সরাশিল্প Lokkhi Sora traditional art form in Bengali culture x bfa x fxyz webxxxx - Copy

সরাশিল্প: বাংলার প্রাচীন মৃৎশিল্পের এক ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টান্ত

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলার মৃৎশিল্পীরা সরার নকশা, চিত্রকর্ম, রং এবং আকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসেছেন। কোজাগরী পূর্ণিমার দিন, শরৎকালের এই উৎসবে দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।

traditional art form in Bengali culture

Sora
Chitro

বাংলার সরাশিল্প বাংলার প্রাচীনতম এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত এক শিল্পধারা, যা মূলত মৃৎশিল্পের একটি অংশ। এই শিল্প বাংলার মাটির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত, যেমনটি দেখা যায় বাংলার গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে সরার সংযোগে। গ্রামীণ জীবনের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি সরা বাংলার লোকশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে উঠেছে।

সরাসহ বাংলার অন্যান্য মৃৎশিল্প দীর্ঘদিন ধরে বাংলার লোকজীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রয়েছে। তবে সরার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর বহুমুখী ব্যবহার। এটি কেবল দৈনন্দিন জীবনের উপকরণ নয়, বরং বাংলার সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক ঐতিহ্যের ধারক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলার মৃৎশিল্পীরা সরার নকশা, চিত্রকর্ম, রং এবং আকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসেছেন। তাদের শৈল্পিক দক্ষতা সরাকে শুধুমাত্র ব্যবহারিক উপকরণ হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং এটি বাংলার নিজস্ব শিল্পধারার অংশ হিসেবে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান দিয়েছে।

সরার বিভিন্ন নাম

সরার বিভিন্ন নাম এবং ব্যবহারভেদেও পার্থক্য রয়েছে, যেমন: ঢাকনাসরা, ফুলসরা, ধূপসরা, মুপিসরা, তেলনিসরা, আমসরা, এয়োসরা, আঁতুরসরা, গাজীর সরা, লক্ষ্মীসরা ইত্যাদি। সব সরাই চিত্রিত নয়, তবে অঙ্কিত বা চিত্রিত সরা বাংলার মৃৎশিল্পের ঐতিহ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ধর্মীয় প্রতীক

সরা এক সময় শুধুমাত্র লোকজীবনের প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যবহৃত হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ধর্মীয় প্রতীক হিসেবেও স্থান করে নিয়েছে। হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের লোকই সরা ব্যবহার করতেন। মুসলমানদের সরায় কাবা শরিফের ছবি এবং বিভিন্ন সংখ্যা বা ধর্মীয় বাক্য লেখা থাকত। গনকী সরা নামে পরিচিত একটি ধরনের সরায় বাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কালিমা লেখা থাকত, যা বাড়ির চারপাশে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো।

lokkhi
sora

লক্ষ্মীসরা

লক্ষ্মীসরা বাংলার সরাশিল্পের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য অংশ, যা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পূজায় ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে কোজাগরী পূর্ণিমার দিন, শরৎকালের এই উৎসবে দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। লক্ষ্মী দেবী হিন্দু ধর্মে ধন-সম্পদ, সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের দেবী হিসেবে পূজিত হন। লক্ষ্মীপূজার জন্য ব্যবহৃত সরার উপরে সাধারণত দেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতীর চিত্র অঙ্কিত থাকে, যা শিল্পীদের শৈল্পিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে।

কোজাগরী পূর্ণিমার পূজায় সরাচিত্রে দেবী সরস্বতী, নারায়ণ, দুর্গা, রাধাকৃষ্ণসহ অন্যান্য প্রতিকৃতিও থাকতে পারে, তবে লক্ষ্মীর উপস্থিতি সব সরাতেই সর্বজনীন। এই কারণেই এর নাম হয়েছে লক্ষ্মীসরা। লক্ষ্মীর প্রতিকৃতি সরার কেন্দ্রে অবস্থান করে, এবং তাঁর চারপাশে অন্যান্য দেব-দেবীর চিত্র যুক্ত হয়, যা সরাকে পূজার জন্য গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।

‘কোজাগরী’ শব্দটির উৎপত্তি ‘কো জাগতী’ থেকে, যার অর্থ “কে জেগে আছ?” লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে দেবী লক্ষ্মী খোঁজ নেন কে জেগে আছেন। বলা হয়, যার কিছু নেই সে পাওয়ার আশায় জেগে থাকে, আর যার আছে সে তা রক্ষার আশায় জাগে। সারারাত জেগে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করাই এই পূজার বিশেষ আচার। প্রচলিত আছে, কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে যে ব্যক্তি জেগে অক্ষক্রীড়া করে, দেবী লক্ষ্মী তাকে ধনসম্পদে সমৃদ্ধ করেন।

