আপনার ছোট বেলার আশে পাশের কোন কিছু হারিয়ে গেছে ভেবে কি আপনার মন খারাপ হয়’? উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন প্রশ্নকর্ত্রী। একটি নামী দৈনিকের তরুন সংবাদদাতা তিনি। গত বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে আমার একটি সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলেন তিনি।প্রশ্নটি শুনে একটু থমকালাম আমি। কত কিছু যেন ছায়াছবির মতো চোখের সামনে দিয়ে যেন ভেসে গেল। ঠিক সে মুহূর্তেই চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম, অদূরে এসে দাঁড়িয়েছে আমার এক এবং অদ্বিতীয় দৌহিত্রী – তাকে খেলতে নিয়ে যেতে হবে। এবার নির্দ্বিধায় নিশ্চিতস্বরে জবাব দিলাম ‘মাঠ ও পুকুর’
সত্যিই তো, আমাদের ছোটবেলায় ছড়াছড়ি ছিল মাঠ ও পুকুরের। আমরা তো বড় হয়েছি মাঠ আর পুকুরের ভেতরেই। আজ ঢাকা শহরে ‘মাঠ ও পুকুর’ নামক বস্তুদ্বয় এমনই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে যে আগামী প্রজন্মের কাছে তা ইতিহাস হয়ে যাবে।
এই যে আমার শিশু দৌহিত্রী। তাকে খেলতে নিয়ে যাবো তার বাবা আর আমি একটি বৃহৎ বিপনী কেন্দ্রের শীর্ষতম তলায় শিশুদের জন্যে কৃত্রিম উপায়ে গড়ে তোলা একটি ক্রীড়াক্ষেত্রে। শিশুদের বিভিন্ন রকম খেলা আর বিনোদনের নানান রকম আধুনিক সরঞ্জাম আছে সেখানে। তার পাশেই আবার মা-বাবা বা অন্যান্যদের চা-কফি-হালকা খাবারের জন্যে রয়েছে একটি ছিমছাম ক্যাফে। শিশুটির খেলার জন্যে প্রথম ঘন্টাতেই দিতে হয় ৩৫০ টাকা, তারপর প্রতি মিনিটে ৬ টাকা করে। তা’ছাড়া আনুসাঙ্গিক খরচপাতি তো আছেই।
সব দেখে শুনে আমার তিনটে কথাই মনে হল। প্রথমত: পুরো ব্যবসাটি কৃত্রিম। বাইরের সবুজ মাঠের স্বাভাবিকতা এখানে নেই। বোঝাই যায় যে, মাঠের অভাব বা অনুপস্থিতিতেই আবির্ভূত হয়েছে এ কাঠামো।
দ্বিতীয়ত: এখানে নেই মাঠের সার্বজনীনতা। দরিদ্র মাতা-পিতা এর প্রবেশমূল্য দিতে পারবে না এবং স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র ঘরের শিশু-কিশোরদের এখানে প্রবেশাধিকার থাকবে না। সুতরাং এখানে সম্পদ পক্ষপাত বড় সুস্পষ্ট।
তৃতীয়ত: শিশু কিশোরেরা এখানে একা একা যেতে পারবে না। মা-বাবাদের লাগবে শিশু-কিশোরদের এ সব জায়গায় নিয়ে যেতে।
এ সব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল আমাদের শৈশব-কৈশোরের কথা। বড় বড় মাঠগুলোর কথা তো বাদই দিলাম, প্রত্যেক বিদ্যালয়ের নিদেন পক্ষে একটা করে মাঠ, তারপর পাড়ায় পাড়ায় মাঠ। মাঠের আশেপাশে গড়ে উঠতো বাড়ী-ঘর।
কোন কোন মাঠকে তো মনে হোত উন্মুক্ত প্রান্তর – যেমন, বরিশালে বি.এম. কলেজের মাঠ, জিলা স্কুলের মাঠ, পরেশ সাগরের মাঠ। খেলার জায়গার অভাব কি? এতো বড় ছিলো মাঠগুলো যে নানান বয়সের ছেলেমেয়েরা নানান খেলা খেলতে পারতো সে সব মাঠে। তবে নিত্যবিকেলের তীর্থক্ষেত্র ছিল পাড়ার মাঠগুলো।
