‘বয়কট’ শব্দটা শুনলে আমাদের মাথায় যে বিষয়গুলো ঘুরপাক খায় তেমনই শব্দযুক্ত হলো- ‘ক্যানসেল কালচার’ বা কল-আউট কালচার।
‘ক্যানসেল কালচার’ বা কল-আউট কালচার মূলত এমন একটা টার্ম যা দিয়ে অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা সামনাসামনি কাউকে তার সামাজিক বা পেশাদার গণ্ডি থেকে বের করে দেওয়া হয়। বা জনগণের আদালতে তাকে পরোক্ষভাবে শাস্তি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এই বাতিল বা ক্যানসেল বা বয়কটরে ডাক যে শুধু কোনো ব্যক্তিকে ঘিরে হয় তা নয়। আপত্তিকর বলে বিবেচিত হলে কোনো কোম্পানি, সংগঠন, সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে বয়কটের আওতায় ফেলা হয়।
এই ধরুন ভারতের পণ্য বয়কটের ডাক কিংবা এলজিবিটিকিউ ইস্যু নিয়ে দেশীয় ফ্যাশন ব্রান্ড আড়ং কে বয়কটের ডাকই হলো পশ্চিমা বিশ্বের বহুল প্রচলিত একটি মুভমেন্ট ‘ক্যানসেল কালচার’।
অনেকে মনে করেন, যখন অন্য কিছু আর কাজ করে না তখন জনসমক্ষে জবাবদিহির এবং বয়কট করার এই প্রক্রিয়াটি সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি হাতিয়ার যা জনগনের আদালত বলা যায়। সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে লড়াইয়ের একটি উপায় হয়ে উঠছে এই ক্যানসেল কালচার।
ক্যানসেল কালচারের চর্চা এখন মূলধারার গণমাধ্যম ছাড়িয়ে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে করা হয়।
ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে ক্যানসেল কালচার
Cancel culture in the fashion world
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যানসেল কালচার নুতন না হলেও স্যোসাল মিডিয়ার কারনে এই টার্মসটা বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এটা হয়েছে মুলত ইন্টারনেট ও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সহজলভ্যতার কারনে। যে কোনো তথ্য খুব অল্প সময়ের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। সাথে সাথে যুক্ত হচ্ছে নানা প্রান্ত থেকে সেই বিষয়ক সমর্থক। তা রুপ নেয় আন্দোলনের। এটা মূলত নন-ভায়োলেন্ট প্রোটেস্ট। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সারদের মতামত গুলো বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়ে জেন জি -রা আরো শক্তিশালী করে তোলে সেই আন্দোলন।
ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে ক্যানসেল কালচারের বেশ উদাহরন আছে। আমাদের দেশীয় পর্যায়ে বলা যায় দেশীয় ব্রান্ড আড়ং ২০১৪ সালে ঈদ উল আজাহ এবং পূজার ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠে সোস্যাল মিডিয়া। ওই ক্যাম্পেইন এর সময় দেশে বন্যা চলছিল। আর তাদের ক্যাম্পেইনের এলিমেন্টস ও ছিলো পানি। অভিযোগ আসে যে সারাদেশের বন্যকে আড়ং হাস্যরসাত্মক ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। এমন ভাবে উপস্থাপনের কারনে ২টা ছবিকে রেড ফ্লাগ দেখানো হয়। এবং জানা যায় যে, যারা প্রতিবাদ করেছিলো তাদের প্রতি সন্মান দেখিয়ে ছবিগুলো স্যোসাল মিডিয়া এবং বিলবোর্ড থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। প্রশ্ন থেকে যায় আসলেই এটা হাস্যরসাত্মক ভাবে উপস্থাপন ছিলো নাকি শুধুই একটা ক্যাম্পেইন?
