ব্লক প্রিন্ট এর ইতিহাস
আজ থেকে ৪০০০ হাজার বছর আগে চায়নাতে মুলত কাঠের ব্লক প্রিন্ট এর প্রচলন শুরু হয়, এটি মুলত সিল্ক কাপড়ের উপরে অক্ষর ছাপানোর কাজে ব্যবহার করা হত। যদিও চীনারা তিন রঙের সমন্বয়ে ফুল, লতা, পাতা দিয়ে মুদ্রণ শুরু করে।
২২০ শতাব্দী
২২০ শতাব্দীর দিকে হান সাম্রাজ্যের রাজত্বকালে ব্লক প্রিন্ট এর যাত্রা শুরু হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, ইউরোপ থেকে শত শত বছর আগে এশিয়াতে ব্লক প্রিন্টের প্রচলন শুরু হয়।
দশম শতাব্দী
দশম শতাব্দীর দিকে মিশরে ব্লক প্রিন্টের ব্যবহার দেখা যায়, আরবিতে একে বলা হতো “তারশ”। সে সময় কাপড় মোমে চুবিয়ে নানা রকম নকশা করা হতো। সেই কাপড় দিয়ে মমি সংরক্ষণ করা হতো। পরবর্তীতে কাপড় ডিজাইন করার জন্য এই পদ্ধতি অনুসরণ করে- জাপান, ভারত, শ্রীলংকা, আফ্রিকা সহ বিভিন্ন দেশে ‘বাটিক’ নামে ছড়িয়ে পরে।
১২ শতাব্দী
১২ শতাব্দীতে ভারত উপমহাদেশে ব্লক প্রিন্টিং এর জন্য নিদিষ্ট কিছু সেন্টার তৈরি হলো, যেমন- সাউথ,ইস্টার্ন, ওয়েস্টার্ন উপকূলে ব্লকের টেক্সটাইল মিলগুলো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া গুজরাট , রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশে ব্লকের জন্য বিখ্যাত সব টেক্সটাইল মিল রয়েছে ।
১৬ এবং ১৭ শতাব্দী
১৬ এবং ১৭ শতাব্দীতে ব্লক শিল্পের জনপ্রিয়তা দারুনভাবে বেড়ে গিয়েছিলো। সেই সময়টা ছিল মোগলদের যুগ। মোগল অধ্যুষিত সময়ে সম্রাট শাহজাহান সৃষ্টিশীল এবং সৃজনশীল কাজকে দারুনভাবে প্রধ্যান্য দিত। এর প্রমান তাজমহলের বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায় । তাজমহলের বিভিন্ন অংশে ব্লক প্রিন্টিং এর ছোঁয়া ছিল।
১৭৬০
১৭৬০ সালে যখন জাপানে ব্লক প্রিন্টের প্রসার ঘটে তখন তিন রঙের মুদ্রনে সীমিত থাকে নি, বহু রঙের মুদ্রণে এটির ব্যবহার হতে থাকে। সাধারণত বই ছাপার কাজে এর মুদ্রন ব্যবহার হয়েছিলো। জাপানে এই প্রক্রিয়াকে বলা হতো “নিশিকি”।
১৯ শতক
১৯ শতকে ব্লক প্রিন্টিং শিল্পটা সারা বিশ্বে পরিচিতি পেতে শুরু করে। কেননা ঐ সময় টাতে বৃটিশরা বিভিন্ন দেশে বানিজ্য করা শুরু করে। ভারতে ব্লকের পোশাক নিয়ে তারা সারা বিশ্ব বানিজ্য করে। এবং তা ভারতের সৃষ্টিশীল এবং সৃজনশীল কাজ ধীরে ধীরে বিশ্বে ছড়িয়ে পরতে থাকে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ষাটের দশকে। তবে এই শিল্প রপ্তানি খাত হিসেবে বিকাশ লাভ করে সত্তরের দশকের শেষের দিকে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পাশাপাশি, দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো ১৬ কোটি মানুষের বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
শুরুর দিকে দেশীয় ফ্যাশনের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল ব্লক প্রিন্টের প্রাধান্য। এই প্রাধান্য ক্রমে পৌঁছে যায় ব্যক্তি পর্যায়ে। বাসা-বাড়িতে নিজেদের উদ্যোগে ব্লক প্রিন্টিং চলতে থাকে। একটি হাতে বানানো বিছানার চাদর বা পছন্দের নকশায় প্রিন্ট করা একটি শাড়ি বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম অংশ হয়ে ওঠে। এভাবে ব্লক প্রিন্টের ঐতিহ্য শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামাঞ্চলেও।
বর্তমানে ব্লক প্রিন্টিংয়ে জিওমেট্রিক ডিজাইনের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এর শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় মোগল যুগে, যখন ব্লক প্রিন্টে জিওমেট্রিক নকশার ব্যবহার শুরু হয়। একই সঙ্গে ফুল, পাখি, পশু ইত্যাদির মোটিফ যুক্ত হয়ে ব্লক প্রিন্টকে আরও নান্দনিক ও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
এই ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়া আজও বাংলাদেশের ফ্যাশন শিল্পে একটি অনন্য রূপ এবং নিজস্বতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
কোন কাপড়ে ব্লক প্রিন্ট করা যায়?
যে কোন কাপড় খন্ডেই ব্লক প্রিন্ট করা যায়। নির্ভর করছে সেই কাপড় খন্ড দিয়ে পরবর্তিতে কি বাননো হবে। সিল্ক, মাসলিন, সুতি এব কাপড়ে খুব সহজেই টেকসই প্রিন্ট করা যায় যা দিয়ে শাড়ি, ড্রেস, বিছানার চাদর, বালিশের কাপড়, পর্দা তৈরী করা যেতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে প্রিন্টং এর সময় পরিমানমত কেমিকাল এবং প্রিন্টিং এর পরে পর্যাপ্ত হিট আয়রন করে রং টা পাকা করতে হবে। তা হলে অনেক দিন পর্যন্ত ভালো থাকবে।
প্রিন্টিং-এ রঙের ধরন
ধরন বলতে প্রিন্টিং এর সময় রঙের ব্যবহার । সাধারণত দুই ধরনের রঙ ব্যবহার করা হয় । একটা রাসায়নিক, আরেকটা ভেজিটেবল বা অরগানিক রঙ । ভেজিটেবল বা অর্গানিক রঙ তৈরী করা সময় সাপেক্ষ এবং ঝামেলার। রাসায়নিক রঙের যাবতীয় জিনিসপত্র খুব সহজে পাওয়া যায় এবং ঝামেলা কম লাগে ।
ব্লক প্রিন্ট করতে কি কি লাগবে
কাপড়ে ব্লক প্রিন্ট করার জন্য রাসায়নিক রঙের ক্ষেত্রে ভাল রাসায়নিক দ্রব্যের দরকার। এতে রঙ টেকসই হবে। এই রাসায়নিকের সঙ্গে পছন্দমত রং গুলিয়ে নিতে হয়। যা যা থাকবে – এনকে, নিউট্রেক, এপিটন, এ৫৩, বাইন্ডার, গ্লিসারিন ইত্যাদি।
আর ডিজাইনের জন্য কাঠের নকশার ব্লক এবং রঙ লাগবে। আরও দরকার , রং গোলানোর ট্রে, কাপড় বিছিয়ে ব্লক করার জন্য টেবিল আর ব্লক করার আগে মূল কাপড়ের নিচে দেওয়ার জন্য ফোম অথবা মোটা কাপড়। ব্লক করার আগে বিষদ জেনে নিলে রঙ পাকা হবে । কারন, একেক কাপড়ে একেক পরিমান রাসায়নিক দ্রব্যের প্রয়োজন হয়।
রঙ তৈরি করা
বাজারে নানা রকম তৈরী করা রঙ পাওয়া যায়। চাইলে নিজেরাও পছন্দ অনুযায়ী রঙ তৈরি নিতে পারেন। সেইজন্য নীল, হলুদ, লাল, বেগুনী ও কালো এই পাঁচ রঙ কিনে নিচের নিয়ামানুযায়ী নতুন রঙ তৈরি করতে হবে।
হলুদ + লাল + নীল = মেরুন
কালো + সাদা = ছাই
নীল + লাল = বেগুনী
কমলা + নীল = চকলেট
লাল + হলুদ বেশি = বাদামী
লাল + বেগুনী = লালচে বেগুনী
কালো + সবুজ = গাঢ় সবুজ
হলুদ ২ গুণ + লাল ১ গুণ = কমলা


