Tareque Masud আবু তারেক মাসুদ _ সিনেমার ফেরিওয়ালা x bfa x fxyz V2 web - Copy

তারেক মাসুদ: সিনেমার ফেরিওয়ালা

তাঁর বিশ্বাস ছিল—চলচ্চিত্র কেবল এলিট বা নগরসমাজের বিনোদন নয়, বরং এটি একটি জনপ্রিয় শিল্প যা সাধারণ মানুষের জীবনের গল্প বলে।

Bangladeshi film director

Tareque
Masud

যিনি সেলুলয়েডে বুনেছিলেন আমাদের জীবনের গল্প। তাঁকে অনেকে ডাকতেন “সিনেমার ফেরিওয়ালা”, কারণ তিনি শহর থেকে গ্রাম—বাংলার প্রতিটি কোণায় সিনেমা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।

Filmmaker Tareque Masud and Catherine Masud Photographer Ratan Paul -1991

সিনেমার ফেরিওয়ালা


বাংলাদেশি স্বাধীনধারার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য নাম তারেক মাসুদ। যিরি জীবনের গল্পকে ক্যামেরায় বন্দি করে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন গ্রামের হাট থেকে বিশ্বমঞ্চে। মুক্তির গান, মাটির ময়না, রানওয়ে—প্রতিটি ছবিতেই ছিল মানুষের স্বপ্ন, সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার গল্প।

তিনি ছিলেন পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক ও গীতিকার—সব মিলিয়ে এক বহুমাত্রিক শিল্পী। তাঁর চলচ্চিত্র মুক্তির গান (১৯৯৫) এবং মাটির ময়না (২০০২) আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে নতুনভাবে পরিচিত করেছিল। মাটির ময়না কানের চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কার (FIPRESCI) জেতে এবং বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কারে মনোনয়নের জন্য পাঠানো হয়।

তারেক মাসুদ মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার রীতি সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল—চলচ্চিত্র কেবল এলিট বা নগরসমাজের বিনোদন নয়, বরং এটি একটি জনপ্রিয় শিল্প যা সাধারণ মানুষের জীবনের গল্প বলে।

তিনি সহিংসতা ও যৌনতার মতো জটিল বিষয়কেও নান্দনিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করতেন। মাটির ময়না-তে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি থাকলেও তিনি সরাসরি সহিংস দৃশ্য না দেখিয়ে ইঙ্গিত ও প্রতীক ব্যবহার করেছেন, যাতে দর্শক নিজেই তা অনুভব করতে পারে।

যেখানে গল্পই থাকে মুখ্য।

১৯৮০-এর দশকে তাঁর পরিচয় হয় মার্কিন নাগরিক ক্যাথরিন শ্যাপেরের সঙ্গে। পরবর্তীতে তাঁরা বিয়ে করেন এবং যৌথভাবে গড়ে তোলেন প্রযোজনা সংস্থা অডিওভিশন। ক্যাথরিন শুধু জীবনসঙ্গীই নন, ছিলেন সহ-চিত্রনাট্যকার, সম্পাদক ও সৃজনসঙ্গী। তাঁদের একমাত্র ছেলে নিশাদ।

শৈশব ও বেড়ে ওঠা
এবং চলচ্চিত্রে আগ্রহের সূচনা

১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্ম নেন তারেক মাসুদ। শৈশবের প্রথম আট বছর কেটেছে স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর শিক্ষাজীবনে বড়সড় বিরতি আনে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি মাদ্রাসা থেকে স্কুলে ভর্তি হন। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

শৈশবের মাদ্রাসাজীবন তাঁর ভেতরে এক ধরনের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণবোধ তৈরি করে, যা পরবর্তীতে মাটির ময়না চলচ্চিত্রের আনু চরিত্রে জীবন্ত হয়ে ওঠে। গ্রামীণ সমাজ, লোকজ সংস্কৃতি আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তাঁর জীবনদর্শনের ভিত হয়ে দাঁড়ায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। দেশে তিনিই প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূচনা করেন। ১৯৮২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স সম্পন্ন করেন। হাতে-কলমে শেখার জন্য বিভিন্ন কর্মশালা ও কোর্সে অংশ নেন।

