সময়টা এ বছরের ১৩ জানুয়ারি,পৌষের মোষ তাড়ানো শীত শেষে মাঘ আসছিল বাঘ দৌড়ানোর জন্য। গৎবাঁধা স্যাডলাইফ(অফিস!) থেকে ডে ট্রিপের জন্য কয়েকজন মিলে ভাবলাম, নেত্রকোণার সুসং দূর্গাপুর ঘুরে আসি। আমাদের অবস্থান মাওনাতে হওয়ায় যাওয়া আসার ঝক্কি-ঝামেলা কম হবে বলে সেই মোতাবেক প্ল্যান সাজালাম। গন্তব্য বিরিশিরি
কিন্তু বিধি-বাম, যাওয়ার দিন সাথে কেউ নেই। যে যার মতো এড়িয়ে গেলো! বৃহস্পতিবার রাতে অফিস শেষে মন ঘুরপাক খাচ্ছিলো যাবো কি যাবোনা! অগত্যা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে….’ মন্ত্রদীক্ষিত হয়ে একাই বেরিয়ে পড়লাম। সময় অপচয় করে বের হওয়ায় দূর্গাপুর যেতে যেতে রাত বাজলো ১ টা! ময়মনসিংহ যেতে দেড় ঘন্টা সময় লাগলেও সেখান থেকে জারিয়া-ঝাঞ্জাইল রোডে শত শত বালুবোঝাই ট্রাকের সিরিয়াল পড়ায় অনেকটা বিরক্তি নিয়েই মোট ৫ ঘন্টা পর শেষমেশ পৌঁছে গেলাম।
বিরিশিরিতে যার আতিথেয়তায় মুগ্ধ ছিলাম; সব্যসাচী ছবিয়াল ছোটভাই খায়রুল তার ফটোগ্রাফিক দক্ষতা, পরিপূর্ণ গাইডলাইন আর ওর সুরেলাকন্ঠের গান আমার ভ্রমণে যোগ করেছিল অনন্যমাত্রা। শীতের সকালের হালকা সোনা রোদ গায়ে মাখিয়ে দূর্গাপুর বাজারে সকালে এ জেলার ব্র্যান্ডিং মিষ্টান্ন ‘বালিশ মিষ্টি’র স্বাদ নিয়ে চলে এলাম তেরীঘাট বাজার। সেখানে শুকনো নদীর বালুচর ডিঙ্গিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা দেখতে দেখতে কাঠের একটা ব্রিজ পেরিয়ে চলে এলাম এপারের শিবগঞ্জ বাজার। ওইদিন আবার একসাথে ‘হাজং’ জাতিসত্তার স্কুল পড়ূয়া ছাত্র-ছাত্রীদের দেখা মিলেছিল, যারা কোভিডের টিকা নিতে দলবেঁধে স্কুলে যাচ্ছিলো। ওদের সাথে একটু আকটু কথা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওদের মাতৃভাষা কিছুই বুঝিনি,কিন্তু উপভোগ করেছি।
আয় তব সোমেশ্বরী
বাইকে চেপে চলে এলাম সোজা বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পে। উদ্দেশ্য ‘আয় তব সোমেশ্বরী’! – ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড় থেকে উৎপত্তি লাভ করা যে নদী আমাকে মুহুর্মুহু ডাকছিল তার নিজস্ব ভাষায়। সেখানে ঘাট থেকে নৌকা সংরক্ষণ করে ছুটে চললাম সোমেশ্বরীর বুকে। সুবহানাল্লাহ! এই নদীর শীতকালের হিমশীতল স্পর্শ,কুয়াশা মোড়ানো বিস্তৃত জলরাশি আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গারো পাহাড়গুলো এমন এক মায়াবী রূপ ধারণ করে ছিল,যা সেখানে না গিয়ে অনুভুতি লিখে প্রকাশ সম্ভব নয়।
মূলত সোমেশ্বরীর তলদেশ সম্পূর্ণ খনিজ বালু দিয়ে ভরা, এখানকার প্রান্তিক জনগণ তাদের জীবিকার তাগিদে বালু খুঁড়ে কয়লা উত্তোলন করে৷ এই কনকনে ঠান্ডায় তাদের মতোই কয়েকজন হাঁটু সমান পানিতে কয়লা উত্তোলন করছিলেন। নদীর দক্ষিণ দিকে ভেসে যেতে যেতে এক পর্যায়ে দেখলাম ‘রাণীর গুহা’ নামক একটি পাদদেশ। সেখানকার একটা বিরাট অংশের পানি একদম সিলেটের লালাখালের মত নীলাভ আকার ধারণ করে ছিল। সে এক মায়াবী দৃশ্য!