SHOP ONLINE: aarong.com
অনেকে মনে করেন এসব দ্রুত সিদ্ধান্ত শিল্পের জন্য হুমকি স্বরূপ। কারন ফ্যাশন ইন্ড্রাস্টিট্রি হলো আর্টের একটি ফর্ম। সেখানে ডিজাইনার তার ফিলোসফি দিয়ে একটা নকশা বা প্যাটার্ন তৈরি করে, মার্কেটিং টিম সেই ডিজাইনকে ব্রান্ডের ভ্যলুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ক্যাম্পেইন সেট করে। সেই সব ডিজাইন বা ক্যাম্পেইন সাধারন ক্রেতাদের কাছে সবসময় পরিস্কার ভাবে বোধগম্য নাও হতে পারে। তাই অতিদ্রুত কোনো ফ্যাশন আইটেম বা ফ্যাশন ব্রান্ডকে বয়কটের আওতায় ফেলে নিজেদের ট্রেন্ডি জাহির করতে গিয়ে যেনো শিল্পের হুমকির কারন হয়ে না দাড়ায়। কারন একটা শিল্পের সাথে বিশাল এক জনগোষ্ঠি জড়িত।
ক্যানসেল কালচারের ব্যবহার-অপব্যবহার
The Uses and Misuse of Cancel Culture
তবে এই ক্যানসেল কালচারের একটি বড় সমালোচনা হলো অনেকে এটির অপব্যবহার করছে। এসব আন্দোলন, প্রতিবাদ কিংবা বর্জন ক্ষেত্রবিশেষে বৃহৎ আকারে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে পারে। খুব অল্প সময়ের মাধ্যমে স্যোসাল মিডিয়া ব্যাবহারকারীরা ঘটনা সঠিক নাকি উদ্দেশ্যমূলক, আর মূল ঘটনাই বা কি এসব গভিরে চিন্তা না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। এবং প্রতিক্রিয়া স্বরূপ নেগেটিভ রিপোর্ট, ব্লক কিংবা ট্রল এর মত কাজ করে ফেলে। যার কারনে বিপরীত দিকে অবস্থানকারীর পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন সম্ভব হয় না। এমনকি বহু বছর আগে করা ভুলের জন্য কোনো কোনো বিষয়ে নতুন করে সমালোচনা করে বর্জন এর মত আন্দলনে নেমে পড়ে। যা গভীর ভাবে খোঁজ নিয়ে দেখা হয় না। এটি বর্তমানে সত্যের বিপরীতে নিয়ন্ত্রণহীন মব সাইকোলজিতে পরিণত হয়েছে।
ক্যানসেল কালচারের ফলে অধিকাংশ সময়ই লঘু পাপে গুরু দন্ড পেতে হয়। ফলশ্রুতিতে অনেকেই স্বাধীনভাবে নিজের মতামত দিতেও ভয় পায়। বিভিন্ন ট্যাগ পেয়ে ক্যারিয়ার ধ্বংসের ভয়ে অনেকেই নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে পারে না। এই তথাকথিত ‘ক্যানসেল কালচার’ বাকস্বাধীনতার জন্য এক বিরাট অন্তরায়।
ক্যান্সেল কালচারের এর কিছু উদাহরণ
Some examples of cancel culture
এই ধরুন কয়েক বছর আগে রাসুলুল্লাহ স.-এর ব্যঙ্গচিত্র (নাউজুবিল্লাহ) তৈরি করার দরুন ফ্রান্সকে বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছিল৷ অনুরুপ ভারতের পণ্য বর্জনের যে ডাক পরেছে। এবং সবাই তার সাড়া দিচ্ছে যার যার জায়গা থেকে।
বেশ কয়েক বছর আগে বিখ্যাত হ্যারি পটারের লেখিকা জে. কে. রোউলিং ক্যানসেল কালচারের শিকার হন৷ বিভিন্ন বইমেলা ও অনুষ্ঠান থেকে তার বই বিক্রি করা বাতিল করা হয়েছিল৷ তার অপরাধ ছিল সমকা মিতা বিরোধী মন্তব্য করা৷
একইভাবে হলিউড অভিনেতা জনি ডেপের কথাও ধরা যায়৷ নারীবাদী কমিউনিটির প্ররোচনায় ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রি ও অডিয়েন্স থেকে তাকে বয়কট করার আহ্বান করা হয়৷ ফলে তাকে অনেকগুলো চলচ্চিত্রের কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়, এবং তার ক্যারিয়ার হুমকিতে পড়ে। যদিও পরবর্তী সময় সে কেস জিতে যায়৷
প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদী বৈশিষ্ট্যের কারণে ড. সিউসের ৬টি বইয়ের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
পরিশেষে
বিনা অপরাধে এবং উদ্দেশ্যমূলক ভাবে এই সংস্কৃতির শিকার হতে পারে যেকোনো মানুষ, সংগঠন বা দেশ ৷ এতে তার মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে৷ তাই কোনো আন্দোলনের সাথে যুক্ত হতে হলে চিন্তা-ভাবনার গভীরতা কাজে লাগতে হবে। একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের মতে অ্যাক্ট করতে হবে।
আমাদের সাথে সংযুক্ত হতে পারেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
তথ্যসূত্র:
dailysangram.com
somewhereinblog.net
bangla.thedailystar.net
canvas magazine