Who Made My Clothes ফ্যাশন রেভলিউশন x bfa x fxyz V2

রানা প্লাজা ভবন ধস এবং “Who Made My Clothes?” আন্দোলনের উত্থান

“আমার পোশাক কে বানিয়েছে?” এই প্রশ্ন দিয়ে তারা আমাদের, অর্থাৎ ক্রেতাদের, ভাবাতে চায় যে আমাদের পরা কাপড়ের পেছনে কী গল্প আছে।

Who Made My Clothes?

বাংলাদেশে সাভারের রানা প্লাজা ধসের মর্মান্তিক ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী পোশাক শিল্পের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করে। যা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং পুরো পৃথিবীর জন্য একটি জাগরণের বার্তা হয়ে দাঁড়ায়। রানা প্লাজার ধস ছিল মানবিকতার বিপর্যয় এবং এই ঘটনার পর থেকেই বৈশ্বিক পোশাক শিল্পের স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার দাবি জোরদার হতে শুরু করে। এর ফলশ্রুতিতে “ফ্যাশন রেভলিউশন” নামে একটি বৈশ্বিক আন্দোলন জন্ম নেয়, যার মূল বার্তা ছিল “Who Made My Clothes?”

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি: আন্দোলনের সূচনা

সাভারের ব্যস্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে রানা প্লাজা নামে পরিচিত ভবনটি ছিল অনুমোদনহীন এবং নকশা বিধি লঙ্ঘন করে নির্মিত। ভবনের উপরের চারটি তলা অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল, এবং নির্মাণের জন্য যে জমিটি ব্যবহৃত হয়, তা ছিল বালু ফেলে ভরাট করা একটি পরিত্যক্ত ডোবা। ভবনে ফাটল দেখা দেওয়ার পরও কারখানা পরিচালকদের চাপে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে বাধ্য হন। এর ফলেই ঘটনার দিন ধসে পড়ার সময় ভবনের ভেতরে প্রায় ৩,০০০ কর্মী উপস্থিত ছিলেন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। নয়তলা ভবনটি ধসে পাঁচটি গার্মেন্টস কারখানার ১,১৩৬ শ্রমিক নিহত এবং ১,১৬৭ জন আহত হন।

দুর্ঘটনার পর সাধারণ মানুষ, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, এবং অন্যান্য সংস্থা উদ্ধারকাজে যোগ দেয়। ১৭ দিন পর রেশমা নামের এক শ্রমিককে জীবিত উদ্ধার করা হলেও, এ ঘটনায় বহু পরিবার তাদের প্রিয়জনদের হারিয়ে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে। জাতীয় শোক ঘোষণা করা হলেও বিচার ও ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতা এবং অস্বচ্ছতার কারণে শ্রমিকদের ক্ষোভ আরও তীব্র হয়।

এই ঘটনা ফ্যাশন শিল্পের অস্বচ্ছ সাপ্লাই চেইন এবং শ্রমিকদের প্রতি অবহেলার একটি নগ্ন চিত্র তুলে ধরে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী ক্রেতা, ডিজাইনার, নীতিনির্ধারক এবং অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যা ফ্যাশন রেভলিউশনের জন্ম দেয়।

ফ্যাশন রেভলিউশন: লক্ষ্য ও দর্শন

ফ্যাশন রেভলিউশন একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলন, যারা ফ্যাশন জগতকে আরও মানবিক আর পরিবেশবান্ধব করতে চায়। এরা স্বপ্ন দেখে এমন এক ফ্যাশন শিল্পের, যেখানে মানুষ আর প্রকৃতির ক্ষতি না করে সুন্দর পোশাক তৈরি হবে। এদের মূল প্রশ্ন, “আমার পোশাক কে বানিয়েছে?” এই প্রশ্ন দিয়ে তারা আমাদের, অর্থাৎ ক্রেতাদের, ভাবাতে চায় যে আমাদের পরা কাপড়ের পেছনে কী গল্প আছে। কে সেগুলো বানিয়েছে? তারা কি ন্যায্য মজুরি পায়? তাদের কাজের জায়গা কি নিরাপদ?
ফ্যাশন রেভলিউশন ব্র্যান্ডগুলোর ওপর চাপ দেয় যেন তারা তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সবাইকে খোলাখুলি জানায়। তারা চায় শ্রমিকরা নিরাপদ পরিবেশে কাজ করুক, তাদের মর্যাদা বজায় থাকুক। এই আন্দোলনের দর্শন খুব সহজ—ফ্যাশন শুধু টাকা কামানোর জিনিস নয়, এটা হতে পারে সমাজ আর পরিবেশের জন্য একটা ইতিবাচক শক্তি। তাদের স্লোগান “Who Made My Clothes?” আমাদের সবাইকে একটু থামিয়ে ভাবায়—আমরা যে পোশাক পরি, তার পেছনের মানুষগুলোর কথা। আন্দোলনটির মূল প্রশ্ন:

আমার পোশাক কে বানিয়েছে?
তারা কি ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে?
তাদের কাজের পরিবেশ কি নিরাপদ ও সম্মানজনক?

