ঐতিহ্যবাহী পিঠা নিয়ে একটা কাহিনী কথিত আছে। হাতের কাঁকন দিয়ে কেনা দাসী কাঁকনমালার কূটবুদ্ধিতে পরাজিত হলে রাণী কাঞ্চনমালার জীবনে নামে ঘোর অন্ধকার, কষ্ট। কিন্তু পাটরানির আভিজাত্য তো আর চলে যায়নি! হারানো সম্মান ফিরে পেতে অনেক চেষ্টাই করেছিলো এই কাঞ্চনমালা। শেষে এক সুতাওয়ালার সাহায্যে চন্দ্রপুলী, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী পিঠা বানিয়ে কাঞ্চনমালা প্রমাণ করেন যে তিনিই প্রকৃত রাণী!
বাংলাদেশের আনাচে- কানাচে রয়েছে নানারকম ঐতিহ্যবাহী পিঠা । সব অঞ্চলের পিঠাতেই জড়িয়ে আছে নিজস্ব লোকঐতিহ্য। ধারণা করা হয়, দেশে শতাধিক রকমের পিঠা তৈরি হয়। এর প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ পিঠা তৈরি হয় শীতকালে। বিয়ের পরে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় বিশাল ডালাভর্তি বা হাঁড়িভর্তি পিঠা পাঠানো হতো। সাথে নাইওরি, আত্মীয় স্বজনরাও আসতেন হাড়ি ভর্তি পিঠা নিয়ে।
পিঠা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পিষ্টক’ শব্দ থেকে ৷ আবার পিষ্টক এসেছে ‘পিষ্’ ক্রিয়ামূলে তৈরি হওয়া শব্দ ‘পিষ্ট’ থেকে ৷ পিষ্ট অর্থ চূর্ণিত, মর্দিত, দলিত। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ বইয়ে লিখেছেন, পিঠা হলো চাল গুঁড়া, ডাল বাটা, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্নবিশেষ৷
বরিশালের বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে নানা প্রকার পিঠার বর্ণনা আছে
‘মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস।
দুই তিন প্রকারের পিষ্টক পায়েস ॥
দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ।
রন্ধন করিয়া হৈল হরসিত মন ॥‘
ঐতিহ্যবাহী পিঠা নিয়ে খনার একটা বচন আছে- কাল ধানের ধলা পিঠা, মা’র চেয়ে মাসি মিঠা।
বাংলাদেশি সেরা দশ রকমের ঐতিহ্যবাহী পিঠা
১. বিন্নি চালের আতিক্কা পিঠা বা কলা পিঠা | ATIKKHA PITHA
আতিক্কা শব্দের অর্থ হঠাৎ। অর্থাৎ যদি হঠাৎ করে বাড়িতে মেহমান চলে আসে তাহলে খুব সহজে নাস্তা হিসেবে এই পিঠা তৈরি করে খাওয়ানো হয়। এছাড়া এই পিঠাকে বিন্নি চালের বা কলা পিঠাও বলা হয়ে থাকে। আতিক্কা পিঠা তৈরিতে প্রয়োজন বিন্নি চাল, নারিকেল কুচি, নারিকেল পাতা, গুড়, চিনি এবং লবন।
পিঠা তৈরিতে প্রথমেই বিন্নি চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরবর্তীতে নারিকেল কুচি করে নিতে হবে এবং গুড় কিছুটা ভেঙ্গে গুরা করে নিতে হবে। তারপর প্রয়োজন হবে পাকা কলা।