ব্লক প্রিন্ট এর আরও ছবি
ব্লক প্রিন্টের মুগ্ধতায় | THE BEAUTY OF BLOCK PRINT

প্রাদা কিনছে ভার্সাচি: দুই আইকনের একত্রীকরণ
bdfashion archive
তেহারী ঘর: এক প্লেট নস্টালজিয়া
fayze hassanতেহারী ঘর: ঐতিহ্যের স্বাদে একটি অনন্য অভিজ্ঞতা যদি কখনো সোবহানবাগের পথে যান, তেহারী ঘরে একবার…

আড়াই হাত থেকে বারো হাত: গামছা -র ফ্যাশন বিবর্তন
fayze hassan
হোগলাপাতা: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প
fayze hassan
নারিকেলের মালা: বর্জ্য থেকে বর্তমানের গল্প
fayze hassan
পোস্টটি করার জন্য ধন্যবাদ। ব্লকের ইতিহাস, পদ্ধতি ধাপে ধাপে বর্ণনা করার জন্য জাযাকাল্লাহ খইরন। এই পোস্ট টি থেকে অনেক জ্ঞান অর্জন করলাম যা আগে থেজেই আমার জানা ছিলোনা। এবং এতো সুন্দর করে তথ্য উপস্থাপন করা হলো যে নোট করতে বাধ্য হলাম। আবারো ধন্যবাদ।☺️
আপনার মন্তব্য সত্যিই আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। আমাদের দেশীয় ক্রাফট নিয়ে অন্যান্য নিবন্ধন গুলো পড়বেন। আপনার ভালো লাগবে। ভালো থাকবেন।