tal pakha craft of bangaldesh তালপাখা X bfa x fxyz

তালপাখা: স্মৃতি, শিল্প, এবং জীবিকার মেলবন্ধন

“শীতের কাঁথা, বর্ষার ছাতা আর গরমের পাখা”—এই কথা শুনলেই বাঙালির জীবনের সহজাত ও চিরকালীন চিত্রটি সামনে ভেসে ওঠে।

তালপাখা -র বিবর্তন ও ঐতিহ্যের ইতিবৃত্ত

Talpatar
Haat
Pakha

“শীতের কাঁথা, বর্ষার ছাতা আর গরমের পাখা”—এই কথা শুনলেই বাঙালির জীবনের সহজাত ও চিরকালীন চিত্রটি সামনে ভেসে ওঠে। হাত পাখা, যা এককালে বাঙালির নিত্য সঙ্গী ছিল, তা কেবল দৈনন্দিন ব্যবহারের বস্তু নয়, বরং এক ঐতিহ্যের অংশ। গ্রিক ও রোমান সভ্যতার যুগ থেকে শুরু করে আজকের দিনে, এই হাত পাখার ব্যবহার ও বিবর্তনের ইতিহাস এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে।

প্রথম দিকে হাত পাখার নকশা ছিল অত্যন্ত সহজ। সেগুলো ছিল ভাঁজহীন, একগুঁয়ে কাঠামোর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর আকার ও গঠনেও পরিবর্তন আসে। ইউরোপীয় বণিকেরা চিন ও জাপানের কাছ থেকে ভাঁজযুক্ত বা ফোল্ডিং পাখার ধারণা শিখে নেন এবং সেই নকশা বিভিন্ন দেশে আমদানি করেন। এরপর আঠারো শতকের প্রথম দিকে ইউরোপেই পাখা তৈরি শুরু হয়। তবে সেগুলো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল, কারণ তখন এই পাখাগুলো ছিল অত্যন্ত দূরমূল্য।

তখনকার দিনে পাখার উপরে নানা কারুকার্য ও অলংকার বসিয়ে একে আরও দৃষ্টিনন্দন করা হত। পাখার নকশার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হতো তখনকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি। এমনকি চিন থেকে আমদানি করা কারুকার্যময় পাখার চাহিদাও ছিল বিপুল।

আজ এই ঐতিহাসিক হাত পাখার নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে লন্ডনের গ্রিনিচ মিউজিয়ামের মতো বিখ্যাত স্থানে। এই নিদর্শনগুলো কেবল পাখার শৈল্পিক ও ঐতিহাসিক মূল্যকেই তুলে ধরে না, বরং আমাদের অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগও সৃষ্টি করে।

পাখার বিবর্তনে তালপাখার ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে, এটি শুধুমাত্র একটি উপকরণ নয়; বরং বাঙালির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

তালপাখা: লোকজ ঐতিহ্যের রঙে মিশে থাকা জীবন

প্রাচীন কাল থেকেই তালপাখা কেবল একটা পাখা নয়, বরং একটি আবেগ। লোকগাঁথায় তো এমনটাই বলা হয়, “আমার নাম তালের পাখা, শীতকালে দেই না দেখা, গ্রীষ্মকালে প্রাণের সখা”। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির শিল্পী আকবরও তালপাখার প্রেমে গেয়ে উঠেছিলেন, “তোমার হাতপাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে।” এই তালপাখার বাতাসে ঠিক কত প্রাণ জুড়েছে, তার হিসাব দিতে পারে একমাত্র বৈশাখের দাবদাহ। আর এ কারণেই গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এই তালপাখাকে বলা হয় “প্রাণের সখা”।

তালপাখা এমন এক আবিষ্কার, যা কখনো পুরোনো হয় না। বরং তার বাতাসের স্নিগ্ধতাই তাকে চিরতরে জীবন্ত করে রাখে। প্রাচীন, সস্তা, কিন্তু অমূল্য এই তালপাখা আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা।

তালগাছ শুধু পাখা তৈরির উপকরণই নয়, এটি পরিবেশ রক্ষার এক অসাধারণ সৈনিক। মাটির ক্ষয় প্রতিরোধ, বন্যার সময় পানি ধরে রাখা, এবং গ্রামীণ এলাকার বায়ু পরিশোধনে তালগাছের গুরুত্ব অপরিসীম। পাখিদের নিরাপদ বাসস্থান হিসেবেও তালগাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একসময়ের অবহেলিত এই গাছের গুরুত্ব পরিবেশবান্ধব গ্রামীণ জীবনযাত্রায় এখনো অপরিহার্য।

