শাড়িতে সাহিত্য, এই প্রবণতার পেছনের মূল কারণটা কী হতে পারে? শুধুই সাহিত্যপ্রেম, নাকি অন্য কিছুও?
‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে, আমার নামটি লিখো তোমার চরণ মন্দিরে’।
রবি ঠাকুরের একটি জনপ্রিয় প্রেমের গান, ভক্তির সাথে মানবমনের ভালোবাসাকে মিলিয়ে দেবার গান। ‘যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব’ শ্লোক হোক কিংবা তিন কবুলে হৃদয়ের গাঁটছড়া বাঁধা, বিয়েটা যে রীতি মেনেই হোক– কনের সাজটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা সে যে সংস্কৃতিতেই হোক না কেন। আর এমন একটি গান যদি সেই কনের বিয়ের শাড়ির পাড়ে বুনে দেয়া থাকে, লাল জমিনে সোনালি হরফে– তবে যেন এক সাহিত্যসুধায় ভরে যায় সেই বিয়ের আসর। উপস্থিত সকলের সাথে যে বরের চক্ষুও তখন একই দিকে নিবদ্ধ হবে, এতে কি আর সন্দেহ আছে?
একসময়ের ভুল বানানে দেয়ালে ঝোলানো মাদুরে লেখা থাকতো ‘ভুলো না আমায় কিংবা Forget me not’; আর আজকের আধুনিকতায় সেই বুনন অক্ষরই দেখা যাচ্ছে পোশাকে, বিশেষত শাড়িতে। পাড়ের প্যাটার্নে কিংবা আঁচলের ছড়িয়ে থাকায়। হাল জমানার বই পড়া কিংবা সাহিত্যচর্চা নিয়ে অনেক গুণীজনের মনে খেদ থাকলেও অন্তত হাল জমানার ফ্যাশনে সাহিত্যের কোনো অভাবই দেখা যায় না। বরং ফ্যাশন আজকাল অনেক বেশি সাহিত্য সচেতন, শিল্পসমৃদ্ধ।
প্রথমদিকে শুধু পাড় বা আঁচল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেও ফ্যাশন হাউসগুলো এখন আরো বেশি সাহসী হয়ে উঠেছে সাহিত্যের এই বহিঃপ্রকাশে। তাইতো একটা হলুদ শাড়ির পুরোটা জুড়ে লেখা থাকে, ‘তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে’, কিংবা কালো শাড়ির বুকে দাগ কাটে ছবি ও লেখায় একটা সম্পূর্ণপ্রায় ‘শেষের কবিতা’ও। তবে শুধু যে রবীন্দ্রচর্চাই ঘটে শাড়ির ফ্যাশনে, তা কিন্তু নয়। আছেন জীবনানন্দ, নজরুলেরাও। কারুকাজের ফন্টে ভাসা ভাসা লেখাগুলোর পাশাপাশি স্কেচ করা থাকে রচয়িতারও। আমাদের বাংলাদেশের গুপ্তচর শিরোমণি চিরনবীন দুর্ধর্ষ ‘মাসুদ রানা’ও শাড়ির ডিজাইনে উঠে এসেছেন বটে!
শাড়ি: মানাস
ফ্যাশনের মধ্য দিয়ে গল্পবলার চেষ্টা
মানাস এর যাত্রা শুরু ২০১২ সালে
ঠিকানা: হাউজ নং- ১৩৬, রোড- ২২
মহাখালি ডিওএইচএস, ঢাকা
ফেসবুক পেইজ: Manas
শাড়ি: Poter BiBi : পটের বিবি
‘কবির চিঠি’
রবি ঠাকুরের হাতে লেখা চিঠি এই নকশার প্রধান উপাদান, সাথে আলপনা আর ফুলের বিন্যাস।
গেরুয়া শাড়িতে কালো রঙ এর স্ক্রীনপ্রিন্ট।
ফেসবুক পেইজ: Poter BiBi : পটের বিবি
শাড়িতে সাহিত্যকে তুলে আনার এই প্রয়াস এখন একটুখানি ফেসবুকে বিচরণ করা অনলাইন শাড়ির দোকানগুলোতে ঢুঁ মারলেই বোঝা যায়। কিন্তু এই প্রবণতার পেছনের মূল কারণটা কী হতে পারে? শুধুই সাহিত্যপ্রেম, নাকি অন্য কিছুও? চুলচেরা বিশ্লেষণ চালানোর একটা চেষ্টা অবশ্য করা যায়। এখনকার সময়টাতে নিজের প্রোফাইল, প্রোফাইল মানে ঠিক সামাজিক মাধ্যমের প্রোফাইলটাই নান্দনিক করে তোলার মুহূর্মুহূ চেষ্টা প্রতিফলিত হয় প্রায় সবখানেই। এই নান্দনিকতার প্রতীক হিসেবে সাহিত্যকে একটা ভালো উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যায়, আর তা করা হচ্ছেও। এতে যে সাহিত্যের মান কমে যাচ্ছে বা সাহিত্যিকরা অপমানিত হচ্ছেন, এমন আলাপ আনার কোনো অবকাশ নেই। কেননা ফ্যাশন নিজেও একটা স্বাধীন রাজ্য। ফ্যাশন চাইলেই পারে যেকোনো কিছুকে ফ্যাশনেবল করে তুলতে। তবে এই ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠার পথে নান্দনিকতার উদ্দেশ্যে যে পণ্যায়ন ঘটছে, সেটিই এখানকার মূল বিষয়। যা ভালো বিক্রি করা যায়, সেটিই যোগ্য পণ্য। এবং সেই পণ্যই ভালো বিক্রি হয়, যার ভালো উপযোগিতা আছে। সামাজিক মাধ্যমের এই প্রবণতার ফলে মানুষের জীবনাচরণে যে নান্দনিক বা সাহিত্যপ্রেমী হবার, বা অন্ততপক্ষে দেখাবার ইচ্ছে– সেটিই এই শাড়ি কিংবা অন্যান্য পোশাকে সাহিত্য উঠে আসার পেছনের একটি বড় কারণ। এটিই এই পণ্যায়নের মূল উপযোগিতা।
‘ভুলো না আমায় কিংবা Forget me not’;
ঠিক তেমনি বিভিন্ন উৎসবে পত্রিকাগুলোর মডেলরাও হয়ে ওঠেন একেকজন কেতকী কিংবা লাবণ্য। ইন্ধনে থাকে সাহিত্যে শাড়ির এবং সেসব শাড়ি পরা নারীর বিবরণ। শাড়িতে সাহিত্য যেমন আসছে, সাহিত্যেও কিন্তু শাড়ির দাপট কম নয় কোনোকালেই। সেই আদ্যিকালের কথাই ধরা যাক না। বেনারসি শাড়ি বিয়ের আসর ছাড়া সাহিত্যেও কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। তাইতো আভিজাত্য, সৌন্দর্য আর ঐতিহ্যের প্রতিনিধি করে বেনারসি জড়িয়ে দেয়া হয়েছে বহু গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের। তসর পরিয়ে বোঝানো হয়েছে চরিত্রের ভারিক্কী চাল। রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্যেও কিন্তু রাজকীয় মহলের নারীদের গায়ে দেখা যেত বেনারসি ভূষণ। আর এভাবেই সময়কে জয় করে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হয়ে জড়িয়ে থাকে শাড়ির সাহিত্য, সাহিত্যের শাড়ি।