লক্ষ্মীসরা তাই কেবল ধর্মীয় প্রতীক নয়, বরং বাংলার লোকশিল্পের এক সমৃদ্ধ অংশ, যা বাংলার মৃৎশিল্পের ঐতিহ্যকে ধারণ করে।

লীলা মজুমদার লক্ষ্মীছাড়া গল্পে মূলত দেবী লক্ষ্মীকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ সমাজের বিশ্বাস, আচার এবং দৈনন্দিন জীবনের চিত্র তুলে ধরে। এখানে ‘লক্ষ্মীছাড়া’ অর্থাৎ দেবী লক্ষ্মীর অভাব জীবনের অমঙ্গল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রামীণ জীবনে লক্ষ্মীসরার ব্যবহার এবং দেবী লক্ষ্মীর প্রতীকী উপস্থিতি পুরো গল্পে জুড়ে অনুভব করা যায়। যখনই কোনো গৃহে মঙ্গল বা সমৃদ্ধি আসে, তখন গ্রামীণ পরিবারে লক্ষ্মীসরার পূজা হয়, যা সেই গৃহের মঙ্গল কামনার প্রতীক। মুলত দেবী লক্ষ্মীকে ঘরে ধরে রাখার জন্য গ্রামের মহিলারা এই সরায় পূজা দেন, যাতে তাদের ঘরে ধন-সম্পদ এবং শান্তি থাকে।

মানিকগঞ্জ এবং ফরিদপুরের লক্ষ্মীসরা:

লক্ষ্মীসরা বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়, তবে এর বৈশিষ্ট্যগুলো এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের তুলনায় ভিন্ন হতে পারে। সরাগুলোতে সাধারণত দেবী লক্ষ্মী, ধানের শীষ, এবং শুভ লক্ষ্মীর প্রতীকী চিহ্ন আঁকা হয়। ধর্মীয় পবিত্রতা বজায় রাখতে, এই সরাগুলোতে বিশেষ রং এবং নকশা ব্যবহার করা হয়।

মানিকগঞ্জ এবং ফরিদপুর, উভয় অঞ্চলেই লক্ষ্মীসরা তৈরির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তবে এই দুই এলাকার লক্ষ্মীসরার মধ্যে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য দেখা যায়:

মানিকগঞ্জের লক্ষ্মীসরা

মানিকগঞ্জেও ‘জয়া-বিজয়া সরা’ নামে এক বিশেষ ধরনের লক্ষ্মীর সরার দেখা মেলে। এখানকার বেতিলা-মিতরা অঞ্চলের কুম্ভকারেরা তা তৈরি করেন। রং দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায় এটি সেখানকার সরা। এর একটিতে থাকে দেবী লক্ষ্মী (হলুদ) এবং অন্যটিতে দেবী সরস্বতী (সাদা)। ঢাকার দোহারে একে বলা হয় ‘লক্ষ্মী-সরস্বতী সরা’।

ফরিদপুরের লক্ষ্মীসরা:

ফরিদপুরী’ বা ‘সুরেশ্বরী সরা’ বলেই বেশি পরিচিত।

লক্ষ্মীসরার রং:

লক্ষ্মীসরার রং সাধারণত দেবী লক্ষ্মীকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রতীক হিসেবে নির্বাচন করা হয়। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রংগুলো হলো:

লাল: এটি শুদ্ধতা, শক্তি এবং দেবীর ঐশ্বর্যকে বোঝায়। অধিকাংশ লক্ষ্মীসরায় লাল রং প্রাধান্য পায়।
সাদা: এটি পবিত্রতা এবং প্রশান্তির প্রতীক। লক্ষ্মীসরার নকশাগুলো সাদা রঙ দিয়ে শোভিত থাকে।
হলুদ এবং সোনালী: বিশেষ করে ফরিদপুরের সরাতে এই রংগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়। সোনালী রং দেবী লক্ষ্মীর ধন-সম্পদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

মাটির সরার ইতিহাস এবং উৎপত্তি

মাটির পাত্র তৈরি এবং তার ব্যবহার প্রাচীনকালের শিল্পচর্চার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। সরার উৎপত্তি সম্ভবত সেই সময়কার, যখন মানুষ মাটির পাত্র ব্যবহার শুরু করে দৈনন্দিন জীবনকে সহজতর করার জন্য। প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননে মাটির পাত্রের সন্ধান পাওয়া যায়, যা সরার প্রাচীনত্বকে নির্দেশ করে।

