nakshi pakha Bangladesh নকশি পাখা আমাদের ঐতিহ্য x bfa x fxyz

নকশি পাখা: বাতাসে লুকানো ঐতিহ্যের গল্প

‘হাতপাখা? ওটা তো গ্রামের জিনিস!’—তাও তার বাড়িতে কোথাও একটা নকশি পাখা লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

NAKSHI PAKHA

নকশি পাখা

“তোমার হাতপাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে,

আরো কিছু সময় তুমি থাকো আমার পাশে।”

এমন গান শোনেনি বা হাতপাখার নরম বাতাসে গরমের ক্লান্তি ভুলে যায়নি—এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। শহরের এসি-পড়া জীবনেও, কেউ যদি বলে, ‘হাতপাখা? ওটা তো গ্রামের জিনিস!’—তাও তার বাড়িতে কোথাও একটা নকশি পাখা লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, এই পাখা শুধু বাতাস দেয় না, এটি নিয়ে আসে নানী-দাদীর স্মৃতি, বাংলার ইতিহাস আর গ্রামীণ জীবনের অকৃত্রিম গল্প।

Nakshi Pakha নকশি পাখা x bfa x fxyz zainul mela (18) - Copy

নকশি পাখা:
বাংলার
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

.

নকশি পাখা বাংলার গ্রামীণ হস্তশিল্পের এক অপূর্ব সৃষ্টি। এটি হাতে তৈরি একধরনের পাখা, সাধারণত তালপাতা, বাঁশ বা অন্যান্য প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে তৈরি। এর বিশেষত্ব হলো এর উপর করা সূক্ষ্ম নকশা বা কারুকাজ, যা বাংলার শিল্পীদের সৃজনশীলতা ও নিপুণতার অনন্য পরিচয় বহন করে। “নকশি” শব্দটি এসেছে “নকশা” থেকে, যার অর্থ নান্দনিক নকশা বা নিপুণ কারুকাজ।

নকশি পাখার শেকড় বাংলার গ্রামাঞ্চলে, যেখানে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে এই পাখা যেন শীতল বাতাসের সঙ্গী। প্রাচীনকাল থেকেই এটি কেবল একটি কার্যকরী উপকরণ নয়, বরং শিল্পের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গ্রামের নারীরা অবসরে এ পাখাগুলোর উপর ফুল, পাতা, পাখি কিংবা জ্যামিতিক নকশা আঁকতেন, যা তাদের সৃজনশীলতার পরিচয় দিত।

হাতপাখার ধরণে বৈচিত্র্যের কথাও উল্লেখযোগ্য। তালপাতার সহজ-সরল পাখার পাশাপাশি বাঁশ বা বেত দিয়ে বোনা পাখা, যেগুলোর আকৃতিতে মেলে শিল্পের ছোঁয়া। বেতের ফালি দিয়ে তৈরি এসব পাখা যখন রঙিন বুননে সজ্জিত হয়, তখন তা দূর থেকে শিল্পকর্মের মতোই মনে হয়। তবে সবকিছুর শীর্ষে আছে নকশি পাখা—রঙিন সুতোর সূচিকর্মে সজ্জিত, যেন হাতে ধরা এক টুকরো কবিতা।

নকশি পাখার সূচিকর্ম অনেকটা নকশি কাঁথার মতো। ছোট জমিনে ফুল, লতাপাতা, পাখি কিংবা ভালোবাসার চিহ্ন ফুটিয়ে তোলার হয়। কখনো কখনো পাখার গায়ে ফুটে উঠত ছোট ছড়া বা প্রবাদ, যেমন: “যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে”  ‘দিন যায় কথা থাকে, সময় যায় ফাঁকে ফাঁকে’ ইত্যাদি। এমন সূচিকর্ম শুধু পাখার অলঙ্করন নয়, মনকেও আন্দোলিত করত।

এমনকি পাখাগুলোর নামেও রয়েছে সৃজনশীলতা—‘পদ্ম পাঙ্খা’, ‘পাঁচ ফুইল্যা’, ‘শত ফুইল্যা’। এছাড়া ‘ভালোবাসা’, ‘কাঁকইর জালা’, ‘শঙ্খলতা’, ‘যুগল ময়ূর’—একেকটা নাম যেন একেকটা গল্প বলে। একবার মেলায় সন্ধ্যা রানী নামক একজন কারিগর বলেছিলেন, “যেই পাখায় একশো ফুল, সেটা শত ফুইল্যা; আর যেটায় পাঁচটা, সেটা পাঁচ ফুইল্যা!” কত সহজ, অথচ কী সুন্দর, তাই না!

tal pakha তালপাখা x bfa x fxyz

.

