monipuri sharee মণিপুরী নৃ-গোষ্ঠীর জীবন ও তাঁতশিল্পের গল্প x bfa x fxyz V2 - Copy

মণিপুরী নৃ-গোষ্ঠীর জীবন ও তাঁতশিল্পের গল্প

মণিপুরী তাঁত প্রবাদ আছে—মণিপুরী নারীরা জন্মসূত্রেই তাঁতি। প্রায় ৯০ শতাংশ মণিপুরী নারী তাঁতের সঙ্গে যুক্ত।

মণিপুরী তাঁত
ছবিসূত্র: উইকিপিডিয়া

Manipuri indigenous people

মণিপুরী নৃ-গোষ্ঠী

বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সবুজ পাহাড় আর চা বাগানের মাঝে বাস করে মণিপুরী নৃ-গোষ্ঠী, একটি সম্প্রদায় যারা তাদের ঐতিহ্য আর শিল্পকুশলতার জন্য বিখ্যাত। এই মণিপুরী সম্প্রদায় গ্রামগুলোতে সূর্যোদয়ের আগেই শুরু হয় এক বিশেষ ছন্দ। তাঁতের কাঠামো থেকে ভেসে আসে সুরের মতো আওয়াজ, যা এ গ্রামগুলোর চেনা পরিচয়। রঙিন সুতোয় তাঁতের সাথে জীবন রঙের টানাপোড়নের এক বিশেষ ছন্দ। যে ছন্দে মিশে থাকে তাদের জীবনের গল্প, সংস্কৃতির শেকড়, আর তিন শতকের কৃষ্টি।

আঠারো শতক থেকে এই অঞ্চলে তাদের পথচলা শুরু। প্রায় দেড় লাখ মণিপুরী এখন এ দেশে বসবাস করে, বিশেষ করে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ আর শ্রীমঙ্গলের গ্রামগুলোতে। তাদের জীবনযাত্রা আর হাতে বোনা তাঁতের কাপড়ের গল্প যেন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, যুগযুগান্তর ধরে।

জীবনের ছন্দে মণিপুরী তাঁত

মণিপুরী সমাজে তাঁতশিল্প কেবল এক পেশা নয়, এটি তাদের জীবনের অনিবার্য অংশ। মণিপুরীদের জীবনধারা সাধারণ আর প্রকৃতির কাছাকাছি। তাদের গ্রামগুলোতে চোখে পড়ে শান্তি আর সরলতা। গ্রামের বাড়ির উঠোনে, গাছের ছায়ায় বা কুঁড়েঘরের বারান্দায় দেখা যায় মণিপুরী নারীদের তাঁতে সুতোর মাঝে জীবনের ছবি ফুটিয়ে তুলতে। তাঁতের শব্দ—ঠকঠক, ঝটঝট—যেন তাদের দৈনন্দিন জীবনের সুর। মেয়েদের জীবনের সঙ্গে এই শিল্পের সম্পর্ক শুরু হয় শৈশবেই। যখন ছোট্ট মেয়েটি মায়ের কোলে ঘুমোয়, তখনই তার মাথার ওপরে ঝুলতে থাকে তাঁত বাধানো রঙ বেরঙের সুতা। মায়ের নকশা তোলার আওয়াজ তার মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। একটু বড় হতে না হতেই মা তাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দেন সুতোর কারুকাজ। এই শেখা যেন জীবনের প্রস্তুতি। এ শিক্ষা শুধু দক্ষতা অর্জনের জন্য নয়, বিয়ের সময় এটি তার যোগ্যতা আর যৌতুকের একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রবাদ আছে—মণিপুরী নারীরা জন্মসূত্রেই তাঁতি। প্রায় ৯০ শতাংশ মণিপুরী নারী তাঁতের সঙ্গে যুক্ত। এভাবে তাঁতশিল্প মণিপুরী নারীদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।

তাইতো মণিপুরী তাঁতশিল্প কেবল একটি শিল্প নয়, এটি একটি জীবনের গল্প। তাদের তাঁতগুলোতে কেবল সুতো বোনা হয় না, বোনা হয় ঐতিহ্যের কাহিনি। মণিপুরীদের জীবনধারার সাথে মিশে থাকা এই শিল্প আমাদের শেখায়, কীভাবে একটি সম্প্রদায়ের কৃষ্টি তার ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং অর্থনীতির শক্ত ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। এই শিল্পের মাধ্যমে তারা শুধু নিজেদের জীবনই নয়, বাংলাদেশের হস্তশিল্পের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে।



