ঐতিহ্যবাহী-বাঁশ-ও-বেত-শিল্প-নিজস্ব-শিল্প-সংস্কৃতির-প্রতীক-x-bfa-x-fxyz

ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প

যে কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে, বাঁশ-বেত তাদের অন্যতম।

ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প
নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক

অঙ্কে তৈলাক্ত বাঁশের ধাঁধা নয়,
জীবন অঙ্কের ধাঁধায় বাধা পড়ে আছে শিল্পীদের জীবনযাত্রা। আর বিভিন্ন সংকটে ধীরে ধীরে চাপা পড়ছে এ শিল্পের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা। যেমন যান্ত্রিক যুগে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অনুভূতি, তেমনি আমাদের শিল্প ও শিল্পকর্ম। দিন যতই যাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে এ পুরনো ঐতিহ্য গুলো আজ বিলুপ্তির পথে। এমনি এক শিল্প, ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প। যা আমাদের জনজীবন থেকে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট-বড় অনেক হস্তজাত বা কুটিরশিল্প। এর ভিতর যে কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে, বাঁশ-বেত তাদের অন্যতম। সাধারণত গ্রামের লোকেরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত এবং বেশির ভাগ তারাই এসব ব্যবহার করে। বাংলাদেশের লোকজীবনের খুব কম দিকই আছে যেখানে বাঁশ ও বেতের তৈরি সামগ্রী ব্যবহারিত হয় না। বাঁশের তৈরি এই শিল্প দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছাড়াও ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীদের জীবনাচরণ ও অনুভূতির প্রতীক।

ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প

প্লাস্টিক ও অন্যান্য বিভিন্ন
সামগ্রীর কদর
.

এক সময় বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালতসহ কৃষি কাজের সবখানেই ব্যবহার করা হতো বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র। প্লাস্টিক ও অন্যান্য বিভিন্ন সামগ্রীর কদর বেড়ে যাওয়ার ফলে এসব কুটির শিল্পের চাহিদা এখন আর নেই বললেই চলে। এ ছাড়াও পর্যাপ্তহারে বেতের চাষ না হওয়ায় কাঁচামালের ঘাটতির কারণে বাঁশ বেতের পন্য তৈরিতে খরচ বেরেছে। বাজার দখল করেছে প্লাস্টিক ও এ্যলুমিনিয়ামের তৈরি নানা জাতের আসবাবপত্র। প্লাস্টিক পণ্য টেকসই ও স্বল্পমূল্যে পাওয়ায় সাধারণ মানুষের চোখ প্লাস্টিকসামগ্রীর ওপর। সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে সবকিছুই।

বেত ও বাঁশঝাড়

আগে বাড়ি ভিটেতে কিংবা পুকুর পাড় ধরে দেখা যেত বাঁশের বাগান। এ ছাড়াও যত্রতত্রভাবে বাড়ির আঙ্গিনা ভিটে মাঠে হামেশাই চোখে পড়তো বেত ও বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ-বেত কেটে বেতের নমনীয়তা আর বাঁশের আঁশ কাজে লাগিয়ে গৃহিণীরা তৈরি হতো গৃহস্থালি ও সৌখিন পণ্যসামগ্রী। হরেকরকম পণ্য। এসব বিক্রি করেই চলত তাদের জীবনযাপন। দরিদ্র পরিবারের অনেকের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ছিল এগুলো। এখন আর দেখা মেলে না আর বাঁশঝাড় কিংবা জঙ্গলের ভিতর বেতের ঝাড়।

শিল্পকর্মের উপর আগ্রহ হারানো

এক সময় গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম ভিত হিসেবে বাঁশ ও বেত শিল্পের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। ঘরবাড়ি নির্মাণ, মৎস্য শিকারের সরঞ্জাম, কৃষি যন্ত্রপাতি, গ্রহস্থালি আসবাবপত্র, জ্বালানি থেকে শুরু করে আরো অনেক ক্ষেত্রে বাঁশ-বেতের ব্যবহার ছিল অনিবার্য। এখন বাঁশ ও বেতের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এর দামও বেড়ে গেছে। ফলে বাঁশ ও বেতের সামগ্রীর ব্যয়ও বেশি হচ্ছে। তাই আগের মতো এগুলো কম দামে বিক্রি করতে পারছে না। এদিকে ক্রেতারা এগুলোর দাম অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় ক্রয় করছে না। আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বাঁশের তৈরি শিল্পকর্ম দীর্ঘস্থায়ী না হওয়া এই শিল্পকর্মের উপর আগ্রহ হারানো অন্যতম একটি কারন।

ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প

নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক

বাঁশি বিশেষকরে অলঙ্কৃত বাঁশি লোকবাদ্যযন্ত্রের অন্যতম প্রধান উপাদান যা বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক। বাঁশ ও বেতের তৈরি কুলা, চালুন, খাঁচা, মাচা, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুঁড়ি, ডুলা, মোড়া, মাছ ধরার চাঁই, মাথাল, সোফাসেট, বইপত্র, মাছ ধরার পলো, হাঁস, মুরগির খাঁচা, শিশুদের ঘুম পাড়ানোর দোলনা রাখার র‌্যাকসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, বাঁশের ঘর, বেড়া, ঝাপ, বেলকি ও দরমা ইত্যাদি। ইদানীং নগরজীবনে বাঁশের তৈরি আসবাব, ছাইদানি, ফুলদানি, প্রসাধনী বাক্স, ছবির ফ্রেম, আয়নার ফ্রেম, কলম ইত্যাদিও লক্ষ করা যায়।

বিলুপ্তর পথে

আমাদের এ মূলবান বনজ সম্পদ বাঁশ ও বেত প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ায় ঐতিহ্যবাহী এ কুটিরশিল্প এখন ধ্বংসের মুখে। এ শিল্পে জড়িত অনেকেই বাপ-দাদার আমলের পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় মনোনিবেশ করছে। বাংলার ঐতিহ্য বাঁশ ও বেতের সামগ্রীকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর পেছনের মানুষগুলোকে আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে তাদের পেশাকে বাঁচাতে হবে। প্রয়োজন হলে এদের জন্য বিনা সুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় এসব সুন্দর বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্প এক দিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাঁশ ও বেতশিল্পকে বাঁচাতে আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত। নতুবা এক দিন আমরা আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে হারিয়ে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ব।

ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প

সম্ভাবনার কথা বলতে চাই

বিভিন্ন জেলার ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন বাঁশ-বেতের শিল্পের আরো সম্প্রসারণ এর জন্য নানা উদ্যেগে নিচ্ছে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবে মেলার আয়োজন করে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে। আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাঁশ ও বেতের দোলনা থেকে শুরু করে সোফা, ওয়ালম্যাট, আরামদায়ক বিভিন্ন চেয়ারসহ নানা সৌখিন পণ্য তৈরি হচ্ছে। যার ফলে দিন দিন এ শিল্পের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করছে গুটি কয়েক উদ্যোক্তা। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সব স্তর থেকে। তবেই ফিরে আসবে আমাদের সোনালি অধ্যায়।



বাঁশ

বাঁশ কোনো গাছ নয়। এটি মূলত এক ধরণের ঘাস এবং চীর সবুজ বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ যা নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে জন্মায়। বাঁশ গাছ সাধারণত একত্রে গুচ্ছ হিসেবে জন্মায়। এবং খুব দ্রুত বড় হয়। চারা রোপণের পর পাঁচ বছরেই পূর্ণাঙ্গ বাগানে পরিণত হয়। এক একটি গুচ্ছে ১০- ৮০ টি বাঁশ গাছ থাকতে পারে। এসব গুচ্ছকে বাঁশঝাড় বলে।

পৃথিবীতে ৩০০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট ৩৩ প্রজাতির বাঁশ সংরক্ষণ করেছে। এরমধ্যে রয়েছে বাইজা বরাক, কাটা বরাক, শিলবরাক, মিতিঙ্গা, রফাই, ঢোল, কালী, মুলি, বারিয়াল, তুলা, ঝাওয়া বাঁশ ইত্যাদি। তারমধ্যে মুলিবাঁশ, তল্লাবাঁশ ও বইরা বাঁশ দিয়ে শিল্পকর্ম করা সহজ হয়।

চীনের সভ্যতায় বাঁশকে শুভশক্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। একারণে চীনা সংস্কৃতির সর্বত্র রয়েছে বাঁশের ব্যবহার। তবে বাংলাদেশে এই শব্দটাই বেশ সংবেদনশীল এবং নেতিবাচক উপমায় ব্যবহার হয়।

বাঁশ শিল্প একটি লোকশিল্প। এর প্রধান মাধ্যম বাঁশ। সাধারণত গ্রামের লোকেরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত এবং বেশির ভাগ তারাই এসব ব্যবহার করে।

খাদ্য হিসেবেও বাঁশ ব্যবহৃত হচ্ছে। পুষ্টি উপাদান ও মুখরোচক স্বাদের জন্য পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের কাছে খাবার বাঁশ কোড়ল নামে পরিচিত। খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে বাঁশ হার্টের জন্য ভালো। ফাইবার থাকায় এটি কোষ্ঠকাঠিন্যে উপশম দেয় এবং হজমশক্তি বাড়ায়।