চট্টগ্রামের মানুষ পিঠা তৈরিতে মূলত বাংলা কলার ব্যবহার করে থাকে বেশি। কারন বাংলা কলার অন্যরকম একটা স্বাদ আছে। পাকা কলা, নারিকেল কুচি এবং গুড় একসাথে মিশিয়ে নিতে হবে। পরবর্তীতে ভিজিয়ে রাখা বিন্নি চাল ভালো করে পানি ছেকে মেশানো উপকরণের মধ্যে ভালো করে মাখিয়ে নিতে হবে। এরপর সামান্য পরিমাণ লবন দিয়ে আবার একটু মিশিয়ে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে পিঠা তৈরির উপকরণ। এরপর মেশানো উপকরণ কলা পাতায় মুড়িয়ে ভাপে দিলেই তৈরি হয়ে যাবে মজাদার বিন্নি চালের আতিক্কা পিঠা। কলা পাতা না থাকলেও অন্য যেকোন উপায়ে ভাপে এই পিঠা তৈরি করা যাবে। কলা পাতা ব্যবহার করা হয় কারন এতে স্বাদ এবং ফ্লেভার দুটিই বৃদ্ধি পায়।
২. সিরিঞ্জ পিঠা | SIRINJ PITHA
সিরিঞ্জ পিঠা নাম দেওয়ার কারন হচ্ছে এ পিঠা সিরিঞ্জ এর সাহায্যে তৈরি করা হয় তার জন্য এ পিঠার নাম সিরিঞ্জ পিঠা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পিঠা তৈরি করা হয়। গ্রামের অনেক মেয়েই ইংরেজি সিরিঞ্জ কথাটা শুদ্ধভাবে বলতে পারে না। তাই কেউ বলে ‘সিরিনচ’ বা ‘সিরিঞ্চ’ আবার কেউ কেউ বলে ‘চিনিশ’ পিঠা।
এ পিঠা তৈরি করতে প্রথমে সিদ্ধ চাল দুই দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। সিদ্ধ চালের গুড়া পানি ঝড়িয়ে পাটায় বেটে গুড়া করে সামান্য লবণ ও পানি দিয়ে ঘন করে গোলা হয়। তারপর সে গোলা প্লাস্টিকের সিরিঞ্জে ভরে কলাপাতা বা যে কোন পাতার কিংবা শক্ত কাগজের ওপর সিরিঞ্জ চাপ দিয়ে হাত ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে নকশা তৈরী করে পিঠা আদল তৈরী করা হয় । এ পিঠার সৌন্দর্য বা নকশা পুরোপুরি নির্ভর করে প্রস্তুতকারিণীর শিল্পবোধের ওপর।
পাতায় বা কাগজে ফেলা নকশা করা পিঠা গুলো পাতাসুদ্ধ ভাপে সিদ্ধ করা হয়। তারপর তা নামিয়ে দুই/তিন দিন রোদে শুকানো হয়। ভালোভাবে শুকিয়ে গেলে তা সংরক্ষন করা যায় । পরে যে কোন সময় শুকনো পিঠা ডুবো তেলে ভাজলে ফেঁপে ওঠে ও মচমচে হয়।
সাধারণত চালের গোলায় কোনো রঙ মেশানো হয় না। তবে কেউ কেউ পিঠার সৌন্দর্য বারাতে বিভিন্ন ফুড কালার চালের গোলার সাথে মিশিয়ে পিঠার নকশা বানাতে পারেন । ইদানীং চালের গুঁড়ার বদলে কেউ কেউ সাগু দিয়েও সিরিঞ্জ পিঠা বানায়।
৩. নকশী পিঠা | NAKSHI PITHA
যতদূর জানা যায়, নকশী পিঠার উৎসস্থল নরসিংদী জেলা। জানা যায় যে নরসিংদীর মেঘনা পাড়ের এক গ্রামে চালের গুঁড়া দিয়ে আলপনা আঁকা হত । তা দেখেই এক বালিকা চালের গুঁড়া সেদ্ধ করে সেই সেদ্ধ মন্ড হাত দিয়ে খেলতে খেলতে রুটির মত করে খেজুর গাছের কাঁটা দিয়ে সুন্দর নকশা তৈরী করে। সেই নকশা দেখে তার মা, ঠাকুমাসহ বাড়ীর সকল সদস্যরা অবাক হয়ে যান! গ্রামের সবাই নাকি দেখতে আসেন সেই নকশা করা চালের গুঁড়া। তারপর অনেক গবেষণা করে নকশা রুটিটা ডুবো তেলে ভেজে তুলে আবার স্বাধ বারাতে গুড়ের সিরাতে ডুবিয়ে তুলে নেওয়া ফেলেন । ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই নকশা করা এই পিঠা ‘নকশী পিঠা’ নামে পরিচিত।
নকশী পিঠাকে অনেকে আন্দেশ পিঠা, কাটা পিঠা বলে থাকে । বিশেষ ধরনের কাটা দিয়ে হাতেই নকশা করা হয় বলেই হয়তো কাটা পিঠা বলে ।