স্কুল থেকে ফিরে কোনরকমে নাকে-মুখে খাবার গুঁজেই দে ছুট মাঠে। তর সইতো না – বন্ধুরা অপেক্ষা করে আছে যে! না, কাউকে আমাদের সঙ্গে যেতে হত না, ঘরের পাশেই তো মাঠ। তারপরের দু’তিন ঘন্টা যে কি ভাবে কেটে যেত, ঠাহরই করতে পারতাম না।
কত যে খেলা – পাড়ার সব ছেলে-মেয়ে সেখানে। অভিভাবকেরা স্নেহময় চোখে দেখতেন সে সব খেলা। কিন্তু নিয়ম ছিল, সন্ধ্যের ছায়া নামলেই ঘরে ফিরতে হবে – হাতের রোঁয়া না দেখা গেলে কিংবা রাস্তার বাতি জ্বলে উঠলেই।
মাঠের মতো বাড়ীর আশে পাশে পাড়ায় পাড়ায় ছিল ছোট বড় নানান আকৃতির পুকুর। নিশ্চয়ই বাড়ীর আর পাড়ার নানান গৃহাস্হালীর কাজে লাগতো এ সব পুকুরগুলো। কিন্তু আমাদের কাছে এগুলো ছিল অনিন্দ্য খেলা আর আনন্দের আকর। ছুটির দিনগুলোতে বন্ধুরা সব দল বেঁধে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম পুকুরের জলে। তারপর শুরু হত ডুব, সাঁতার, হৈ চৈ আর চিৎকার। ঝাঁপাঝাঁপির চোটে জল ঘোলা হয়ে যেত কাদায়, সন্তরণরত হাঁসেরা ভয় পেয়ে ডাঙ্গায় উঠে যেত পাখা ঝাপটিয়ে, বড়রা বকা লাগাতেন। কে শোনে কার কথা? ঘন্টা দুই পরে যখন আমরা জল ছাড়তাম, তখন সারা গায়ের চামড়া সাদা হয়ে গেছে আর চোখ রক্তজবা লাল।
কত কত বড় বড় পুকুরের স্মৃতি মনের গভীরে। বরিশাল শহরের পুলিশ লাইনের পাশের পরেশ সাগরের কথা যেমন মনে আছে, তেমনি মনে আছে শহরের মধ্যিখানের বিবির পুকুরের কথা। দু’টোতেই দাপিয়েছি। মাধবপাশার দূর্গাসাগরে নৌকোয় উঠেছি, কিন্তু জলে নামি নি।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশের রহস্যময় পুকুরের পাশে বসেছি অনেকদিন।
আজ এ সব পুকুর আর মাঠ স্মৃতি মাত্র। মানুষের লাভ আর লোভের পদপ্রান্তে তারা আত্মাহুতি দিয়েছে। মাঠ রেখে কি লাভ? বহুতল ইমারত করলে কতো মুনাফা! বাড়ীতেই তো জল আছে। তা’হলে পুকুরে কি কাজ? ওগুলো বুজিয়ে দিয়ে আবাসন গৃহ বানালে কত টাকা! অর্থের লোভে, সম্পদের লালসায় উবে গেছে তারা দিনের পর দিন।তাই বহুদিন দেখেছি রাস্তায় উইকেট বানিয়ে ক্রিকেট খেলছে কিশোরেরা।
যে অভ্যন্তরীন সুসজ্জিত খেলার জায়গায় আমার দৌহিত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেখানে একটা জিনিষ চোখে আর মনে লেগেছিলো। ঐ ক্ষেত্রের মধ্যে ঢুকেই শিশুরা কোন খেলার সরঞ্জামের দিকে তাকায় নি, কোন কিছু করে নি, কোথাও থামে নি। প্রতিটি শিশু ঢুকেই কোনদিকে না তাকিয়ে প্রথমেই দিয়েছে একটি দৌড় – সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যবিহীনভাবে, মনের আনন্দে, যদ্দূর যাওয়া যায়। বোঝাই যাচ্ছিল, ঐ রকম একটি স্বাধীনতার জায়গা আর তাদের নেই। সে রকম ভোঁ দৌড়ের জন্যেই একটি মাঠের বড় দরকার। আর ঝাঁপ দিয়ে পড়ার জন্যেই দরকার একটি পুকুরের। আর থাকলেই বা কি? করেনার বিশ্ব তো শিশুদের জিম্মি করে রোখেছে।
সূত্র : ফেসবুক
লেখকের ফেসবুক লিংক : ড. সেলিম জাহান