rickshaw art রিকশা আর্টের উত্থান Bangladesh x bfa x fxyz web

রিকশা আর্টের উত্থান: গণমানুষের ক্যানভাস থেকে এলিট শোকেসে

শহরের প্রতিটি কোণায় এই বর্ণাঢ্য রিকশা আর্ট গুলো যেন এক একটা ভ্রাম্যমাণ ক্যানভাস। একটি উজ্জ্বল এবং অনন্য শিল্পরূপ

rickshaw
art

টিং টিং শব্দ তুলে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় এগিয়ে যাচ্ছে তিন চাকার রিকশা। তার পেছনে ঝলমলে রঙে আঁকা চিত্রগুলো সবার নজর কেড়ে নিচ্ছে। কখনো নীল, কখনো লাল, আবার কখনো সবুজের মিশেলে সজ্জিত এসব চিত্র ঢাকার এক পরিচিত দৃশ্য। শহরের প্রতিটি কোণায় এই বর্ণাঢ্য রিকশাগুলো যেন ভ্রাম্যমাণ ক্যানভাস হয়ে উঠে আসে, রিকশা আর্ট ঢাকার দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিশে গিয়ে তৈরি করে এক নিজস্ব শিল্পধারা। শিল্পের এই ধারাটি কেবল রিকশাকে নয়, পুরো শহরের চেহারায় এনে দেয় এক নতুন মাত্রা।

রিকশা শিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লোকশিল্পীরা তাঁদের সৃজনশীলতা এবং নৈপুণ্য দিয়ে এই রিকশাগুলোকে আলংকারিক চিত্রকলায় সাজিয়েছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গণমানুষের শিল্পটি বদলে গেছে। এখন এটি আর কেবলমাত্র সাধারণ মানুষের রিকশার পেছনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এলিট শ্রেণির শোকেসে পরিণত হয়েছে। ফ্যাশন, গ্যালারি এবং অভিজাতদের ঘরের দেয়াল সেজে উঠেছে এই রিকশা চিত্রকলা দিয়ে। তবে, এই পরিবর্তনের ফলে মূল শিল্পীদের অধিকার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। যারা একসময় এই শিল্পের প্রবর্তক ছিলেন, আজ তারাই নিজেদের সৃষ্টির ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছেন, যেন তাঁদের শিল্পকর্ম এখন তাঁদের নিজস্ব নয়, বরং পণ্যে পরিণত হয়েছে।

রিকশা আর্ট
Captured by Bipul Hossain

Story of rickshaw art

রিক্সা আর্ট

রিকশা আর্ট, একটি উজ্জ্বল এবং অনন্য শিল্পরূপ, যা বহু দশক ধরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে। ১৯৪০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া এই চিত্রকলার ধারাটি প্রথমে ঢাকার রিকশাগুলোকে সাজানোর মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়। সাধারণত ফুল, প্রাণী, চলচ্চিত্রের তারকা, স্থানীয় নায়ক এবং ঐতিহ্যবাহী মোটিফ দিয়ে রিকশার পেছনের ক্যানভাসগুলো সজ্জিত করা হতো। এই নকশাগুলো কেবল আলংকারিক উদ্দেশ্যে তৈরি হতো না; এগুলো ছিল রিকশাচালক ও মালিকদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের প্রকাশ এবং গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যম।

প্রতিটি রিকশা যেন ছিল চলমান একেকটি ক্যানভাস, যার মাধ্যমে শিল্পীরা তাঁদের নিজস্ব সৃজনশীলতা ও শৈল্পিক দক্ষতা ফুটিয়ে তুলতেন। এই শিল্পরূপটি সম্পূর্ণভাবে লোকশিল্পীদের হাত ধরে তৈরি হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকে গ্রামের লোকশিল্পের ধারায় কাজ করতেন। তাঁরা জটিল নকশা ও উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার করে রিকশাকে একটি ভ্রাম্যমাণ শিল্পকলা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, যা শহরের সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ও প্রিয় হয়ে উঠেছিল।

তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্পের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। প্রাথমিকভাবে রিকশাগুলো ছিল গণমানুষের যাতায়াতের বাহন এবং সেগুলোতে আঁকা শিল্প ছিল গণমানুষেরই জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে রিকশা চিত্রকলাকে লোকশিল্প থেকে বের করে আনা হয়েছে, যা ফ্যাশন, গ্যালারি এবং উচ্চবিত্তদের মধ্যে সাংস্কৃতিক মূলধন হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে এই শিল্পটি সামাজিক শ্রেণীভেদ এবং পণ্যায়নের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে, যেখানে সাধারণ মানুষ ও প্রকৃত শিল্পীরা ধীরে ধীরে তাঁদের সৃষ্টিশীলতার ওপর থেকে প্রভাব হারাতে শুরু করেছেন।

রিকশা
চিত্রকলার
ইতিহাস

বাংলাদেশে রিকশা চিত্রকলার ইতিহাস শুরু হয় ১৯৪০-এর দশকে, যখন শিল্পীরা রিকশাকে উজ্জ্বল রং এবং জটিল নকশায় সাজাতে শুরু করেন। এই শিল্পধারাটি প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলার আধুনিক ধারার বাইরে, লোকশিল্পীদের হাত ধরে গড়ে ওঠে এবং পূর্ব বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৫০ এবং ৬০-এর দশকে এই শিল্প আরও বিস্তৃত হয়, দেশের শহর ও গ্রামের রাস্তায় রিকশাগুলো ভ্রাম্যমাণ শিল্পকর্ম হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকে।

তৎকালীন বিখ্যাত রিকশা শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন আর কে দাস, আলীনুর, দাউদ উস্তাদ এবং আলাউদ্দিন, যাঁরা তাঁদের সৃজনশীলতার মাধ্যমে এই শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। ছবির প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদা তাঁদেরকে পৈতৃক পেশা ছেড়ে রিকশা চিত্রকলায় নিয়ে আসে। এটি মূলত একটি আলংকারিক শিল্প হিসেবে শুরু হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিযোগিতামূলক বাজারে রিকশাগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা।

কালের প্রবাহে, রিকশার নকশা কেবল ঐতিহ্যবাহী মোটিফে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এতে যোগ হয় চলচ্চিত্র তারকার ছবি, পৌরাণিক প্রাণী, এমনকি রাজনৈতিক বার্তাও। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর, দেশপ্রেমের প্রভাব রিকশা চিত্রকলায় প্রবল হয়ে ওঠে। শিল্পীরা যুদ্ধের নির্যাতন, স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব চিত্রায়িত করেন, যা রিকশাগুলোর ক্যানভাসে ফুটে ওঠে।

১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, রিকশা চিত্রকলার বিষয়বস্তু আরও বৈচিত্র্যময় হয়, যেখানে চলচ্চিত্র তারকা এবং সাধারণ মানুষের ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সময়ের সাথে সাথে, এই উজ্জ্বল এবং সৃজনশীল শিল্পকর্মগুলো শহুরে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়, যা শহরের বাসিন্দা এবং পর্যটকদের মুগ্ধ করে তোলে। তবে রাস্তায় এর বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণী দীর্ঘদিন ধরে রিকশা শিল্পকে একটি বৈধ শিল্পরূপ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।



রিকশা আর্ট

“Cultural Appropriation and Cultural Capital:
Understanding the Dynamics
of Artistic Value and Social Inequality”
.

সাংস্কৃতিক অধিগ্রহণ ও
সাংস্কৃতিক মূলধন
.

রিকশা শিল্প প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি পেতে শুরু করে ১৯৮০-এর দশকে। ১৯৮৮ সালে লন্ডনের মিউজিয়াম অব ম্যানকাইন্ডে (বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অন্তর্ভুক্ত) শিরিন আকবরের কিউরেটিংয়ে ঢাকার রিকশা পেইন্টিং নিয়ে একটি বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘ট্রাফিক আর্ট: রিকশা পেইন্টিং ফ্রম বাংলাদেশ’। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের রিকশা চিত্রকলার বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার পথ খুলে যায়। ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের রিকশার সুসজ্জিত এবং চিত্রিত উদাহরণগুলো সংরক্ষিত হয়েছে, যা এই শিল্পের গুরুত্বকে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরে।

এ ছাড়া, জাপানের ফুকুয়োকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামে রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে রিকশা চিত্রকলার একটি বড় সংগ্রহ সংরক্ষিত রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে (২০১৩) জাপানের তাকামাতসু শহরে অনুষ্ঠিত আর্ট ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের রিকশাচিত্র বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। এমনকি নেপালেও বাংলাদেশের রিকশা চিত্রকলার প্রদর্শনী হয়েছে, যা এই শিল্পরূপের ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক পরিচিতির প্রমাণ।

