WOODWORKS IN BANGLADESH

WOODWORKS IN BANGLADESH

দারুশিল্প | সমৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী ইতিহাস

দারুশিল্প হলো নকশা খোদাই করা এক ধরনের কাঠ যা দিয়ে বিভিন্ন অলংকৃত আসবাবপত্র তৈরী করা হয়। শুধু আসবাবপত্রই নয়,

Woodworks
IN
BANGLADESH

.

কাঠ মানুষের জীবনের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে জন্মের পর দোলনা থেকে শুরু করে মৃত্যুর পরের খাটিয়া পর্যন্ত—প্রতিটি পর্যায়ে কাঠ আমাদের নীরব সঙ্গী। এই কাঠ মূলত একটি জড় পদার্থ, কিন্তু মানুষের সৃজনশীলতা আর নান্দনিক স্পর্শে এটি পায় প্রাণের স্পন্দন। সেই প্রাণ সঞ্চার করেন এক বিশেষ দক্ষ কারিগর সম্প্রদায়—সূত্রধররা। তাদের হাতে কাঠের গায়ে খোদাই হয় নকশা, ফুটে ওঠে নানান গল্প ও প্রতীক, আর জন্ম নেয় দারুশিল্প।

দারুশিল্প কেবল আসবাবপত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বিস্তৃত পরিসরে আছে বাদ্যযন্ত্র, পুতুল, তৈজসপত্র, গৃহসজ্জার সামগ্রী, ভাস্কর্য, নৌকার অলংকরণ, এমনকি একতারা, সারিন্দা ও বিচিত্র বীণার মতো সুরের বাহনও। বাংলার দারুশিল্পীরা প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি তাঁদের অসামান্য দক্ষতা ও নিপুণতায় যে কাজ উপহার দিয়েছেন, তা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি গর্বের। তাই দারুশিল্পের ইতিহাস শুধু সমৃদ্ধ নয়, তা দীর্ঘস্থায়ীও বটে।

মানব সভ্যতার একেবারে প্রারম্ভেই মানুষ কাঠকে জীবনের অংশ করে নিয়েছিল। নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের ধারায় প্রাগৈতিহাসিক যুগে শিকার ও আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল প্রথম কাঠদণ্ড। তবে আদি যুগেই মানুষ কাঠের শৈল্পিক ব্যবহার রপ্ত করেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে দেখা যায়—হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সিলমোহরে খোদাই করা নানাবিধ নকশা এবং জীবজন্তুর মূর্তি প্রমাণ করে যে, হাজার বছর আগে থেকেই দারুনির্মিত ও নকশাঅলঙ্কৃত কাঠের আসবাবপত্র তৈরি হতো।

দারুশিল্প | সমৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী ইতিহাস

সূত্রধর সম্প্রদায়

দারুশিল্পের প্রাণ ছিল সূত্রধর সম্প্রদায়। নামই তাদের সূচক — সুতো ধরে মাপজোখ করে কাজ করায় তাঁরা ‘সূত্রধর’ নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিভিন্ন দক্ষতার অধিকারী। কেউ ভাস্কর্য ও মূর্তি তৈরি করেন, আবার কেউ কাঠের স্থাপত্য নির্মাণে নিপুণ। স্তম্ভ, পিলার ও দেয়ালচিত্রে তাঁদের হাতের ছোঁয়া লক্ষ্যণীয়। তদুপরি, তাঁরা খাট-পালঙ্ক, সিন্দুক, পালকি, ঢেঁকি ও অন্যান্য কাঠের ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরিতেও দক্ষ।

এছাড়া সূত্রধররা বাদ্যযন্ত্র, পুতুল, তৈজসপত্র, গৃহসজ্জার সামগ্রী, নৌকার অলংকরণ, একতারা, সারিন্দা, বিচিত্র বীণা ইত্যাদি তৈরিতেও পারদর্শী। তাই বলা যায়, সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দারুশিল্পের জগতে সূত্রধর সম্প্রদায়ের অবদান অপরিসীম ও বহুমুখী।

