জন্ম ও শৈশব
পুরো নাম দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী যিনি হাসন রাজা ছদ্মনামে বেশী পরিচিত ছিলেন। তিনি ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ সালে সুনামগঞ্জ জেলার লক্ষ্মণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হাছন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তাঁর তৃতীয় পুত্র। মাতার নাম হুরমত জাহান বিবি। হাসন রাজার পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন, ফলে তিনি ধন-সম্পদ আর প্রতিপত্তির মধ্যে বড় হন।
তখন আরবী-ফার্সির চর্চা খুব প্রবল ছিল। জানা যায় সিলেটের নাজির আবদুল্লা বলে এক বিখ্যাত ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ মতে তার নামকরণ করা হয়- হাসন রাজা। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। মাজহারুদ্দীন ভূঁইয়া বলেন, “বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ে তেমনি সৌম্যদর্শন ছিলেন। চারি হাত উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ এবং একমাথা কবিচুল পারসিক সুফীকবিদের একখানা চেহারা চোখের সম্মুখে ভাসতো।”( তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া )”।
যৌবনকাল
উত্তারাধিকার সূত্রে বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠা হাসন রাজা যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং চূড়ান্ত শৌখিন। তার জীবনধারা আর পছন্দের মধ্যে প্রতিফলিত হতো এই বিলাসিতা। রমণীদের সান্নিধ্যে তিনি ছিলেন অক্লান্ত এবং এ বিষয়ে নিজেই এক গানে উল্লেখ করেছেন:
“সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া”।
বর্ষাকাল এলে, তিনি বিশাল নৌকায় নৃত্য-গীতের আয়োজন করতেন এবং সঙ্গীত, নৃত্য ও আনন্দ-বিহারে নিজেকে নিমজ্জিত করতেন। এসব সময়েই তিনি বহু গান রচনা করেছেন, যেখানে জীবনের অনিত্যতা ও ভোগবিলাসের সীমাবদ্ধতার কথা উঠে এসেছে। তার গানগুলো ছিল আত্মসমালোচনামূলক, যা যেন তাকে ভোগবিলাসের মাঝেও জীবনের প্রকৃত সত্য স্মরণ করিয়ে দিত।
নিজের ভোগ-বিলাস ও শৌখিনতায় নিমগ্ন হয়ে হাসন রাজা প্রজাদের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তার অত্যাচারী এবং নিষ্ঠুর রাজার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দ-বিহারের প্রতি অতি আসক্তি তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
গানগুলোতে তিনটি প্রধান বিষয়
আত্মজিজ্ঞাসা: তার গানে বারবার উঠে এসেছে নিজ সত্তা ও আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের তাগিদ। তিনি প্রশ্ন করেছেন, “কী হবে এই জীবনের ঘরবাড়ি দিয়ে?”
পার্থিব জীবনের অসারতা: হাসন রাজার অনেক গানেই উঠে এসেছে ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, ও ভোগবিলাসের প্রতি বিতৃষ্ণা।
উদাহরণস্বরূপ:
“এই মাটির দেহ, মাটিতে পইড়া রবে,হায়রে মানুষ, হাসন বলে, তুই কি করলি?”
আধ্যাত্মিক প্রেম: তার গানে ইশ্বর ও আত্মার মাঝে এক ধ্রুপদী প্রেমের প্রকাশ ঘটে। এই প্রেমকে তিনি ‘মনের মানুষ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
গানের ভাষা ও রূপ
হাসন রাজার গানগুলো সহজ-সরল ভাষায় রচিত। তিনি তার গানগুলোর জন্য স্থানীয় উপভাষা ব্যবহার করতেন, যা তার গানের সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছে। তার গানে গ্রামীণ জীবনের চিত্র এবং আধ্যাত্মিকতা একসূত্রে গাঁথা। এই সরলতা ও আন্তরিকতা তার গানকে বাংলার লোকজ সঙ্গীতের এক অনন্য স্তরে নিয়ে গেছে।
লোকসঙ্গীতে হাসন রাজার প্রভাব
হাসন রাজার গানগুলো মূলত বাউল সঙ্গীত, তবে তার গানগুলোর মধ্যে বাউল গান ছাড়াও কবিগান, মুর্শিদি, মারফতি এবং দেহতত্ত্বের গভীর প্রভাব রয়েছে। বিশেষত তার গানের দেহতত্ত্ব অংশে আত্মার কথা বলা হয়েছে, যা বাউল দর্শনের অন্যতম ভিত্তি।
সংগীতের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক বার্তা
হাসন রাজা সঙ্গীতকে আধ্যাত্মিকতার এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তার গানগুলো কেবল মাটির পৃথিবীর গানে সীমাবদ্ধ নয়; এগুলো আত্মার মুক্তি, ভালোবাসা, এবং চূড়ান্ত সত্যের পথে যাত্রার প্রতিচ্ছবি।
গানের উত্তরাধিকার
হাসন রাজার গান শুধু তার সময়েই নয়, আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তার গানগুলো পরবর্তী প্রজন্মের গায়ক-সাধকদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আজও তার গান বিভিন্ন লোকসঙ্গীত উৎসব এবং গ্রামীণ মেলায় পরিবেশিত হয়।
আপনার মন্তব্য এবং একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️
স্বামীর সেবা না করিলে, ধরাইব নি লাঙ্গে।।
লাঙ্গের সঙ্গে মন মজাইয়া হারাইলায় নিজ পতি।।
বুড়ি বড় হারামজাদা, ডাকে মোরে দাদা দাদা।।
হাসন রাজায় যায় তোদের মুখেতে হাগিয়া।।
মুতিয়া দে তোর বাপের মুখে, তার মুখে দে ছাই।।
তথ্যসূত্র
- হাসন রাজা: জীবন ও দর্শন। রেজওয়ান, মো. (২০১০)।
- হাসন রাজার গানের সংকলন।
- বাংলা লোকসঙ্গীতের ইতিহাস।
- উইকিপিডিয়া

তারেক মাসুদ: সিনেমার ফেরিওয়ালা
bdfashion archive
বাংলার বাঘ: শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক
bdfashion archive
চন্দ্রাবতী: বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি
bdfashion archive
জীবন্ত কিংবদন্তি বাউল শাহ আবদুল করিম: ভাটি বাংলার মাটির মানুষ
bdfashion archive
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন । Zainul Abedin
bdfashion archive