ওয়ার্ল্ড ব্যাম্বু অর্গানাইজেশনের তথ্যমতে, বাঁশ অন্যান্য গাছগাছালির চেয়ে বেশি অক্সিজেন উৎপাদন করে আর বেশি মাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। ফলে বাতাস বিশুদ্ধ থাকে। বলা হয় বাঁশঝাড় আশেপাশের তাপমাত্রাকে চার ডিগ্রি পর্যন্ত ঠান্ডা রাখতে সক্ষম। জাপানে প্রচুর বাঁশের ঘর দেখা যায়। কারণ এসব ঘর ভূমিকম্প সহনীয়। ভূমিকম্পের সময় বাঁশঝাড়ে আশ্রয় নেয়া সবচেয়ে নিরাপদ।

বেত গাছ

বেত গাছ বাংলাদেশ, ভুটান, কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত, জাভা ও সুমাত্রা অঞ্চলের উদ্ভিদ। এটি বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ।

বেতগাছ সাধারণত গ্রামের রাস্তার পাশে, বসতবাড়ির পেছনে, পতিত জমিতে ও বনে কিছুটা আর্দ্র জায়গায় জন্মে। গ্রাম বাংলার কৃষকের কাছে অতি প্রয়োজনীয় গাছ হিসেবে পরিচিত ছিলো এক সময়। কিন্তু বর্তমানে মানুষ তার প্রয়োজনে ঝোঁপ-ঝাড়ের সংখ্যা কমিয়ে ফেলেছে।

বাংলাদেশে ছয় প্রজাতির বেত পাওয়া যায়।
বেত গাছ বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে। এই সব বেত গাছের মধ্যে রয়েছে জায়ত বেত, গোলাফ বেত, কেরাক বেত, পাটি বেত ইত্যাদি। পাটি বেত সাধারনত পানি সংলগ্ন স্থানে জন্মে থাকে। সেই জন্যে পুকুরের পাড়ের অল্প পানিতে লাগানো হয়। বেত গাছ মাটি ক্ষয় রোধ করে। তাছাড়া পুকুরের পাড় অক্ষত করে রাখে বেত গাছের শিকড়। এই বেত দিয়ে বিছানার পাটি তৈরী করা হয় । আবার গৃহ নির্মাণ কাজেও ব্যবহার করা হয়। জায়ত বেত ঘরের বেড়া ও খুঁটি বাঁধার কাজে ব্যবহত হয়। লম্বা এই বেত ফালা করে নানা কিছু বাঁধার কাজে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়।

এদের কাণ্ড দেখতে চিকন, লম্বা, কাঁটাময় ও খুবই শক্ত এবং শাখাহীন। সরু ও নলাকার কাণ্ড প্রস্থে সাধারণত ৫-১৫ মিলিমিটার। প্রতিটি কাণ্ডের আগা থেকে নতুন পাতা বের হয় ও বেড়ে ওঠে। কাণ্ড বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর নিচের অংশ পোক্ত হতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই বেত ঘন হয়ে ঝাড়েও পরিণত হয়। বেতগাছ জঙ্গলাকীর্ন কাঁটাঝোপ আকারে দেখা যায়। বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ

বেতগাছের ফলকে বেতফল, বেত্তুন, বেথুন, বেথুল, বেতগুলা, বেত্তুইন ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। এই ফল ছোট, গোলাকার বা একটু লম্বাটে গোলাকার হয় এবং স্বাদে কষযুক্ত টক-মিষ্টি। বেতগাছে ফুল আসে অক্টোবর মাসে আর ফল পাকে মার্চ-এপ্রিল মাসে। এটি অপ্রচলিত ফল হলেও অনেকের কাছে খুবই প্রিয়।

বেত এক সময় গ্রামীণ জনজীবনের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরির অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল। বেত দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প যেমন চেয়ার, টেবিল, মোড়া, ডালা, কুলা, চাঙ্গারী, মুড়া, ঢুষি, হাতপাখা, চালোন, টোকা, গোলা, ডোল, ডুলা, আউড়ি, চাঁচ, ধামা, পাতি, বই রাখার তাক, সোফা, দোলনা, খাট, ঝুড়ি, টেবিলল্যাম্প, ল্যাম্পশেড ইত্যাদি তৈরী হয়। 

ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প তৈরীর ছবি



তথ্যসূত্র:

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

protidinersangbad.com

somoyercinta.com

protidinerbangladesh.com

www.bbc.com

alokitobangladesh.com


July 29, 2020
ART AND CRAFT MAP OF BANGALDESH KHULNA division খুলনা বিভাগ x bfa x fxyz cover photo

হস্ত ও কারুশিল্প মানচিত্র | খুলনা বিভাগ

fayze hassan
অজানা রূপ-রহস্য আর রোমাঞ্চে ভরা বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবন। বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা জুড়ে এর বিস্তৃতি।…
July 29, 2020

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Instagram did not return a 200.
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!