ছন ও তালপাতার ঝুড়ি Basket made of chon grass and palm leaves x bfa x fxyz V2

ছন ও তালপাতার ঝুড়ি: এক হারিয়ে যাওয়া লোকজ শিল্পের গল্প

ছন আর তালপাতা দিয়ে তৈরি এই ঝুড়িগুলো শুধু প্রয়োজন মেটাতো না, গ্রামীণ মানুষের সৃজনশীলতা আর প্রকৃতির সাথে একাত্মতার গল্পও বলতো।

ছন ও তালপাতার ঝুড়ি

Basket made of
chon and
palm leaves
.

আমরা এখন পরিবেশবান্ধব পণ্য এবং টেকসই জীবনধারার কথা বলছি। কিন্তু একটা সময়, বুঝে বা না বুঝে, আমরা প্রকৃতির খুব কাছাকাছি ছিলাম। সেসব দিনগুলোতে আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ধাপে পরিবেশের সাথে একাত্ম থাকার ছাপ দেখা যেত। ছন ও তালপাতার ঝুড়ি সেই সময়ের এক অনন্য উদাহরণ। একসময় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে থাকা এই ঝুড়ি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। তবু নতুন করে এসব ঝুড়ির চাহিদা বেড়ে চলেছে, যা সত্যিই আশার আলো জাগায়।

ছন আর তালপাতার ঝুড়ি—গ্রামের জীবনের একসময়কার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছোটবেলার সেই দিনগুলো কি মনে পড়ে? উঠোনের ধারে মাটির চুলার পাশে বসে মুড়ি আর পাটালি গুড় মুখে পুরে কতো সুখের সময় কাটাতাম। সেই মুহূর্তগুলোর সঙ্গে এসব ঝুড়ি যেন এক অদ্ভুত বন্ধন তৈরি করেছিল। মুড়ি রাখতে, গুড় রাখতে, এমনকি শীতকালে শুকনো খড়কুটো জমা করতেও এই ঝুড়িগুলোই ছিল হাতের কাছে।

ছন আর তালপাতা দিয়ে তৈরি এই ঝুড়িগুলো শুধু প্রয়োজন মেটাতো না, গ্রামীণ মানুষের সৃজনশীলতা আর প্রকৃতির সাথে একাত্মতার গল্পও বলতো। তালগাছ থেকে পাতা কেটে এনে মমতায় বুনতেন গ্রামের নারীরা। তাঁদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় জন্ম নিতো ঝুড়ি—যেন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক শিল্পকর্ম।

প্রকৃতি থেকে শিল্পে

ছন এবং তালপাতা—প্রকৃতির দুই আশীর্বাদ। ছন ও তালপাতার ঝুড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ হলো তালগাছের পাতা এবং মাঠের ছন। তালগাছ থেকে সংগ্রহ করা পাতাগুলো শুকিয়ে নিয়ে তা দিয়ে তৈরি করা হয় নানা ধরনের ঝুড়ি, ডালা, পাখা এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। ছন, যা সাধারণত জলাভূমি বা মাঠে পাওয়া যায়, তা দিয়ে তৈরি করা হয় মজবুত ও টেকসই ঝুড়ি। এই শিল্পকর্মে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক ফুটে উঠে।

শিল্পের পেছনের মানুষ

এই শিল্পের মূল কারিগর হলেন গ্রামের নারীরা। তারা তাদের সাংসারিক কাজের ফাঁকে ছন ও তালপাতা দিয়ে ঝুড়ি বুনেন। এটি তাদের জন্য আয়ের একটি অন্যতম উৎস। অনেক নারী এই কাজটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিখে আসছেন। তাদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় সাধারণ তালপাতা ও ছন রূপ নেয় সুন্দর ও কার্যকরী শিল্পকর্মে।

ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্পেও এসেছে নতুনত্ব। এখন শুধু সাধারণ ঝুড়ি নয়, রঙ-তুলির ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের ডিজাইন। গ্রামীণ জীবনের চিত্র, ফুলের নকশা বা জ্যামিতিক প্যাটার্ন দিয়ে সাজানো হয় ঝুড়িগুলো। এগুলো শুধু গ্রামেই নয়, শহরের বিভিন্ন মেলায় এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও বিক্রি হচ্ছে। তাই যদি কখনো গ্রামের পথে চলতে চলতে কোনো তালপাতার ঝুড়ি চোখে পড়ে, একটু থেমে দেখবেন। হয়তো সেই ঝুড়ি আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে কোনো এক শৈশবের গ্রামবাংলার উঠোনে, যেখানে ছন আর তালপাতার ঝুড়ি শুধু পণ্য নয়, স্মৃতির ভাণ্ডার।