মণিপুরীদের তাঁতের যন্ত্রের কাহিনি


মণিপুরীদের তাঁতের কাজে মণিপুরীরা তিন ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করে—কোমরে বাঁধা তাঁত, হ্যান্ডলুম তাঁত আর থোয়াং। মণিপুরীদের ব্যবহৃত তাঁতকলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো কোমরে বাঁধা তাঁত। এটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। কাজের শুরুতে তাঁতিরা সুতো টানা দিয়ে তাঁতে বসে, পিঠে চামড়ার ব্যাকস্ট্রিপ আটকে নিয়ে বুনন শুরু করেন। সুতোগুলো উপর-নিচে চালানো হয় নাচাই বা বয়ার নেসির মাধ্যমে, যা একটি শেড বা ফাঁক তৈরি করে। এরপর সাঁটল দিয়ে সুতো ঢুকিয়ে, বেং বা টেয়াম দিয়ে ধাক্কা দিয়ে কাপড়ের গঠন শক্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়া দেখতে সহজ মনে হলেও, এতে লাগে অসীম ধৈর্য আর দক্ষতা।

মণিপুরী তাঁত

নকশার নেপথ্যের গল্প

মণিপুরী তাঁতের কাপড়ে নকশা একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ঝাউ গাছ, সেফালি ফুল, টেম্পল/মন্দিরের মোটিফ—এসব নকশা তাদের ঐতিহ্যের গল্প বলে।

মণিপুরী তাঁত মনিপুরী শাড়ি Manipuri Saree x fxyz x bfa (36) - Copy

মণিপুরী তাঁতের কাপড়ে নকশা একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাঁতের নকশাগুলো শুধু কারুকাজ নয়, এগুলোতে মণিপুরী সমাজের ইতিহাস ও প্রকৃতির ছাপ ফুটে ওঠে। ঝাউ গাছ, সেফালি ফুল, টেম্পল/মন্দিরের মোটিফ মণিপুরী তাঁত কাপড়ের উল্লেখযোগ্য সব নকশা। যা তাদের ঐতিহ্যের গল্প বলে। ঝাউ গাছের নকশা প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় জীবনের স্থিতিশীলতার, শেফালি ফুল মণিপুরী নারীদের কোমলতা এবং মন্দিরের নকশা তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য প্রকাশ করে। যা ‘মইরাং ফি’ নামে পরিচিত।


মৈরাং নকশা: ঐতিহ্যের প্রতীক

মণিপুরী নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ফানেক—যেটি কোমরে প্যাঁচ দিয়ে পরতে হয়। সাথে ব্লাউজ এবং ফিতুপ অথবা ইনাফি। ফিতুপের উন্নত সংস্করণ মৈরাংফি—যেটি মূলত ওড়না বিশেষ। মণিপুরী শাড়ি এ মৈরাংফিরই ইম্প্রোভাইজড সংস্করণ। যার উৎপাদন শুরু হয় নব্বই দশকে মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই।

মৈরাং বা টেম্পল নকশা মণিপুরের মোইরাং অঞ্চলের থাংজিং মন্দির থেকে এসেছে। মন্দিরের নকশার অনুকরণে করা। এই মন্দিরটি দেবতা থাংজিং-এর সঙ্গে জড়িত। থাংজিং মণিপুর মিথোলজির দেবতা; তিনি ঈশাণ কোণের দিক রক্ষাকর্তা। এটি তাদের আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক সংযোগের প্রতীক। মৈরাংয়ের নারীরাই প্রথম মৈরাংফির বুনন শুরু করেন। মৈরাংয়ের রাজকন্যা থৈবী সর্বপ্রথম মৈরাংফি পরিধান করেন বলে জনশ্রুতি আছে। মৈরাংফির সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অংশ হলো এর পাড়ের বৈচিত্র্যময় ‘মৈরাং’ বা মন্দির ডিজাইন। শাড়ির আঁচল, জমিন ও পাড়ে এই নকশা ফুটে ওঠে।

এ নকশাগুলোয় স্থানীয় আবহাওয়ার প্রভাবও লক্ষ্যণীয়। শীতের সময় উল ও পলিয়েস্টার দিয়ে তৈরি হয় নরম ও আরামদায়ক কাপড়। গ্রীষ্মের জন্য তুলার সূতা দিয়ে তৈরি করা হয় হালকা ও বাতাস চলাচল উপযোগী পোশাক।

Image Source : Wikimedia Commons

traditional dresses of Manipur

মণিপুরী নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ফানেক

ফানেক হলো একটি পোশাক যা কোমরে পেঁচিয়ে পরা হয়। এই ফানেকের পাড়ে যদি মোইরাং পাড় থাকে, তবে তাকে বলা হয় মোইরাং ফানেক। আবার স্ট্রাইপের ফানেকের মধ্যে যেগুলোর পাড় মোটা হয়, সেগুলোকে বলা হয় “মাপান/মায়েক নাইবি” ফানেক। এই মাপান নাইবি ফানেকের পাড়ে কিছু অর্থবহ নকশা বা চিহ্ন থাকে, যার কারণে এটিকে মায়েক (অক্ষর) বলা হয়।