তবে বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালে ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। এ প্রদর্শনীতে ৫০০ জন রিকশা পেইন্টার এবং ৮৩ জন বেবিট্যাক্সি পেইন্টার (দুই স্ট্রোকবিশিষ্ট অটোরিকশা) তাঁদের শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেন। এই প্রদর্শনী রিকশা চিত্রকলার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।

তবে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত রিকশা শিল্প এলিট শ্রেণীর ঘরে প্রবেশ করেনি। ২০০০-এর দশকের শুরুতে রিকশা চিত্রকলাটি ধনীদের বাড়িতে প্রবেশ করতে শুরু করে, তবে তা কার্যকরী বস্তু হিসেবে নয়, বরং উচ্চ ফ্যাশন আইটেম এবং আলংকারিক উপকরণ হিসেবে। এই ধারা রিকশা শিল্পের পণ্যায়নের শুরু নির্দেশ করে, যা একসময়ের গণমানুষের শিল্পকে একটি অভিজাত পণ্য হিসেবে রূপান্তরিত করে।

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বোর্দোর ধারা

রিকশা চিত্রকলার পণ্যায়ন বোর্দোর সাংস্কৃতিক মূলধন ধারণাকে কার্যকরভাবে চিত্রিত করে। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বোর্দোর মতে, সাংস্কৃতিক মূলধন বলতে সেই অ-অর্থনৈতিক সম্পদগুলিকে বোঝায় যা সামাজিক স্তরের পরিবর্তন বা গতিশীলতাকে সক্ষম করে। এর মধ্যে শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা, শৈলী এবং রুচি অন্তর্ভুক্ত। বোর্দোর ধারণায়, সাংস্কৃতিক মূলধন তিনটি রূপে বিভক্ত:


১. অবিচ্ছিন্ন (Embodied): ব্যক্তির মধ্যে নিহিত জ্ঞান, দক্ষতা, এবং শিক্ষা।


২. বস্তুগত (Objectified): সংস্কৃতিগত পণ্য, যেমন শিল্পকলা, সাহিত্য, এবং অন্যান্য বস্তু যা সাংস্কৃতিক মূল্য বহন করে।


৩. প্রতিষ্ঠানিক (Institutionalized): প্রত্যয়নপত্র বা যোগ্যতার স্বীকৃতি, যা সামাজিক সম্মান প্রদান করে।

রিকশা চিত্রকলা যখন শুধু গণমানুষের হাতের তৈরি শিল্প ছিল, তখন এটি প্রধানত অবিচ্ছিন্ন মূলধনের অংশ হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু যখন এটি বস্তুগত রূপে পণ্যায়িত হতে শুরু করল, তখন তা উচ্চবিত্ত সমাজে অবস্থান করে সাংস্কৃতিক মূলধনের প্রতীক হয়ে ওঠে। এই শিল্পকর্মগুলো বাড়ির দেয়ালে বা ফ্যাশন পণ্যের অংশ হিসেবে প্রদর্শিত হয়, যা এলিটদের রুচি এবং সামাজিক অবস্থান প্রকাশ করে।

এই প্রক্রিয়ায়, রিকশা আর্ট কেবল এক ধরনের গণমানুষের অভিব্যক্তি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়নি, বরং তা এলিট শ্রেণীর সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থান জোরদার করার একটি উপায় হয়ে উঠেছে, যা বোর্দোর তত্ত্বের নিখুঁত উদাহরণ।

এই শিল্পের প্রকৃত মালিক কে?

একদম সঠিক, এই বিশ্লেষণ রিকশা শিল্পের পণ্যায়ন এবং সাংস্কৃতিক মূলধনের বিকাশকে চিত্রিত করে। যখন রিকশা চিত্রকলার কাজ মূলত নিম্নবিত্ত মানুষের দ্বারা তৈরি করা হত, তখন এটি উচ্চবিত্তদের চোখে অবমাননীয় ও নিম্নমানের হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু যখন ফ্যাশন ডিজাইনার এবং উচ্চমানের দোকানগুলি, যেমন আড়ং এবং যাত্রা, রিকশা চিত্রকলাকে তাদের সংগ্রহে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করল, তখন এই শিল্পকর্মের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ও বৈধতার দাবি হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