দারুশিল্পের বিকাশ এবং বিলুপ্তি

পাল ও সেন যুগে ধাতব ভাস্কর্যের পাশাপাশি কাঠ ছিল শিল্পকর্ম তৈরির একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। সেই সময় রাজা, বাদশা এবং নৃপতিদের কাছ থেকে দারুশিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন, যা তাদের শিল্পে উৎকর্ষতা অর্জনে অনুপ্রেরণা যোগাতো। আঠারো ও ঊনিশ শতকে শুধু উচ্চবিত্ত ও জমিদার শ্রেণির মধ্যেই নয়, ভারত ও বাংলার সব শ্রেণির মানুষের মাঝে দারুশিল্পের আসবাবপত্র ও কাঠের শিল্পের প্রভাব বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে দারুশিল্পে অবনতির ছায়া পড়েছে—সৃষ্টিশীল চিন্তা ও দক্ষতা কমে গিয়েছে, হারিয়েছে শিল্পীর অভিজ্ঞতা এবং সৃজনশীল মনোভাব।

দেশ বিভাজ

দেশ বিভাজনের পর বাংলাদেশের অনেক সূত্রধর পরিবার ভারতের দিকে চলে যাওয়ায় এখানে দারুশিল্পের অগ্রগতি ধীরগতি হয়েছে। পরবর্তীতে কিছু সূত্রধর দারুশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও আর্থ-সামাজিক কারণে শিল্পটি তেমন বিকশিত হতে পারেনি। বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায় কিছু হিন্দু সূত্রধর কাঠের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন, আর মুসলিম সম্প্রদায়ের দারুশিল্পীরা মূলত বাস্তুনির্মাণ ও নকশাখচিত আসবাবপত্র তৈরিতে নিয়োজিত।
সূত্রধর পরিবারগুলো বংশপরম্পরায় এই কলাকৌশল ধরে রেখেছেন, তবে দেশের আবহাওয়া ও আধুনিক পরিবর্তনের কারণে দারুশিল্পের বিলুপ্তি অনিবার্য বলে মনে করা হয়।

সূত্রধর পরিবার

সোনারগাঁয়ে প্রায় অর্ধশত সূত্রধর পরিবার কারুকার্য সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন মাত্র কয়েকটি পরিবার বংশপরম্পরায় এই পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন। রঘুভাঙ্গার আশুতোষ সূত্রধর ও বীরেন্দ্র চন্দ্র সূত্রধর নামক দুই ব্যক্তি এখনও ঐতিহ্যবাহী কাঠের শিল্পে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বর্তমানে প্লাস্টিক ও আধুনিক উপকরণের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় কাঠের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রীর চাহিদা কমে গেছে, যা দারুশিল্পের বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আজ বিশ্বজুড়ে সবাই ইকো-ফ্রেন্ডলি, সাসটেইনেবিলিটি, প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের কথা বলছে।
আর আমরা? প্লাস্টিক, কংক্রিট আর ইটপাথরের বন্দী হয়ে যাচ্ছি।
শহরগুলো থেকে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে, আর সাথে সাথে হারাচ্ছে আমাদের কোমলতা, মানবিকতা। সবকিছু হয়ে উঠছে কঠিন—দেয়ালও, মনও।

এক সময় আমাদের দারুশিল্প ছিল আমাদের পরিচয়ের প্রতীক—
শত বছরের ঐতিহ্য, যার খোদাইতে ছিল আমাদের গল্প, বিশ্বাস, ইতিহাস।
আজ আমরা সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। কারণ? আমাদের কাছে এসব ‘সেকেলে’, ‘অপ্রয়োজনীয়’।

শ্রীলঙ্কায় গিয়ে চোখ কপালে উঠলো।
রাস্তার পাশের বাড়ি, হোটেল, এমনকি ছোট্ট কফিশপেও দারুশিল্পের এমন ব্যবহার—
যেন শহরের প্রতিটি কোণ শিল্পের একেকটা জীবন্ত ক্যানভাস। ওরা জানে—এটা শুধু সাজসজ্জা নয়, এটা তাদের অস্তিত্বের অংশ।

আর আমরা?
আমরা কি উন্নতির পথে হাঁটছি, নাকি ধ্বংসের দিকে ছুটে চলেছি?
নাকি আমরা নিজেরাই নিজের পরিচয়কে হত্যা করছি—
এক গভীর আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ডুবে থেকে?