ছন ও তালপাতার ঝুড়ি
image source: internet

গরমের এক দুপুরে হাপুনিয়া গ্রামের পথে

গ্রামের পথ ধরে হাঁটছি হাপুনিয়া গ্রামের দিকে। পথের দুই ধারে ছোট ছোট বাড়ি, উঠোনে নারীরা বসে ব্যস্ত হাতে কিছু একটা বুনছেন। এটাই সেই হাপুনিয়া, বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের ছোট্ট কিন্তু প্রাণবন্ত গ্রাম। এখানে ছন ও তালপাতার ঝুড়ি তৈরির ঐতিহ্য আজও টিকে আছে। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে আছে কঠোর পরিশ্রম, শিল্পের প্রতি ভালোবাসা এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্কের গল্প।

হাপুনিয়া গ্রামের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে এক গভীর বন্ধন গড়ে তুলেছে। গ্রামের নারীরা তাদের দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ছন ও তালপাতা দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের ঝুড়ি, ডালা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। তালগাছ থেকে সংগ্রহ করা পাতা আর মাঠের ছনকে কাজে লাগিয়ে তারা তৈরি করেন নানান রকমের ডিজাইন। এই শিল্পকর্ম শুধু দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মেটায় না, এটি তাদের সৃজনশীলতা ও শিল্পীসত্তারও প্রকাশ।

শুধু হাপুনিয়া নয়, আশপাশের গ্রামগুলোতেও এই শিল্পকর্ম দেখা যায়। ছন ও তালপাতা দিয়ে পন্য তৈরির কাজ করছে ৩৫টি গ্রামে প্রায় ৮ হাজার নারী। তাদের হাতে তৈরি এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

মহিপুর, বনমরিচা, গোসাইবাড়ী, বাগড়া, তাজপুর, পেচুঁল, টুনিপাড়া এবং ভাটগাড়ীর মতো গ্রামের অসংখ্য নারী ঝুড়ি ও ডালা তৈরির কাজে জড়িত। এটি তাদের জন্য আয়ের একটি অন্যতম মাধ্যম। গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত এসব রকমারি পণ্য তৈরি করে অভাব দূর করার পাশাপাশি তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন।

গ্রামের আনোয়ারা বেগমের কথায় ফুটে উঠেছে এই সংগ্রামের ছবি। তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকেই মা-দাদিদের সঙ্গে ঝুড়ি বানানোর কাজ করি। আমাদের কাজ সুন্দর হলেও অনেক সময় সঠিক দাম পাই না। তবুও আমি আশা ছাড়ি না।”

এই গল্পটি শুধু হাপুনিয়া গ্রামের নয়, বাংলাদেশের অসংখ্য গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ধরে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

হাপুনিয়ার ছন ও তালপাতার ঝুড়ি শুধু একটি পণ্য নয়, এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের একটি জীবন্ত প্রতীক। এটি টিকে থাকুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, সৃজনশীলতা ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বন্ধনের এক অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে।

খড়, ছন ও তালপাতা শিল্পের শুরুটা

উল্লেখ্য ঢাকা থেকে আসা একজন ব্যবসায়ী ১৯৮৫ সালে নারীদের হাতে তুলে দেন কাশফুলের খড়, ছন ও তালপাতা। সেখান থেকেই শুরু হয় ডালা-ঝুড়ির মতো শৌখিন হস্ত শিল্প তৈরি। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামজুড়ে শুরু হয়ে যায় এ হস্ত শিল্প। নারীদের তৈরি করা এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি শুরু করেন ঢাকা থেকে আসা ওই ব্যবসায়ী। ১৯৯০ সাল থেকে ডালা (ছন ও তালপাতার তৈরি) হস্তশিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে। ( ঢাকা ক্রাইম বিডি )

ছন ও তালপাতার ঝুড়ি

ছন ও তালপাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে ঝুড়ি, বাটি, ডালা, কড়াই, ট্রে ও পাটিসহ বিভিন্ন নান্দনিক নিত্যব্যবহার্য বস্তু 





Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!