শাহ আব্দুল করিমের গান লোকগীতি Folk Song Shah Abdul Karim x bfa x fxyz

জীবন্ত কিংবদন্তি বাউল শাহ আবদুল করিম: ভাটি বাংলার মাটির মানুষ

সংসারে যখন নুন আনতে পানতা ফুরোয়, তখনও তিনি তার অন্তরের তাগিদে গান গাইতেন।

“জন্ম নিয়েছি যখন জীবনের গান গাই মানুষ মানুষের মত বেঁচে থাকতে চাই।”
-বাউল শাহ আবদুল করিম
.

Shah Abdul
Karim
.

বাংলার ভাটি অঞ্চলের সুর, ছন্দ, এবং মানুষের জীবনসংগ্রামের কথা শুনলেই যে নামটি প্রথমে মনে আসে, তা হলো বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম। দারিদ্র্য, সংগ্রাম আর সুরের জাদুতে মোড়ানো এই কিংবদন্তির জীবন যেন এক মহাকাব্য। যাবে কৃষিকাজ আর দারিদ্র্য কখনো দমাতে পারেনি। জীবনের প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি রচনা করেছেন প্রায় ৫০০ গান, যার মধ্যে “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”, “বন্দে মায়া লাগাইছে”, “গাড়ি চলে না”, “রঙের দুনিয়া” ইত্যাদি গান আজও মানুষের মুখে মুখে। ইব্রাহিম আলী ও নাইওরজানের ঘরে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানার উজানধল গ্রামে জন্ম নেওয়া এই সুরসাধক জীবনের প্রতিটি ধাপে লড়াই করে সৃষ্টি করেছেন এমন এক ধারার সঙ্গীত যা আজও হৃদয়ের গভীরে দাগ কাটে। বাংলা সঙ্গীতে তাঁকে বাউল সম্রাট  হিসাবে সম্বোধন করা হয়।তিনি বাংলা সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০০১ সালে একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত হন।

বাউল শাহ আবদুল করিম শুধুমাত্র একটি নাম নয়; সুরের আন্দোলন। তার গানের কথা বলে সমাজের অন্যায়, অবিচার আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। আজও তাঁর গান আমাদের অনুপ্রাণিত করে ভালোবাসা, মানবিকতা এবং সত্যের পথে চলতে। শাহ আবদুল করিম ছিলেন মাটির মানুষ, যাঁর জীবনসংগ্রাম, প্রেম এবং সঙ্গীত বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে একাকার। তাঁর সুরে যেন লুকিয়ে রয়েছে বাংলার আত্মা। তাঁর গান আজও আমাদের শেখায় কীভাবে দারিদ্র্যকে জয় করে জীবনের প্রতিটি দিনকে উদযাপন করতে হয়।

শৈশব: সংগ্রামের হাতেখড়ি

.

দরিদ্র পরিবারের সন্তান শাহ আবদুল করিমের শৈশব কাটে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। পয়সাকড়ির অভাবে পড়াশোনা হয়নি বললেই চলে। অল্প বয়সে গ্রামের মহাজনের বাড়িতে গরু চরানোর কাজ শুরু করেন। ছিলেন মুদির দোকানের কর্মচারীও। এই কঠিন জীবনের মধ্যেই করিমের গানের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। সংসারে যখন নুন আনতে পানতা ফুরোয়, তখনও তিনি তার অন্তরের তাগিদে গান গাইতেন।

প্রেম আর প্রেরণার উৎস

.

শাহ আবদুল করিমের গানের অন্যতম প্রেরণা ছিলেন তার স্ত্রী আফতাবুন্নেসা। যাকে তিনি ভালোবেসে ডাকতেন ‘সরলা’। তাদের সম্পর্ক শুধু বৈবাহিক বন্ধন নয়, বরং জীবনের সকল চড়াই-উতরাইয়ে একে অপরের সঙ্গী ছিলেন। সরলার প্রতি তাঁর গভীর প্রেম তার অনেক গানে স্পষ্ট। স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে রচিত গানগুলো যেন একান্ত ব্যক্তিগত প্রেমকাব্য, যা মানবিক অনুভূতির চরম প্রকাশ।

লালন সাঁইজী Fakir Lalon Shah

সঙ্গীত সাধনা:
আধ্যাত্মিকতার গভীরে
.

করিমের গানের মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ। তাঁদের দর্শন এবং আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা করিমের সঙ্গীতকে গভীরতা ও অর্থবহ করে তুলেছে। তিনি কেবল শাস্ত্রীয় বাউল গানের চর্চা করেননি; শরীয়তী, মারফতি, নবুয়ত ও বেলায়াত ধারার গানেও পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।

তার সংগীতজীবনের গুরু ছিলেন শাহ ইব্রাহিম মাস্তান বকশ, সাধক রশীদ উদ্দীন এবং কামাল উদ্দীন। এই মহৎ ব্যক্তিদের কাছ থেকে তিনি গান শেখেন, যা তাকে আরও সমৃদ্ধ করে। করিমের গান ছিল তার জীবনের প্রতিচ্ছবি। একদিকে প্রেম, মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতা, অন্যদিকে অন্যায়, অবিচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা বারবার উঠে এসেছে তার গানে।

লালন ফকিরের জীবন ও ভাবনা বিষয় পড়ুন এই লিংকে –

শাহ আব্দুল করিমের গান লোকগীতি Folk Song Shah Abdul Karim x bfa x fxyz

জনপ্রিয়তার পথে যাত্রা
.

বাউল শাহ আবদুল করিম জীবদ্দশাতেই ভাটি অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর গাওয়া এবং লেখা প্রায় ৫০০ গান জীবনের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গান হলো:

“আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”

“বন্দে মায়া লাগাইছে”

“গাড়ি চলে না”

“ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ুরপঙ্খী নাও”

“তুমি রাখ কিবা মার”

“রঙের দুনিয়া তরে চায় না”

২০০০ সাল পর্যন্ত তাঁর গান মূলত ভাটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে তরুণ প্রজন্মের বিভিন্ন শিল্পী শাহ আবদুল করিমের গানগুলো নতুন সুরে পরিবেশন করলে তা দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তাঁর গানের আবেদন এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

Ekushey Padak একুশে পদক বাংলাদেশ x bfa x fxyz

সংগ্রাম এবং সম্মাননা
.

দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে কাটানো জীবনে করিম পেয়েছেন অগণিত সম্মাননা। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও বাংলা একাডেমি তাঁর ১০টি গানের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছে।

অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে:

কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরী পদক

রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার

মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার (আজীবন সম্মাননা)

সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস (আজীবন সম্মাননা)


২০০৬ সালে সাউন্ড মেশিন থেকে তাঁর জনপ্রিয় ১২টি গান নিয়ে ‘জীবন্ত কিংবদন্তি: বাউল শাহ আবদুল করিম’ নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবামের বিক্রয়লব্ধ অর্থ তাঁর চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।

বাউল শাহ আবদুল করিমের
মৃত্যুক্ষন
.

২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, শনিবার সকালে সিলেটের নুরজাহান পলি ক্লিনিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে দিনভর তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। ৯৩ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান, রেখে যান সুরের এমন এক ভাণ্ডার, যা কখনো ফুরাবে না।


আপনার একটি শেয়ার এবং মন্তব্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️


তথ্যসূত্র:  উইকিপিডিয়া, জাগোনিউজ২৪.কম, চ্যানেল আই অনলাইন, sunamganj.gov.bd,


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Instagram did not return a 200.
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!