেশে এর নির্মিতি হয়। এর নাম ছিল ‘ফিরোজপুর মসজিদ’। ১৫ শ শতাব্দীতে যখন নতুন শাসক হিসেবে সুলতান হোসেন শাহ নিযুক্ত হন, মসজিদের অদূরে ‘দারাসবাড়ি’ বানান। আরবী ‘দারস’ শব্দের অর্থ ‘পাঠ’। তাই শিক্ষাঙ্গন বা পাঠশালাকে বলা হতো ‘দারসবাড়ি’ বা ‘দারাসবাড়ি’। মসজিদের নাম-ও পরিবর্তন হয়ে যায়।
সমকালীন স্থাপত্যকলার বিচারে এই মসজিদ আয়তনে বেশ বড়-ই বলা যায়। দৈর্ঘ্য যায় ৯৯ ফুট ৫ ইঞ্চি, প্রস্থে ৩৪ ফুট ৯। এর পশ্চিমে কারুকাজ খচিত ৯ টি মেহরাব, উত্তর দক্ষিণে তিনটি করে দরজা। নির্মানপ্রণালী দেখে বোঝা যায়, এখানে মহিলাদের জন্য আলাদা করে নামাজের জায়গা ছিল। কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে এর ছাদ,দেয়ালগুলোও অস্তিত্ব হারিয়ে কোনোমতে টিকে আছে। মসজিদের সামনে আছে দিঘী, দিঘীর ওপারে সুবিশাল মাদ্রাসা।
সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো বিষয় হচ্ছে, যে কেউ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবে পাঁচ-ছ’শ বছর আগের মসজিদের নকশাদারিত্ব, টেরাকোটা আর সূক্ষ্মতম ইটের গাঁথুনি দেখে।
অনেকটা আফসোসের সুরেই বলতে হয়, একসময় এর মিম্বরে থেকে ভেসে আসতো মুয়াজ্জিনের আযানের সুরেলা ধ্বনি। অবুঝেরা হাতে তুলে নিতো পবিত্র কুরআন,প্রত্যূষে এসে ভীড় জমাতে আরবি শিক্ষা নিতে। এখন এ সব-ই অতীত। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে মসজিদের কাঠামো। আর ভেসে আসে না শেষরাতের সেই দাওয়াত- ‘আসসালাতু খাইরুল মিনাল নাওম’! কালের আবর্তে একসময়ের স্নিগ্ধ সজীব এই স্থাপনা আজ অস্তিত্ব রক্ষার আকুতি জানাচ্ছে।
এইসব নিদর্শন বিশ্বাস করাতে বাধ্য করে এ দেশের আকাশ-পাতাল,অন্তিম-অসীম সমীরণে এখনো মিশে আছে কুরআনের আলো, নির্মল নূরের ছোঁয়া ও ইসলামের ঘ্রাণ। খুঁজে দেয় শিকড়ের সন্ধান, মন ভরে বিশুদ্ধতায়। আমরা আশা নিয়ে বাঁচি,আশায় থাকি মহানন্দার অপার সৌন্দর্যে আবারো যোগ হবে দারাসবাড়ির আজানের ধ্বনি, উচ্চারিত হবে ‘হাইয়া আস-সালাহ’। কেউ বলে উঠবে কায়কোবাদের মতো-
‘কে ঐ শোনালো মোরে আজানের ধ্বনি,
মর্মে মর্মে সেই সুর,বাজিল কি সুমধুর-
আকুল হইলো প্রাণ,নাচিল ধমনী,
কি মধুর আজানের ধ্বনি! ‘
দারাসবাড়ি মসজিদের অবস্থান
দারাসবাড়ি মসজিদ এর অবস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ছোট সোনা মসজিদের কাছাকাছি। মসজিদটির অবস্থান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ওমরপুরে। সোনামসজিদ স্থল বন্দর থেকে মহানন্দা নদীর পাড় ঘেঁষে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ রাইফেলস-এর সীমান্ত তল্লাশী ঘাঁটি; এই ঘাটিঁর অদূরে অবস্থিত দখল দরওয়াজা। দখল দরওয়াজা থেকে প্রায় এক কি্লোমিটার হেঁটে মনোমুগ্ধকর আমবাগানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে একটি দিঘী পার হয়ে দক্ষিণ পশ্চিমে ঘোষপুর মৌজায় দারাসবাড়ি মসজিদ ও দারাসবাড়ি মাদ্রাসা অবস্থিত।
যাওয়ার উপায়
ঢাকা থেকে বাস-ট্রেন বা বিমানযোগে সরাসরি আসা যাবে রাজশাহীতে। রাজশাহী থেকে স্থানীয় পরিবহনে ঘন্টাখানেক সময়ে ব্যবধানে চলে আসা যাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বাস টার্মিনাল বা বিশ্বরোডে। সেখান থেকে সরাসরি কিংবা মহানন্দা সেতু পার হয়ে বারোদুয়ারী বাজার এসে সিএনজি বা বাসে করে যেতে হবে শিবগঞ্জের শাহাবাজপুর ইউনিয়নের সোনামসজিদ স্থলবন্দরে। স্বল্প দূরত্বে হেঁটেই যাওয়া যাবে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী এই মসজিদে।