এই পরিবর্তনটি সাংস্কৃতিক উৎপাদনের জগতের প্রভাবশালী ক্ষমতার গতিশীলতাকে প্রতিফলিত করে। এটি দেখায় যে কীভাবে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর রুচি এবং পছন্দগুলি প্রতিষ্ঠা করে, কোন ধরনের শিল্প “শিল্প” হিসেবে গণ্য হবে। এই প্রক্রিয়ায়, রিকশা চিত্রকলার অধিগ্রহণ কেবল সাংস্কৃতিক বৈধতার একটি চিহ্ন নয়, বরং এটি সামাজিক শ্রেণীবিভাজনকে পুনর্বলিত করার একটি ক্লাসিক উদাহরণ।

এখন যে শিল্পকর্ম একসময় উপেক্ষা অথবা উপহাস করা হত, তা আজ উচ্চবিত্তদের দ্বারা উদযাপিত হয়। কিন্তু এই পরিবর্তন শুধুমাত্র শিল্পটির অর্থ ও মূল প্রেক্ষাপটকে পরিবর্তন করে না, বরং যারা এটি তৈরি করেছে, তাদের বর্জনকেও বাড়িয়ে দেয়। এই পরিস্থিতি রিকশা শিল্পের প্রাকৃতিক উৎপত্তি এবং তার ঐতিহ্যকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে, যখন এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মুনাফার উদ্দেশ্যে পণ্যায়িত হয়।

এভাবে, রিকশা চিত্রকলার এই ট্রান্সফরমেশন আমাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরে: আসলে এই শিল্পের প্রকৃত মালিক কে? এবং যারা এটি তৈরি করেছে, তাদের সাংস্কৃতিক অবদান কিভাবে মূল্যায়িত হবে?

আরও পড়ুন

রিকশার বাইরে রিকশা আর্ট– পণ্যের পসরায়, ফ্যাশনে ও যাপনে

শিল্প কীভাবে পণ্য হয়ে ওঠে? এর উত্তরটা লেখা আছে পুঁজিবাদের হালখাতায়। ভোগবাদের মধ্য দিয়ে আমরা ভ্যান গখের স্টারি নাইট হোক বা যামিনী রায়ের আঁকা ছবি, সবকিছুকেই নতুনভাবে বিক্রির একটা চিন্তা করি।

রিকশা আর্ট
Captured by Bipul Hossain

Benefiting the craftsmanship

প্রকৃত শিল্পীদের জন্য লাভবান হওয়া

রিকশা চিত্রকলার পণ্যায়ন আয়ের বৈষম্যের বিষয়টি এখানে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে আসল শিল্পীরা নিজেদের কাজের সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফ্যাশন এবং গৃহসজ্জার জগতে রিকশা চিত্রকলার জনপ্রিয়তা উচ্চবিত্তদের জন্য আর্থিক সুবিধা বয়ে এনেছে, কিন্তু সেই লাভের কিছুই আসল শিল্পীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।

এই বৈষম্য শুধু শোষণের একটি চিত্র নয়, বরং এটি বোর্দোর শ্রেণীভেদ তত্ত্বের একটি প্রতিফলন, যেখানে উচ্চবিত্তরা নিজেদের সুবিধা অর্জনের জন্য লোকজ শিল্পের উপর নির্ভরশীল হচ্ছে। এটি রিকশা শিল্পের মালিকানা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গীকারের স্বরূপকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

সমস্যার সমাধানের জন্য যে উদ্যোগগুলো প্রয়োজন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজাইনারদের এবং রিকশা শিল্পীদের মধ্যে অংশীদারিত্বের উদ্যোগ একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। এতে আসল শিল্পীরা তাদের কাজের থেকে আয়ের একটি অংশ পেতে পারেন, যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক হবে। এছাড়াও, রিকশা শিল্পীদের জন্য বাজারজাতকরণের প্রয়োজনীয় সম্পদ এবং প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রোগ্রামগুলি তাদেরকে স্বাধীনভাবে তাদের কাজের বাজার তৈরি করতে সাহায্য করবে।

এই ধরনের উদ্যোগগুলি কেবল রিকশা শিল্পের প্রান্তিক শিল্পীদের জন্য ন্যায়বিচারই প্রদান করবে না, বরং এটি একটি টেকসই শিল্প পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে, যেখানে আসল শিল্পীরা তাদের সৃষ্টি ও অবদানের জন্য সম্মানিত ও পুরস্কৃত হন। এর ফলে, রিকশা চিত্রকলার সাংস্কৃতিক মূল্য এবং ঐতিহ্যও সংরক্ষিত থাকবে, যা সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তাদের স্বীকৃতি প্রদান করবে।