ফ্যাশন হাউজ প্রবর্তনা

বর্তমানে নকশি পাখা শুধু গ্রামে সীমাবদ্ধ নেই। অনেক শিল্পী ও ডিজাইনার এটিকে আধুনিক রূপ দিয়ে হস্তশিল্প মেলা বা প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করছেন। এছাড়া কফিশপ বা রেস্তোরাঁয় নকশি পাখা সৃজনশীল উপায়ে দেয়াল সজ্জা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকেই এটি সংগ্রহ করেন ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে।

নকশি পাখার সঙ্গে ভালোবাসার একটা আলাদা সম্পর্ক আছে। নকশি পাখা প্রিয়জনকে উপহার হিসেবে দেওয়া হতো। সুতোর নকশায় যেন হৃদয়ের কথাটুকু পাঠিয়ে দেয়া হতো। যেমন: “যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে”

তালপাখা: স্মৃতি, শিল্প, এবং জীবিকার মেলবন্ধন

“শীতের কাঁথা, বর্ষার ছাতা আর গরমের পাখা”—এই কথা শুনলেই বাঙালির জীবনের সহজাত ও চিরকালীন চিত্রটি সামনে ভেসে ওঠে।

হাত পাখার ব্যবহার ও বিবর্তনের ইতিহাস  পড়ুন এই লিংকে –

নকশি পাখা
কী দিয়ে
বানানো হতো?


হাতপাখা মানেই যে শুধু তালপাতার পাখা, তা কিন্তু নয়। গ্রামবাংলায় পাখার রকমফের দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তালপাতার পাখা তো আছেই—সাধারণ, সস্তা, গরম থেকে বাঁচার জন্য এক নম্বর সঙ্গী। তারপর আছে বাঁশ বা বেতের পাখা। এগুলো বানানো হতো পাটি বোনার স্টাইলে—বাঁশ ফালি করে সরু বেতি বের করে, তারপর বুনন দিয়ে গোল বা চারকোণা আকৃতি। রঙিন বেতি কিছুটা দিয়ে বোনা হলে তো কথাই নেই, ( কিছুটা বটনি পাটির মতরে করে চারপাশে বাঁশের চাওঢ়া দিয়ে ফ্রেম করে। যা দূর থেকে দেখলে মনে হবে পাখা না, কোনো শিল্পকর্ম!

নকশি পাখার উপকরণও ছিল সহজলভ্য—তালপাতা, সুপারির পাতা, বাঁশ, বেত, পুরনো কাপড়, সুতা, এমনকি পাখির পালক বা নারকেল পাতা। এগুলো রঙে রাঙিয়ে নকশা করা হতো। নকশি কাঁথায় যেমন ফোঁড় থাকে, এখানেও থাকে নিজস্ব গ্রামার। বেত দিয়ে বোনা পাখায় তিনকোণা, চারকোণা বা জ্যামিতিক নকশা ফুটত। চট্টগ্রামের সুতার পাখা তো আলাদাই আকর্ষণীয়। আর নকশার নামগুলো? ‘ভালোবাসা’, ‘কাঁকইর জালা’, ‘শঙ্খলতা’, ‘যুগল ময়ূর’—একেকটা নাম যেন একেকটা গল্প বলে।

বাঁশের পাখার ক্ষেত্রে নামগুলো যেমন আলাদা, তেমনি সুন্দর: গুয়াপাতা, তারাফুল, ছিটাফুল, কাঁকইর জ্বালা, ভালোবাসা, গম্বুজ-তোলা, হাতি-ফুল-মানুষ, লেখা। এই নামগুলোর মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের রঙিন ছোঁয়া।

বেতের পাখাও পিছিয়ে নেই; এর জন্য আছে সহজ, কিন্তু গভীর অর্থবহ নাম: পালংপোষ, পাশার দান। এমন নামগুলো শুধু ব্যবহারিক অর্থে পাখাকে গুরুত্বপূর্ণ করে না, এগুলো বাংলার লোকজ জীবনের প্রতিচ্ছবিও বহন করে।

নকশি পাখা
image source: sonargaonmuseum.gov.bd

বাসন্তী সূত্রধরের গল্প



নকশি পাখা আমাদের ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত নিদর্শন। এটি কেবল শিল্প নয়, বরং আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনধারা ও সৃজনশীলতার একটি স্মারক। আধুনিক যুগে এর চাহিদা কমলেও, এটি যেন হারিয়ে না যায়—এই দায়িত্ব আমাদের। তাই পরের বার গ্রামের মেলায় গেলে একটা নকশি পাখা কিনে আনুন। বাতাস করুন, আর ভাবুন—এই ছোট্ট পাখায় কত গল্প লুকিয়ে আছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!