
মোঘল আমলের প্রসিদ্ধ মসলিন কাপড়ের উত্তরসূরী হিসেবে এই বাংলা জনপদের মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে “জামদানি শাড়ি”। বিশ্বব্যাপি সমাদৃত এই পোশাক সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এখানে জামদানি তৈরির বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে ধারনা দেয়া হল।
.
‘জামদানি’ শাড়িকে স্রেফ কাপড় বা পরীধেয় পণ্য ভাবলে ভুল হবে। ‘জামদানি’ হচ্ছে শিল্পচর্চার একটি মাধ্যম যা ভূগোল ও পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ত। শিল্পের এই মাধ্যমে একজন তাঁতি সুতা, রং , মাকু এবং তাঁতের সংমিশ্রণে সুনিপূণ শিল্পের জন্ম দেয়। এই শিল্প উৎপাদনের সাথে শুধু তাঁতিই নয়, জামদানি তৈরির প্রতিটি স্তরে যুক্ত আছে বিভিন্ন ঘরাণার মানুষ। নিচে তার নমুনা দেওয়া হল।
.
জামদানি তৈরির বিভিন্ন স্তর ::
মহাজন
জামদানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে মহাজনেরা অর্থলগ্নি করে থাকেন। তারা জামদানি উৎপাদনে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও জামদানি তৈরীর তাঁতি এবং সাগরেদ নিয়োগ দেয়। পাশাপাশি যে সব ঘরগুলোতে জামদানি বোনা হয় তার মালিক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
ওস্তাদ
জামদানি বুননে একই সাথে দুজন তাঁতি কাজ করেন। মূল তাঁতীকে বলা হয় ওস্তাদ বা মাস্টার। তাঁরা এক বা দুটি বুনন ইউনিটের মালিকও হয়ে থাকেন। ওস্তাদরা তাদের পণ্য সরাসরি হাট বা মহাজনদের কাছে বিক্রি করে। বেশিরভাগ ওস্তাদ তাঁতি মহাজনদের অধীনে কর্মচারী হিসেবেও কর্মরত থাকেন।
সাগরেদ
মূল তাঁতির সাথে সহকারী হিসেবে যিনি কাজ করেন তাঁকে সাগরেদ বলা হয়। ডানে বসেন ওস্তাদ এবং বাম দিকে বসেন সাগরেদ। মূলত ওস্তাদের নির্দেশ পালন করাই সাগরেদের কাজ। ছোট বেলা থেকেই বুনন কাজের সাথে যাত্রা শুরু হয় তাঁদের। বলা হয়, ছোটবেলায় মানুষের হাত খুব নরম থাকে বলে তারা ভালো নকশা করতে পারে। একজন সাগরেদ কাজ করতে করতে হাতের পরিপক্কাতা আসলে ওস্তাদে পরিনত হন।
সুতা পরানি
জামদানি তৈরির প্রক্রিয়ায় সাধারণত নারীরাই সুতা পরানি হিসাবে কাজ করেন। তাঁরা সুতার সাথে ভাতের মাড় মিশিয়ে চড়কির মাধ্যমে নাটাই তৈরী করেন। পরে এগুলি শুকিয়ে ‘চাটা’ তৈরি করা হয়।
হাওজাইন্না
জামদানি বুননের ক্ষেত্রে দক্ষ ভূমিকা পালন করে ‘হাওজাইন্না’। সুতা টানা দেওয়াই যাদের মূল কাজ। এঁরা সমান তালে হেটে হেটে জোড়া খুটিতে সুতা টানা দিয়ে থাকেন। টানা সুতা ৪০ থেকে ৫০টি ববিনে পেঁচানো থাকে। এর দ্বারা তাঁরা শানা, টানা ইত্যাদি তৈরী করে থাকেন। প্রতি টানায় পাঁচ বা ততোধিক শাড়ি বানানো যায়।
শানা
চিরুনি সদৃশ চটাকে বলা হয় শানা। সাধারনত নারীরাই টানার সুতা বাঁশের তৈরি খাঁচ কাটা চিরুনির ফাঁকার ভিতর দিয়ে সুঁইয়ের মাধ্যমে সুতা গাঁথেন।
ভিম টাননি
টানার সুতা মূল ফ্রেমে বসানোর জন্য একটি বাঁশের সাথে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেচানো হয়। যাকে বলা হয় ‘ভিম’। এই কাজটি ২ থেকে ৩ জনে মিলে করে থাকেন। এই কাজে নারী-পুরুষ সবাই সমানভাবে অংশ নেন।
বও বিন্দাইন্না / গাথঁনি
ভিম তৈরি পর বাও এর ভিতর দিয়ে সুতা দেওয়াকে ‘গাঁথুনি’ বলে। মূলত নারীরা এই কাজটি করে থাকেন।
পয়া ফেলা
জামদানি তৈরির তাঁত পুরোপুরি প্রস্তুত করাকেই বলা হয় পয়া ফেলা।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
জামদানি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতেঃ
আরও পড়ুন
হোগলাপাতা: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প
নারিকেলের মালা: বর্জ্য থেকে বর্তমানের গল্প
নকশী পিঠা এক প্রকার লোকশিল্প
নকশি পাখা: বাতাসে লুকানো ঐতিহ্যের গল্প
মণিপুরী নৃ-গোষ্ঠীর জীবন ও তাঁতশিল্পের গল্প
রান্নার বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের গল্প