ইতিহাস বলছে, বাংলার মৃৎশিল্পের ধারাটি অত্যন্ত প্রাচীন এবং হাজার হাজার বছর ধরে এটি মানুষের জীবনযাপনের সাথে যুক্ত ছিল। কৃষি নির্ভর বাংলার মানুষেরা মাটির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত ছিল এবং মাটির পাত্রগুলোর ব্যবহার এক সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন যুগে বাংলার শাসকবর্গ এবং সমৃদ্ধ কৃষি ব্যবস্থা মৃৎশিল্পের বিকাশে সহায়তা করেছে। সরাসহ অন্যান্য মাটির পাত্র তৈরি করা হতো সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে, যা গ্রামীণ মানুষের কাছে সস্তা এবং ব্যবহারযোগ্য পাত্র হিসেবে জনপ্রিয় ছিল।

মাটির সরার ব্যবহার

মাটির সরা বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। প্রধানত মাটির সরা ব্যবহৃত হতো মাটির তৈরি কলসি বা মটকা ঢাকার জন্য। সরা ছিল একধরনের ঢাকনা, যা কলসি বা পানি রাখার পাত্রকে ঢেকে রাখতো, যাতে ময়লা বা ধুলো পড়তে না পারে। এছাড়াও খাবার খাওয়ার জন্য বা খাবার পরিবেশন করার জন্য সরার ব্যবহার ছিল ব্যাপক। থালার বিকল্প হিসেবে সরা ব্যবহার করা হতো, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে।

অনেক সময় সরাকে মিষ্টান্ন বা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করার জন্যও ব্যবহার করা হতো। খাবার বা ফলমূল পরিবেশনের জন্য মাটির সরা ব্যবহৃত হতো। শীতল পানীয় রাখার পাত্র হিসেবেও সরার ব্যবহার ছিল বিশেষভাবে জনপ্রিয়। মাটির পাত্রের প্রাকৃতিক শীতলতা পানীয়গুলোকে ঠান্ডা রাখত। সরাকে প্রায়ই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে এবং পূজায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, যেখানে এটি পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

সরার গায়ে আঁকা নকশা ও চিত্রকর্মে ফুটে ওঠে গ্রামের জীবনের ছোঁয়া। সরার পৃষ্ঠে আঁকা ছবি, বিভিন্ন রং ও প্রতীক নিয়ে মানুষের সুখ-দুঃখ, উৎসব, ধর্মীয় আচারসহ জীবনের নানা দিক ফুটে ওঠে। এগুলো কখনো পবিত্রতা এবং সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে, কখনো ধর্মীয় বা সামাজিক আচারের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সরা শিল্পের আধুনিক ব্যবহার

বর্তমানে মাটির সরার ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং নতুন নতুন উপকরণের ব্যবহার গ্রামীণ জীবনে মাটির পাত্রের প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে হ্রাস করেছে। প্লাস্টিক, ধাতু, এবং অন্যান্য টেকসই উপকরণের সহজলভ্যতা মাটির সরাসহ অন্যান্য মৃৎশিল্পের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে মৃৎশিল্পীরা এই পেশা ছেড়ে অন্য কাজের দিকে ঝুঁকছেন, এবং এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি বিলুপ্তির পথে রয়েছে।

তবে সরাশিল্পকে নতুন করে তুলে ধরার জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অনেক শিল্পী এবং ডিজাইনার মাটির সরা এবং অন্যান্য মৃৎশিল্পকে আধুনিক শিল্পের সঙ্গে একীভূত করছেন। বর্তমানে ঘর সাজানোর উপকরণ হিসেবে মাটির সরা ব্যবহার হচ্ছে। সরার গায়ে বিভিন্ন ধরনের নকশা আঁকা হচ্ছে, যা আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে মানানসই। মৃৎশিল্পের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং এটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিভিন্ন মেলা এবং প্রদর্শনীতে সরাশিল্পকে তুলে ধরা হচ্ছে।

নতুন প্রজন্ম এবং উদ্যোক্তারা সরাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে এটিকে গৃহসজ্জার একটি শৈল্পিক উপকরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে, যা বাংলার শৈল্পিক ঐতিহ্যকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে।

টেপা পুতুল tepa putul craft of bangaldesh x bfa x fxyz

টেপা পুতুল: শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন

টেপা  পুতুল বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে। এটি শুধুমাত্র  খেলনা নয়, বরং অনেক সময় প্রতীকী অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

clay art মৃৎশিল্প বাংলাদেশের এক প্রাচীন ঐতিহ্য x bfa x fxyz

কাদা মাটি থেকে শিল্প: মৃৎশিল্প বাংলাদেশের এক প্রাচীন ঐতিহ্য

মৃৎশিল্পের উৎপত্তি সর্বপ্রথম চীনের থাংশান শহরে। এ কারণে থাংশানকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। মৃৎশিল্প বাংলাদেশের এক প্রাচীন ঐতিহ্য


আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা


উইকিপিডিয়া, 

canvasmagazine.com.bd

artisan.gov.bd


আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিংক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!