“Who Made My Clothes?” প্রচারাভিযান

“Who Made My Clothes?” প্রচারাভিযান ফ্যাশন রেভলিউশনের মূল উদ্যোগ, যেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে। এই ক্যাম্পেইন আমাদের, যারা পোশাক কিনি, তাদের উৎসাহ দেয় যেন আমরা আমাদের কাপড়ের লেবেলের ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করি আর ব্র্যান্ডদের কাছে জানতে চাই—এই পোশাক কে বানিয়েছে? ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে #WhoMadeMyClothes হ্যাশট্যাগটি টুইটারে বিশ্বের সবচেয়ে ট্রেন্ডিং বিষয়গুলোর একটি হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে শ্রমিকরাও তাদের গল্প শেয়ার করতে শুরু করেছে। যেমন, #IMadeYourClothes হ্যাশট্যাগ দিয়ে তারা গর্বের সঙ্গে বলছে, “আমি তোমার পোশাক বানিয়েছি!” এটা ক্রেতা আর শ্রমিকদের মধ্যে একটা সেতু তৈরি করছে এবং ফ্যাশন শিল্পে স্বচ্ছতার দাবিকে আরও জোরালো করছে।

প্রতি বছর রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বার্ষিকীতে ফ্যাশন রেভলিউশন “ফ্যাশন রেভলিউশন সপ্তাহ” পালন করে। এই সপ্তাহে বিশ্বজুড়ে কর্মশালা, ওয়েবিনার, ফিল্ম প্রদর্শনী আর সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ফ্যাশন শিল্পের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে তারা “Rights, Relationships and Revolution” আর ২০২২ সালে “Money, Fashion and Power” থিম নিয়ে কাজ করেছে। এছাড়া, ফ্যাশন রেভলিউশন প্রতি বছর “ফ্যাশন ট্রান্সপারেন্সি ইনডেক্স” প্রকাশ করে, যেখানে বিশ্বের ২৫০টি বড় ব্র্যান্ডের সাপ্লাই চেইনের স্বচ্ছতা পরীক্ষা করা হয়। এটা ব্র্যান্ডগুলোকে তাদের সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্বের বিষয়ে খোলাখুলি হতে উৎসাহ দেয়।

ফ্যাশন রেভলিউশন এখন ৭৫টিরও বেশি দেশে কাজ করছে আর ফ্যাশন শিল্পে বেশ বড় প্রভাব ফেলছে। এই আন্দোলনের কারণে ক্রেতারা এখন অনেক বেশি সচযোগ্য। এর ফলে অনেক ব্র্যান্ড তাদের সাপ্লাই চেইনের তথ্য প্রকাশ করতে শুরু করেছে। যেমন, ব্রাজিল, ভারত বা সুইডেনের মতো দেশে স্থানীয় ফ্যাশন রেভলিউশন টিম তাদের নিজস্ব সমস্যা নিয়ে কাজ করছে। আরেকটা মজার উদ্যোগ হলো #Haulternative, যেটা সেকেন্ড-হ্যান্ড কেনাকাটা আর টেকসই ফ্যাশনকে প্রমোট করে। যদিও ফ্যাশন ট্রান্সপারেন্সি ইনডেক্স নিয়ে কিছু সমালোচনা আছে, তবু এই আন্দোলন ফ্যাশন জগতে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য একটা শক্তিশালী শক্তি হয়ে কাজ করছে।

“Who Made My Clothes?” আর ফ্যাশন রেভলিউশন আন্দোলন ফ্যাশন শিল্পের অন্ধকার দিকগুলোর বিরুদ্ধে একটা জোরালো কণ্ঠস্বর। রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর থেকে এই আন্দোলন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতা, শ্রমিক আর নীতিনির্ধারকদের একসঙ্গে এনেছে। তাদের স্বপ্ন একটা এমন ফ্যাশন জগৎ, যেখানে সবাই ন্যায্য মজুরি পাবে, নিরাপদ পরিবেশে কাজ করবে, আর পরিবেশের ক্ষতি হবে না।

সোশ্যাল মিডিয়ার ক্যাম্পেইন, গবেষণা আর অ্যাক্টিভিজমের মাধ্যমে এই আন্দোলন ফ্যাশন শিল্পে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা বাড়িয়েছে। তারা আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে—আমরা যে পোশাক পরি, তার পেছনে কাদের শ্রম আছে, তাদের জীবন কেমন? ভবিষ্যতে এই আন্দোলন আরও অনেক মানুষকে ছুঁয়ে যাবে আর ফ্যাশন শিল্পকে সত্যিই একটা ভালো শক্তিতে পরিণত করবে, এমনটাই আশা করি।


আপনার একটি শেয়ার এবং মন্তব্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Instagram did not return a 200.
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!