তাঁর প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সোনার বেড়ি (১৯৮৫) দেখে সাহিত্যিক আহমদ ছফা মুগ্ধ হয়ে তাঁকে চিত্রশিল্পী এস. এম. সুলতানের জীবনের ওপর ডকুমেন্টারি বানানোর প্রস্তাব দেন। সেখান থেকেই জন্ম নেয় আদম সুরত (১৯৮৯)। এই প্রামাণ্যচিত্র তাঁর চলচ্চিত্রজীবনের প্রথম বড় মাইলফলক।

চলচ্চিত্র জীবন

তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র যাত্রা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দিয়ে হলেও তাঁর প্রথম প্রামাণ্যচিত্র ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায় মুক্তির গান—১৯৭১ সালে মার্কিন নির্মাতা লিয়ার লেভিনের ক্যামেরাবন্দী ফুটেজের সাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংরক্ষণাগার থেকে নেয়া ফুটেজ জুড়ে দিয়ে এই ছবিটি নির্মাণ করা হয়। প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য তিনি ১৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার লাভ করেন। এই ছবির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তৈরি হয় মুক্তির কথা (১৯৯৯) ও নারীর কথা (২০০০)—যেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও নারীর অবদান ফুটে ওঠে।

তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় মাইলফলক আসে মাটির ময়না (২০০২) দিয়ে। এটি তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, যেখানে ১৯৬০-এর দশকের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে এক মাদ্রাসাশিক্ষার্থীর গল্প বলা হয়েছে।

‘মাটির ময়না’কে তারেক মাসুদের আংশিক বায়োগ্রাফি বলা যায়। তারেক মাসুদ বাল্যকালে কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন। মাদরাসায় পড়তে গিয়ে তাঁর যে বিচিত্র রকমের অভিজ্ঞতা, তিনি তা আনু চরিত্রে গল্প আকারে সিনেমায় তুলে ধরেছেন।

মাটির ময়না

ছবিটি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং মাসুদ দেশে-বিদেশে বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে। চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং “একটি দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের হৃদয়স্পর্শী ও স্বচ্ছ উপস্থাপনা”র জন্য মাসুদ ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট লাভ করেন। এই ছবির জন্য তিনি ২৭তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া মারাকেচ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ক্যাথরিন মাসুদের সাথে যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কার লাভ করেন ও গোল্ডেন স্টারের মনোনয়ন লাভ করেন এবং কেরালা চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন ক্রো ফিজেন্ট পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন। এছাড়া ছবিটি বাংলাদেশ থেকে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমি পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশী নিবেদন করা হয়েছিল। এটি বাংলাদেশ থেকে অস্কারের বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র শাখায় নিবেদন করা দ্বিতীয় বাংলাদেশী চলচ্চিত্র (প্রথমটি জাগো হুয়া সাভেরা) এবং প্রথম বাংলাদেশী বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র।

এরপর অন্তর্জাত্রা (২০০৬) ও রানওয়ে (২০১০) চলচ্চিত্রে তিনি প্রবাসজীবনের টানাপোড়েন, ধর্মীয় উগ্রবাদ, এবং সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে কাজ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি কাগজের ফুল নামে একটি নতুন চলচ্চিত্রের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, যা অসমাপ্ত থেকে যায়।


আপনার একটি শেয়ার এবং মন্তব্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️


সেই কালো দিন


২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের জোকা এলাকায় শুটিং লোকেশন দেখে ফেরার পথে কাগজের ফুল দলের মাইক্রোবাস একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।। দুর্ঘটনাস্থলেই তারেক মাসুদ ও তাঁর বন্ধু, খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হন। সাথে ছিলেন ক্যাথরিন ‍যিনি গুরুতর আহত হলেও বেঁচে যান।

এই সংবাদে গোটা দেশ শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। পরদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজারো মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হয়। তাঁর মৃত্যু শুধু চলচ্চিত্রাঙ্গনের ক্ষতি নয়, বরং দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় শূন্যতা।


দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মাইক্রোবাসের গাড়ির ধ্বংসাবশেষ পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়।

Ekushey Padak একুশে পদক বাংলাদেশ x bfa x fxyz

পুরস্কার ও সম্মাননা

মুক্তির গান (১৯৯৫): জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সেরা ডকুমেন্টারি)

মাটির ময়না (২০০২): কানের চলচ্চিত্র উৎসবের আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কার, মারাকেশ চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা চিত্রনাট্য পুরস্কার, এবং একাধিক জাতীয় পুরস্কার

রানওয়ে (২০১০): মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার (সেরা চলচ্চিত্র)

২০১২ সালে মৃত্যুর পর তাঁকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক প্রদান করা হয়। আরও বহু দেশি-বিদেশি সম্মাননা, যেমন থ্রি কন্টিনেন্টস ফেস্টিভ্যাল, কেরালা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ফিল্ম সাউথ এশিয়া প্রভৃতি।

২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর, তাঁর জন্মদিনে গুগল বাংলাদেশ হোমপেজে বিশেষ ডুডল দিয়ে তাঁকে স্মরণ করে।

গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও চলচ্চিত্রভাষা

তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রে দুটি ধারার প্রবল উপস্থিতি দেখা যায়—একদিকে মুক্তিযুদ্ধ, অন্যদিকে ধর্ম, সমাজ ও মানুষের টানাপোড়েন।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র

মুক্তির গান (১৯৯৫): ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একদল সংগীতশিল্পীর যাত্রাপথের গল্প, যা আর্কাইভ ফুটেজ ও দেশাত্মবোধক গানে সমৃদ্ধ।
মুক্তির কথা (১৯৯৯): মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী গ্রামীণ মানুষের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা।
নারীর কথা (২০০০): যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় নারীর ভূমিকা ও সংগ্রাম।
নরসুন্দর (২০০৯): মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মানবিক সহমর্মিতার ছোট কিন্তু গভীর গল্প।

পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র

মাটির ময়না (২০০২): তাঁর জীবনের সবচেয়ে আলোচিত কাজ। ১৯৬০-এর দশকের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে নির্মিত, যা কানে আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কার (FIPRESCI) জেতে এবং বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কারে মনোনীত হয়।
অন্তর্যাত্রা (২০০৬): প্রবাসী জীবনের টানাপোড়েন ও পরিচয়ের দ্বন্দ্ব।
রানওয়ে (২০১০): দারিদ্র্য ও ধর্মীয় উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়া এক তরুণের গল্প।

অসমাপ্ত কাজ

কাগজের ফুল: ১৯৪৭ সালের দেশভাগকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিত একটি চলচ্চিত্র, যা তাঁর জীবনের শেষ প্রজেক্ট হিসেবে রয়ে গেছে অপূর্ণ।


তথ্যসূত্র

  1. উইকিপিডিয়া: তারেক মাসুদ – জীবনী
    https://en.wikipedia.org/wiki/Tareque_Masud
  2. উইকিপিডিয়া: মাটির ময়না (Matir Moina)
    https://en.wikipedia.org/wiki/Matir_Moina
  3. উইকিপিডিয়া: রানওয়ে (Runway, 2010)
    https://en.wikipedia.org/wiki/Runway_%282010_film%29
  4. উইকিপিডিয়া: মুক্তির গান (Muktir Gaan)
    https://en.wikipedia.org/wiki/Muktir_Gaan
  5. উইকিপিডিয়া: মুক্তির কথা (Muktir Kotha)
    https://en.wikipedia.org/wiki/Muktir_Kotha
  6. উইকিপিডিয়া: কাগজের ফুল (Kagojer Phul) – অসমাপ্ত চলচ্চিত্র
    https://en.wikipedia.org/wiki/Kagojer_Phul
  7. দ্য গার্ডিয়ান: সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদের মৃত্যু (২০১১)
    https://www.theguardian.com/world/2011/aug/14/bangladesh-filmmaker-tareque-masud-dies

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Instagram did not return a 200.
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!