এবার নদী ঘুরে ফেরার পালা। বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পের শূন্যরেখা দেখে এলাম ‘কমলা বাগান পাহাড়’। যদিও এখানে কমলার বাগান ছিলনা, তবে উঁচু টিলা থেকে পুরো ভারতের মেঘালয় অংশের অনিন্দ্য সুন্দর ভিউ অবলোকন করা যায়। পাহাড়ের নিচে বিভিন্ন ধরণের ভারতীয় প্রসাধনী সামগ্রী,তামাকজাত দ্রব্য, চকলেট আর ফলমূলের পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানপাট।
সিরামিক বা চীনামাটির পাহাড়
বিরিশিরি ইউনিয়নের বিজয়পুরের কুল্লাগড়া গ্রামের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর জায়গা হচ্ছে সাদা/সিরামিক বা চীনামাটির পাহাড়। এ পাহাড় ও সমভূমি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৬ কি.মি.এবং প্রস্থে প্রায় ৬০০ মিটার চওড়া৷ প্রথম পাহাড়ের পাদদেশের একটি লেক সবুজাভ হলেও পাশে আরো একটি পাহাড়ের হ্রদের পানি পুরোটা ক্রিস্টাল(নীলাভ)রঙা। সাদা মাটি পানির রঙটাকে যেন আরো বেশি গাঢ় করে দিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় লালচে মাটি ও দেখা যায়। পাহাড় থেকে মাটি কাটায় সেখানে হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে যার পানি কোথাও স্বচ্ছ নীল কোথাও সবুজাভ নীল কোথাও বা একদম লাল। তবে লাল পানি এখন নেই বললেই চলে। এই হ্রদের নীল জল যেন আমার সমস্ত অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করে দিয়েছিল। আর এসব হ্রদের পানিতে চোখ পড়তেই এতদূর আসার সব কষ্টগুলো নিমিষেই মিলিয়ে গেছে। এক কথায় অসাধারণ! সবুজ সমতল মেঠোপথ, বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত আর পাহাড়ের চূড়ায় অবতরণ করার অনুভূতি ছিল আকাশচুম্বী!
এছাড়াও সেখানে গেলে আরো দেখা মিলবে ‘টং’ ভাষাভাষী হাজং সম্প্রদায়ের জনজীবন,রানীখং মিশন চার্চ,সাধু যোসেফ পল্লী সহ উপজাতী জীবনধারা সংক্রান্ত সুবিশাল সংগ্রহশালা ‘বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী’। যদিও দিবাদৈর্ঘ্যের স্বল্পতার কারণে আমার এই জায়গাগুলো দেখার অপূর্ণতা থেকে গিয়েছিল।
বিরিশিরি যাওয়ার উপায়
আবহমান বাংলার এক বিচিত্র ও নিগূঢ় -সুপ্ত সৌন্দর্যের উৎস হলো নেত্রকোণার সুসং দূর্গাপুর। ঢাকার মহাখালী থেকে সরাসরি বিরিশিরি যাওয়ার দিবা-রাত্রি কালীন বাস পাওয়া যায়৷ এছাড়া ট্রেনযোগে কমলাপুর বা বিমানবন্দর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে বা নেত্রকোণার শ্যামগঞ্জ স্টেশনে নেমে লোকাল পরিবহন ধরে সহজেই যাওয়া যায় দূর্গাপুরে। আর সেখানে রাতে অবস্থানের জন্য বিরিশিরি বাজারে কিছু মধ্যম মানের আবাসিক হোটেল আছে,সেখানেই থাকা যাবে। খাবারদাবারের জন্য ভালো রেস্টুরেন্ট আছে দূর্গাপুর বাজারে।





বিরিশিরি ভ্রমণে যা যা দেখবেন
১. গারো পাহাড়
২. দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি
৩. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি
৪. টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ
৫. সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী
৬. হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ
৭. সাদা মাটির পাহাড়
৮. সোমেশ্বরী নদী
৯. কংশ নদী
১০. আত্রাখালি নদী
১১. কমলা রানির দীঘি
আরও পড়ুন
তারা মসজিদ: পুরান ঢাকার ঝলমলে তারার ঐতিহ্য
তারা মসজিদStar Mosque পুরান ঢাকার আরমানিটোলার আবুল খয়রাত সড়কে দাঁড়িয়ে আছে এক ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য—তারা মসজিদ।…
সারা লাইফস্টাইল | SaRa Lifestyle Ltd.
কাপ্তাই লেক: বাংলাদেশের প্রকৃতির এক অপরূপ নিদর্শন
কাপ্তাই লেকKaptai Lake প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মোড়ানো রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই লেক এমন একটি স্থান, যেখানে…
মথুরাপুর দেউল
কুতুব শাহী মসজিদ: ঐতিহ্যের এক অপূর্ব নিদর্শন
Kutub Shah Mosque.কুতুব মসজিদ (কুতুব শাহ মসজিদ), অষ্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ.কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত কুতুব শাহী…