‘ গামছা -ও একটা কাপড় আর ভায়রাও একটা কুটুম’
গামছার নাম শুনলেই অনেকের মনে আসে তাচ্ছিল্যের ভাব। যেন এ এক অতি সাধারণ বস্তু, যার আলাদা করে কোনো মর্যাদা নেই। কিন্তু গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যায়, গামছা কেবল একটি কাপড় নয়; এটি বাঙালির জীবনের অঙ্গ। ঠিক যেমন পরিবারের কোনো আত্মীয়—ভায়রা—সম্পর্কে উপেক্ষিত হয়, তেমনই গামছা, তার বহুমুখী ব্যবহার সত্ত্বেও, আমাদের পোশাক সংস্কৃতিতে তাচ্ছিল্যের একটি জায়গায় থেকে গেছে। অথচ এই গামছার টানা-পোড়েনে বোনা রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং আবেগ।
জীবনের প্রতিটি পরতে ‘গামছা’
গোসল করতে গামছা, গা মুছতে গামছা, তিন বেলা খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে মুছতে গামছা, গরমে হাতপাখাটা কাছে নেই, একটু গা টা জুড়িয়ে নিতে হাওয়া করতে গামছা,ঘামে গা ভিজে গেছে, গায়ের জামা খুলেই গা টা মুছতে হবে, চাই গামছা, গায়ে এসে বসছে মশা মাছি, ঘরে লোডশেডিং, গামছা-টা কোথায় মুখ থেকে এই কথাটাই বেরিয়েই আসে সহজে। গামছার হাওয়া দিয়েই মশা মাছির সাথে লড়াই, কোথাও বেড়াতে যেতে হলে খোঁজ গামছাটা নেয়া হয়েছে তো ব্যাগে? পথচলতি ক্লান্ত মানুষটি তাঁর নিত্যসঙ্গী গামছাটি পেতেই গাছের ছায়ায় শুয়ে একটু বিশ্রাম করে নেন। রোদ থেকে বাঁচতেও মাথায় গামছার আড়াল নেওয়া হয়। ছানা বানাতে পানি ঝরানো থেকে জিনিসপত্র বা খাদ্যসামগ্রী বেঁধে নিয়ে যাওয়া, বিবাহ অনুষ্ঠান বা দেবতার পুজো, গামছা লাগে সর্বত্র।
যেভাবে তৈরি হয় ‘গামছা’
গামছা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় বাজার থেকে সুতা কেনার মাধ্যমে। তাঁতিরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী সুতা বেছে নেন, যেমন ৪০ কাউন্ট বা ২০ কাউন্ট। ‘কাউন্ট’ বলতে সুতার চিকন বা মোটা হওয়ার পরিমাপ বোঝায়—কাউন্ট যত বেশি, সুতা তত চিকন। গামছার জন্য সাধারণত ৬৪ কাউন্টের সুতা ব্যবহার হয়। কেনা সুতা গামছার ডিজাইন অনুযায়ী রঙ করা হয়, তারপর রোদে শুকিয়ে হাতের চড়কা বা মেশিনে পল্লা তৈরি করা হয়।
পল্লা তৈরির পর সুতা ছিটা বা নলিতে (প্লাস্টিকের তৈরি) তোলা হয়। এরপর ড্রামে উঠিয়ে সানার ভেতর দিয়ে মোটা নরদে স্থানান্তর করা হয়। শেষে সানা করে তাঁতে তোলা হয়। এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে একজন করে শ্রমিক কাজ করেন, এবং নারী-পুরুষ উভয়ই এতে জড়িত থাকেন। গামছা-তৈরিতে কেবল সুতা আর রংই প্রয়োজন, যা এর সরলতা ও সাশ্রয়ীতার প্রমাণ দেয়।
একসময় গামছা-তৈরি হতো খটখটি তাঁত দিয়ে। তাঁত বসানো হতো সমতল মাটিতে, আর তাঁত চালানোর জন্য দুই পা দিয়ে বও টানতে হতো। এজন্য মাটিতে গর্ত করে ‘বেগি’ নামে একটি খাদ তৈরি করা হতো, যা দেখতে অনেকটা সামরিক আন্ডারগ্রাউন্ড স্থাপনার মতো। এক হাতে মাকু চালানোর জন্য কাঠের তৈরি মুঠি আর অন্য হাতে সানার দণ্ড ব্যবহার হতো।
কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় তাঁত কারখানা এখন অনেক বদলে গেছে। বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে, আর তাঁত তৈরি হচ্ছে লৌহজাত দ্রব্য দিয়ে, যা আমদানিনির্ভর। খটখটি তাঁতের সেই ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তবে প্রক্রিয়া যাই হোক, গামছার মূল উপাদান—সুতা আর রং—অপরিবর্তিত রয়েছে।
গামছা- তৈরির সঙ্গে জড়িত মানুষদের সমাজে ‘কারিগর’ সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। তবে তাচ্ছিল্য করে অনেকে তাঁদের ‘জোলা’ বলে ডাকেন। ‘জো’ তুলে, অর্থাৎ সুতায় সুতায় জোড়া দিয়ে যাঁরা মানুষের জন্য পরিধেয় বস্ত্র তৈরি করেন, তাঁরাই এই জোলা। তাঁদের শ্রমে তৈরি গামছা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেও, তাঁদের প্রতি সম্মান প্রায়ই অগ্রাহ্য থাকে।
ঝালকাঠির গনি মিঞার গামছা










আপনার একটি শেয়ার এবং মন্তব্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️
তথ্যসূত্র:
গামছা চরিতকথা
শফিকুল কবীর চন্দন
দৈনিক বাংলা
গা-ম-ছা লাগবে গামছা
জনকন্ঠ

আড়াই হাত থেকে বারো হাত: গামছা -র ফ্যাশন বিবর্তন
fayze hassan
হোগলাপাতা: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প
fayze hassan
নারিকেলের মালা: বর্জ্য থেকে বর্তমানের গল্প
fayze hassan
নকশী পিঠা এক প্রকার লোকশিল্প
fayze hassan
নকশি পাখা: বাতাসে লুকানো ঐতিহ্যের গল্প
fayze hassan
মণিপুরী নৃ-গোষ্ঠীর জীবন ও তাঁতশিল্পের গল্প
fayze hassanআমাদের সোশ্যাল মিডিয়া লিংক