দারুশিল্প | সমৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী ইতিহাস

wood carving motif

দারুশিল্পে নকশা

দারুশিল্পের নকশায় লোকায়ত আভিজাত্যের ছোঁয়া স্পষ্ট। এতে পশুপাখি, দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনের নানা দৃশ্য, বনফুল, কলমিলতা এবং লৌকিক দেবদেবীর ছবি প্রধান ভূমিকা রাখে। ধর্মীয় কাহিনী থেকেও নানা দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা হয়, যেমন রাধাকৃষ্ণ, কৃষ্ণের বস্ত্রহরণ, কৃষ্ণের গোচারণ, দধিমন্থন, গৌর নিতাই এবং দুর্গা।

তাছাড়া প্রতীকধর্মী নকশাও ব্যাপক প্রচলিত, যেমন—জোড়া পাখি, ময়ূর, বাঘ, সিংহ, হাতি, অশ্ব, তরঙ্গায়িত লতা, বৃক্ষ, মঙ্গলঘট, সর্প, পদ্ম ও ফুটন্ত পদ্ম।
বিদেশি প্রভাবেও দারুশিল্প নকশা সমৃদ্ধ হয়েছে। পুষ্পলতা, কলকা, বোরাক, ফুলদানি থেকে উঠে আসা ফুল, জালিকাজ, পায়া নকশা, থাবাযুক্ত পায়া, ভিক্টোরিয়ান পায়া, ক্যান্ডিলাব্রা নকশা, জ্যামিতিক নকশা এবং আঙুরলতা এসব বিদেশি প্রভাবের নিদর্শন।
আজকের দিনে বিদেশি নকশার প্রভাব থাকলেও বাংলার লোকায়ত শিল্পশৈলী থেমে থাকে নি।

গ্রামবাংলার দারুশিল্পীরা তাদের নিজস্ব শৈলীকে বিদেশি নকশার সঙ্গে মিশিয়ে বেড়া, সিন্দুক, খাট-পালঙ্ক, ঢেঁকি, পরী, ময়ূর, ঈগল, সিংহমুখ ইত্যাদি তৈরি করেছেন। কখনো তারা শুধুমাত্র লোকায়ত শৈলীতেই কাজ চালিয়ে গেছেন, যা এই শিল্পকে সমৃদ্ধ ও বহুমাত্রিক করেছে।

দারুশিল্প | সমৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী ইতিহাস

different type of woodwork

দারুশিল্পে যেসব জিনিসপত্র তৈরি হয়

দারুশিল্পের বিস্তৃত রেঞ্জে নানা ধরনের ব্যবহার্য ও অলংকারিক জিনিস তৈরি হয়। খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল ছাড়াও সাধারণ কৃষক ও শ্রমিক পরিবারের দৈনন্দিন কাজে লাগার জন্য তৈরি হয় ঢেঁকি, কাহাইল-ছিয়া, তরকারির চামচ, ভাতের হাতা, ডাল ঘুটনি, কাঠের সরা, কলসের ঢাকনা, পিঁড়ি, জলচকি, লাঙ্গল ইত্যাদি।
শিশুদের জন্য খেলনা, পুতুল, কাঠের হাতি ও ঘোড়ার মতো জিনিসও এই শিল্পে অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া কাঠের স্থাপত্য যেমন স্তম্ভ, পিলার এবং দেয়ালচিত্রও দারুশিল্পের অংশ। কেউ তৈরি করেন খাট-পালঙ্ক, সিন্দুক, পালকি ও ঢেঁকি।

আরও একদল দারুশিল্পী বাদ্যযন্ত্র যেমন একতারা, সারিন্দা, বিচিত্র বীণা এবং গৃহসজ্জার সামগ্রী, তৈজসপত্র ও নৌকার অলংকরণও তৈরি করে থাকেন।
দারুশিল্প শুধু ব্যবহার্য সামগ্রী নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্ম হিসেবেও সমাদৃত।

এককাঠের পুতুল | বাংলাদেশের অপার ঐতিহ্য

দারুশিল্প | সমৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী ইতিহাস
দারুশিল্প | সমৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী ইতিহাস
content writer




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Instagram did not return a 200.
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!