ছবি সূত্র: প্রথম আলো

গল্পের শুরু
হাঁপানিয়া থেকে

নাটোর শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের হাঁপানিয়া ফকিরপাড়া গ্রামে ঢুকলেই দেখা যায় এক অদ্ভুত কর্মচাঞ্চল্য। যেন গ্রামবাসী মিলে এক মহাযজ্ঞে মেতেছে। কেউ তালের পাতা কাটছেন, কেউ রোদে শুকোতে দিচ্ছেন। আবার কেউ সুতায় রঙ মেখে পাখাকে করে তুলছেন একেবারে ফ্যাশনেবল। শরীর থেকে ঘামের ঝরনা বইলেও তাদের চোখেমুখে রয়েছে এক অদ্ভুত তৃপ্তি।
এ গ্রামে একশো পরিবারের জীবন চলে তালপাখার বাতাসেই। একসময় তালগাছ না থাকা সত্ত্বেও হাঁপানিয়া এখন “তালপাখার গ্রাম” নামে পরিচিত। বছরের ছয়টি মাসে হাতপাখা তৈরি করে বাড়তি উপার্জন করছেন শতাধিক পরিবার। অনেকে এ গ্রামে বউ হয়ে আসার পর থেকে শুরু করে এখনও তালপাখা তৈরি করে যাচ্ছেন। তালপাখা তৈরি করেই সন্তানদের মানুষ করেছেন ও বিয়ে দিয়েছেন। এখন তাদের পুত্রবধূও সংসারে বাড়তি উপার্জনের জন্য পাখা তৈরি করে যাচ্ছে।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি তালগাছ-বেষ্টিত গ্রাম , যেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা “তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’”কে বাস্তব রূপ দিয়েছে। পুরো গ্রামজুড়ে আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। এই গ্রামেও নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে বছরের অনেকটা ব্যস্ত সময় পার করে। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে

আধুনিক যুগে তালপাখার ব্যবহার

তালপাখা আজ শুধু গ্রামীণ জীবনেই সীমাবদ্ধ নয়। শহরের আধুনিক মানুষদের কাছে এটি এখন একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। বিভিন্ন কফিশপ বা রেস্তোরাঁয় তালপাখাকে সৃজনশীল উপায়ে দেয়াল সজ্জা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকেই এটি সংগ্রহ করেন ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে।

tal pakha তালপাখা x bfa x fxyz (8)

আঞ্চলিক মেলায় তালপাখা

তালপাখার রঙিন দুনিয়া সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বৈশাখী মেলায়। তবে শুধু বৈশাখী মেলাতেই নয়, চৈত্রসংক্রান্তি, পহেলা ফাল্গুন এবং ঈদ মেলাতেও তালপাখা দেখা যায়।

পাখা তৈরির প্রক্রিয়া: একটি শিল্পের বুনন

তালপাখা তৈরির কাঁচামাল হলো তালের পাতা, যা স্থানীয় ভাষায় ডাগুর নামে পরিচিত। প্রতি বছরের আশ্বিন মাসে নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহ করা হয়। এই ডাগুরগুলোকে পাখার আকারে গোল করে কেটে রোদে শুকানো হয়। অন্যদিকে বাঁশ চিকন চিকন করে কেটে রাখা হয় পাখা পাখার মুরি বাধার জন্য। এরপর চৈত্র মাসের শুরু থেকে মুলত পাখা তৈরির মুল কাজ শুরু হয়। যা চলে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। শুধু ডাগুর হলেই হবে না, পাখার সৌন্দর্য বাড়াতে লাগে বাঁশ, সুতা, আর রঙের ছোঁয়া। কারিগররা পাখাগুলো সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ ব্যাবহার করেন। তাদের আঁকাবাঁকা ডিজাইন আর রঙের বাহারে পাখাগুলো যেন চিত্রকর্মের মতো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এক একটি তালের পাতা থেকে তৈরি হয় দুইটি বড় ডাগুর পাখা, চারটি ঘুরানী পাখা, এবং ছয়টি পকেট পাখা।

গল্পের মাঝখানে
কিছু তথ্য

এক বৃদ্ধা বলেন, “আমার বউ হওয়ার পর থেকেই এই কাজ করি। তালপাখা বানিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছি। এখন তারাও বানায়। আমরা যেন তালপাখার যুগে বাঁচি।”

কিন্তু এই রোমান্টিক গল্পে একটু দুঃখের সুরও আছে। পাখা তৈরির জন্য একশো পিস বানিয়ে মজুরি পাওয়া যায় মাত্র ৩৫ টাকা! তিন থেকে পাঁচজন নারী মিলে কাজ করলে ঘণ্টায় মাত্র ৩০০টির মত পাখা বানাতে পারেন। তবু জীবন কাটানোর জন্য এই পাখাই তাদের ভরসা। তালপাখা যে শুধু পাখা নয়, বরং একটা অনুভূতি!

এক বৃদ্ধ কারিগর বলেন, “তালপাখা আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে আত্মনির্ভর হতে হয়। কিন্তু ঋণ পেলে হয়তো আরেকটু ভালোভাবে বাঁচতে পারতাম।”



পাখার বাজারে
তালপাখার কদর

ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর থেকে শুরু করে দেশের নানা জায়গায় তালপাখার কদর রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা নাটোরে আসেন তালপাখা কিনতে। ১১ টাকায় পকেট পাখা, ২০ টাকায় ঘুরানী পাখা আর ৩০ টাকায় ডাগুর পাখা কিনে নিয়ে যান ব্যাপারীরা। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।







Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!