ঢাকার রাস্তাগুলো থেকে উচ্চমানের দোকানের তাক পর্যন্ত রিকশা চিত্রকলার যাত্রা আমাদের রুচি এবং বৈধতার মূল্যবোধের উপর সাংস্কৃতিক মূলধনের ক্ষমতার সাক্ষ্য দেয়। বোর্দো তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই কীভাবে উচ্চবিত্তদের দ্বারা রিকশা চিত্রকলার অধিগ্রহণ বিদ্যমান সামাজিক শ্রেণীবিভাজনকে শক্তিশালী করতে কাজ করে, এবং এই প্রাণবন্ত ও অভিব্যক্তিমূলক শিল্পের মূল স্রষ্টাদের প্রান্তিক করে তোলে।

অতএব, আমাদের ভোক্তা হিসেবে সাংস্কৃতিক পণ্যগুলির উৎস সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং শিল্পীদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করে এমন উদ্যোগগুলোকে সমর্থন করা অত্যন্ত জরুরি। এটি কেবল একটি ন্যায়বিচারের দাবি নয়, বরং বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পের যথার্থতা এবং সম্পদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করারও প্রচেষ্টা। আমাদের কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে, আমরা এই শিল্পের আত্মাকে পুনরুদ্ধার করতে এবং তা সংরক্ষণে সহায়তা করতে পারি, যাতে রিকশা চিত্রকলার শিকড় ও চেতনা বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হই। এই প্রচেষ্টা আমাদের সমাজের গভীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিফলন হিসেবে রিকশা চিত্রকলার প্রকৃত মূল্যকে সম্মান জানাবে, এবং তা সমাজের সকল স্তরের জন্য একটি প্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে।

Unesco recognizes rickshaws and rickshaw paintings in Bangladesh as intangible cultural heritage

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইউনেস্কো রিকশা আর্টকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেয় ‘ইনট্যাঞ্জিবল আর্ট’ ক্যাটাগরিতে।

বিশ্বদরবারের সাথে সাথে রিকশা আর্টের মর্ম বাঙালিও যেন আরো একবার নতুন করে বুঝতে পেরেছে। আরো নতুন করে আবিষ্কার হয়েছে এর উপযোগিতা। সে সময় অনেকেই আবারো রিকশা আর্টকে নিজের মতো করে গ্রহণ করছেন, অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ফেসবুকের কল্যাণে দেখা গিয়েছিল ‘অতিবেগুনী’ নামের একটি স্টোরিটেলিং প্ল্যাটফর্মকে রিকশা আর্টের নকশায় নিজেদের কভার ফটো দিতে। এমন করে বহু মতে, বহু পথে এই বহমান শিল্পকে চর্চার মধ্যে দিয়ে বয়ে নিয়ে, একটি নিরবচ্ছিন্ন স্রোতের মতোই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এর সাথে জড়িয়ে থাকা কারিগর ও পৃষ্ঠপোষকেরা।

রিকশা আর্ট গ্যালারি

রিকশাচিত্র শুধু একটি শিল্প নয়, এটি মানুষের সমকালীন জীবনের গল্প বলার চলমান ক্যানভাস।

রিকশা আর্ট
রিকশা আর্ট rickshaw art x bfa x bipul (10)
রিকশা আর্ট
রিকশা আর্ট
রিকশা আর্ট
রিকশা আর্ট
বাটা তাদের শোরুমে উইন্ডো ডিসপ্লে হিসেবে একটি আস্ত রিকশা বসিয়েছেন

লিখেছেন : মোহাইমিনুল আল মাহীন

ছবিগ্রহন: বিপুল হোসেন


আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিংক


October 11, 2024
clay art মৃৎশিল্প বাংলাদেশের এক প্রাচীন ঐতিহ্য x bfa x fxyz

কাদা মাটি থেকে শিল্প: মৃৎশিল্প বাংলাদেশের এক প্রাচীন ঐতিহ্য

fayze hassan
মৃৎশিল্পের উৎপত্তি সর্বপ্রথম চীনের থাংশান শহরে। এ কারণে থাংশানকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। মৃৎশিল্প বাংলাদেশের…
October 11, 2024

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!
Skip to content