জন্ম ও পরিবার
চন্দ্রাবতী ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরগঞ্জের পাতুয়াইর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত ভাসান কবি দ্বিজ বংশী দাস ও সুলোচনা দেবীর মেয়ে। বাবার কাছ থেকে কাব্যের প্রতি ভালোবাসা আর সৃজনশীলতা পেয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ে নারীদের জন্য শিক্ষা বা সাহিত্যচর্চা সহজ ছিল না। তবু চন্দ্রাবতী নিজের প্রতিভা দিয়ে সব বাধা পেরিয়ে কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
সাহিত্যকর্ম
চন্দ্রাবতী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি লিখেছেন রামায়ণ, দস্যু কেনারামের পালা, মলুয়া লোকপালা এবং আরও অনেক গীতিকবিতা। তার রচিত রামায়ণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই রামায়ণে তিনি প্রচলিত কাহিনির বাইরে গিয়ে সীতার জীবনের দুঃখ-কষ্টকে তুলে ধরেছেন। তার লেখায় সীতা শুধু রামের স্ত্রী নন, বরং একজন নারীর বেদনা আর শক্তির প্রতীক। এছাড়া তার লেখা গীতিকা ও পালাগুলোতে ভাটি বাংলার মানুষের জীবন, সুখ-দুঃখ আর সংগ্রামের ছবি ফুটে উঠেছে।
ময়মনসিংহ গীতিকায় চন্দ্রাবতীর কবিতা ও পালাগুলো আজও জনপ্রিয়। তার সৃষ্টি শুধু সাহিত্য নয়, বাংলার লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ।
“ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়॥
ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী।
বাঁশের পাল্লায় তাল-পাতার ছাউনী॥
… … … ….. …. …… …… … …. …
বাড়াতে দারিদ্র-জ্বালা কষ্টের কাহিনী।
তার ঘরে জন্ম নিল চন্দ্রা অভাগিনী॥
সদাই মনসা-পদ পূজি ভক্তিভরে।
চাল-কড়ি কিছু পাই মনসার বরে॥
… … … … … … …. … …. …. ….
শিব-শিবা বন্দি গাই ফুলেশ্বরী নদী।
যার জলে তৃষ্ণা দূর করি নিরবধি॥
বিধিমতে প্রণাম করি সকলের পায়।
পিতার আদেশে চন্দ্রা রামায়ণ গায়॥
প্রেমের করুণ কাহিনি
চন্দ্রাবতী, এক অপরূপা সুন্দরী, এবং তার বাল্যসখা জয়চন্দ্রের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে প্রেমে রূপান্তরিত হয়। তাদের প্রেম এতটাই গাঢ় ছিল যে বিয়ের সকল আয়োজনও সম্পন্ন হয়ে যায়। কিন্তু ঠিক সেই সময়, জয়চন্দ্র হঠাৎ মুসলমান মেয়ে আসমানির রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকেই বিয়ে করে ফেলেন।
এই মর্মান্তিক সংবাদ চন্দ্রাবতীকে গভীরভাবে আঘাত করে। তিনি স্তম্ভিত হয়ে খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করেন। তার এই অবস্থা দেখে পিতা মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাকে শিবের নামে একমনে ধ্যান করতে এবং রামায়ণ রচনায় মনোনিবেশ করতে উপদেশ দেন। পাশাপাশি, তিনি মনসা মন্দিরের পাশে চন্দ্রাবতীর জন্য একটি শিব মন্দির নির্মাণ করে দেন। চন্দ্রাবতী সেই মন্দিরে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেন এবং ধ্যান ও রামায়ণ রচনায় মগ্ন হন।
কিছুকাল পর জয়চন্দ্র তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে চন্দ্রাবতীর কাছে ফিরে আসেন। কিন্তু চন্দ্রাবতী ততদিনে সংসারের মায়া ত্যাগ করে শিবের আরাধনায় নিমগ্ন। তিনি জয়চন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন। প্রত্যাখ্যাত জয়চন্দ্র মন্দিরের দ্বারে চন্দ্রাবতীর উদ্দেশে একটি বাণী লিখে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন। তখন চন্দ্রাবতী মন্দিরের ভেতরে ধ্যানমগ্ন ছিলেন, তাই জয়চন্দ্রের অনুনয়-বিনয় তিনি শুনতে পাননি।
এই করুণ কাহিনি ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রচলিত পালাগান ও গাথার মাধ্যমে জানা যায়। ১৯১৬ সালে কবি চন্দ্রকুমার দে প্রথম এই গাথাগুলি সংগ্রহ করেন, যা এই ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনির সাক্ষ্য বহন করে।
শিবমন্দির ও ঐতিহ্য
চন্দ্রাবতীর স্মৃতি আজও জড়িয়ে আছে পাতুয়াইর গ্রামের শিবমন্দিরের সঙ্গে। এই অষ্টকোণাকৃতির মন্দির এবং তার পূর্বপুরুষের ভগ্নপ্রায় বাড়ি ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা এখানে এসে চন্দ্রাবতীর গল্প শুনে মুগ্ধ হন। তবে মন্দির ও বাড়ির সংরক্ষণের অভাবে এই ঐতিহাসিক স্থান ধ্বংসের মুখে। স্থানীয়রা এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র ও পাঠাগার গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন। সরকারিভাবেও মন্দির ও বাড়ি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
আপনার একটি শেয়ার এবং মন্তব্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️
আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া লিংক

তারেক মাসুদ: সিনেমার ফেরিওয়ালা
bdfashion archive
বাংলার বাঘ: শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক
bdfashion archive
চন্দ্রাবতী: বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি
bdfashion archive
জীবন্ত কিংবদন্তি বাউল শাহ আবদুল করিম: ভাটি বাংলার মাটির মানুষ
bdfashion archive
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন । Zainul Abedin
bdfashion archive