মণিপুরীদের মধ্যে একটি বিশেষ ফানেকের নাম হলো “থাম্বানলৈখোক”। “থাম্বান” শব্দের অর্থ পদ্ম, এবং পদ্ম ফুলের মতো রঙের কারণে এই ফানেকের নামকরণ করা হয়েছে থাম্বানলৈখোক। এটি গোলাপি এবং কালো রঙের সমন্বয়ে স্ট্রাইপ বুনন দিয়ে তৈরি করা হয়। মণিপুরীদের বিয়ের অনুষ্ঠানে এই থাম্বানলৈখোক ফানেকটি বরের বাড়ি থেকে কনেকে অবশ্যই উপহার হিসেবে দিতে হয়। এই প্রথা আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।

মণিপুরী শাড়ি

জামদানি, বেনারসি, টাঙ্গাইল, পাবনা, রাজশাহীসহ অন্য দেশীয় তাঁতের শাড়িগুলোর প্রতিটির আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, যা দেখলেই বোঝা যায় এটি কোন তাঁতের শাড়ি।

ঐতিহ্যের সুরক্ষায় মণিপুরী তাঁতশিল্প

মণিপুরীদের তাঁতশিল্পের কাহিনি থেমে থাকা গল্প নয়। এটি একদিকে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ, অন্যদিকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। প্রায় ৯০ শতাংশ মণিপুরী নারী এই শিল্পের সাথে যুক্ত।
তবে আজকাল অনেকে বলেন, ব্যাকস্ট্রিপের কাজ কঠিন আর সময়সাপেক্ষ। কিছু শাড়িতে নকশা কমিয়ে গাঁথনি পাতলা রাখা হয়, যাকে বাঙালিরা কৌতুক করে ‘মশার জাল’ বলে। একসময় কানাপ, খানমেন চাতপা, সাথকাপা ফি—এমন নানা ডিজাইন ছিল, কিন্তু এখন তাঁতিরা সহজ নকশার দিকে ঝুঁকছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিলেট ভ্রমণ
ও মণিপুরি তাঁতশিল্পের প্রশংসা

১৯১৯ সালে অবকাশ কাটানোর জন্য আসামের শিলং শহরে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সেখানে প্রায় তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। এরপর তাঁর ইচ্ছে হলো কাছেই সিলেট ভ্রমণ করার। শিলং থেকে সিলেটের দূরত্ব মাত্র ১৪০ কিলোমিটার হলেও সরাসরি যাতায়াতের ব্যবস্থা তখন ছিল না। কবিকে অনেক ঘুরপথে গুয়াহাটি থেকে রেলপথে লামডিং, বদরপুর, করিমগঞ্জ হয়ে সিলেট আসতে হয়। যাত্রাটি বেশ দীর্ঘ ও কষ্টকর ছিল।

১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর, বুধবার। খুব ভোরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটে পৌঁছান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। সুরমা নদীর ঘাটে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয় শঙ্খধ্বনি ও শোভাযাত্রা দিয়ে। সিলেট শহরের নয়াসড়ক টিলার ওপরে ফাদার টমাসের বাংলোয় তিনি উঠেছিলেন।

ফাদার টমাসের বাংলোর দরজা-জানালার পর্দাগুলো মণিপুরি নারীদের হাতে বোনা কোমরতাঁতের কাপড় দিয়ে তৈরি ছিল। সিলেটের গবেষক নৃপেন্দ্রলাল দাস লিখেছেন, বাংলোর এক পুরোনো পর্দায় মণিপুরি শিল্পের নিপুণ কাজ দেখে কবি খুব মুগ্ধ হন। পর্দাটি শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করা হলে তিনি আরও আনন্দিত হন।

পরের দিন, ৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সকালে, টাউন হল প্রাঙ্গণে সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে কবির টেবিলে মোড়ানো ছিল মণিপুরি মেয়েদের বোনা এক টেবিল ক্লথ। কাপড়টি দেখে তিনি খুব প্রশংসা করেন। তিনি মণিপুরি নারীদের বয়নশিল্প ও তাঁদের জীবনযাত্রা দেখতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

এই সফরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মণিপুরি তাঁতের কাজ এবং তাদের সংস্কৃতির প্রতি গভীর মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।



মণিপুরি শিল্প-সংস্কৃতির প্রসার এবং রবীন্দ্রনাথ ,
কুঙ্গ থাঙ
লেখক: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার লেখক ও গবেষক
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০১৯
প্রথম আলো

তাদের উৎপাদিত তাঁত পণ্যের মধ্যে আছে—ফানেক (মণিপুরী নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ), শাড়ি, মাফলার, বিছানার চাদর, টেবিল ক্লথ, শাল, ওড়না, গামছা, থ্রি-পিস ইত্যাদি।






February 29, 2024
Literature in Saree শাড়িতে সাহিত্য x Manas x bfa x fxyz web

শাড়িতে সাহিত্য

ANINDETA CHOWDHURY
শাড়িতে সাহিত্য, এই প্রবণতার পেছনের মূল কারণটা কী হতে পারে? শুধুই সাহিত্যপ্রেম, নাকি অন্য কিছুও?…
February 29, 2024

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!