এই পিঠায় সাধারণত চালের গুড়া ব্যবহার করা হলেও ময়দাও ব্যবহার করা যায় । গুঁড়া সেদ্ধ করে কাই বা মন্ড তৈরি করা হয়। কাই বেলে একটু পুরু রুটি বানিয়ে, বিভিন্ন শেপ এ প্রথমে কেটে নিতে হবে । তারপর নিজস্ব শিল্পবোধের ভিতর দিয়ে নকশা তুলতে হবে ।
আর এই পিঠাটা দুইবার ভাজতে হয়। এই পিঠা টা ভাজার মধ্যে একটা বিশেষত্ব আছে। প্রথমবার একবার ভেজে এই পিঠা অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। পরের বার ভাজতে হয় খাওয়ার সময়। এ সময় ভেজে গুড়ের বা চিনির সিরায় ডুবিয়ে তুলতে হয়।
নকশার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পিঠার বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়, যেমন শঙ্খলতা, কাজললতা, চিরল বা চিরনপাতা, হিজলপাতা, সজনেপাতা, উড়িয়াফুল, বেঁট বা ভ্যাট ফুল, পদ্মদীঘি, সাগরদীঘি, সরপুস, চম্পাবরণ, কন্যামুখ, জামাইমুখ, জামাইমুচড়া, সতীনমুচড়া ইত্যাদি।
৪. পাকন পিঠা | PAKON PITHA
নকশি পাকন, সুন্দরী পাকন, মুগ পাকন, ডালের পাকন, সুজির পাকন । পাকন পিঠার মধ্যেও বেশ রকম-ফের থাকলেও নকশী পিঠা এবং পাকন পিঠার প্রস্তুত প্রনালী এবং স্বাদ আলাদা । ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় এ পিঠার প্রচলন এখনও রয়েছে। পাকন পিঠার উপকরণগুলো হল: ময়দা, ডিম, ডাল, দুধ, গুড় ইত্যাদি।
প্রথমে ময়দা হালকা গরম পানিতে স্বিদ্ধ করে নিতে হবে । এর পর সিদ্ধ ময়দা কাচা ডিমের সাথে ধাপে ধাপে মিশিয়ে ডো তৈরি করতে হবে । তারপর সুবিধা মত নকশা একে ডুবো তেলে সবগুলো পিঠা আস্তে আস্তে অনেক সময় নিয়ে সোনালি করে ভেজে নিতে হবে। ভাজার সময় চুলার আঁচ কমিয়ে নিলে রং টা সুন্দর আসে । পিঠা ভেজে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই হালকা গরম সিরায় ছেড়ে দিতে হয়। সিরায় ৪/৫ মিনিট রেখে উঠিয়ে সংরক্ষণ করে খাওয়া যায় আবার ৩/৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে , নরম করে খাওয়া যাবে। তবে এ ভিজানো পিঠা বেশিক্ষন রাখা যায় না ।
৫. তাল চাপড়ি | TAL CHAPRI PITHA
ভাদ্র মাসের পাকা তালের ঘ্রাণে যখন গ্রামের চারিদিকে মৌ মৌ গন্ধ ভেসে বেড়ায় তখন বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয়ে থাকে পাকা তাল দিয়ে নানা ধরনের পিঠা। তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা তাল চাপড়ি। অতিথি আপ্যায়ন হোক বা ঘরের সবার জন্য হোক পিঠা-পুলি তৈরি যেন বাংলার গ্রামীণ জীবনে উৎসবের আমেজ এনে দেয়।
তাল চাপড়ি তৈরিতে প্রয়োজন পাকা তাল, আখের গুঁড়, চালের গুঁড়া, লবন এবং কলা পাতা। প্রথমে পাকা তাল থেকে রস বের করে নিতে হবে। মূলত এই কাজটাই সবচেয়ে কষ্টের। তালের পিঠা খেতে যেমন মজা তেমনি পাকা তাল থেকে রস বের করা ততটাই কষ্টসাধ্য। তাল নেয়া হয়ে গেলে এতে পরিমাণ মতন লবন এবং আখের গুঁড় ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর চালের গুঁড়া দিয়ে ভালো করে খামি তৈরি করে নিতে হবে। খামি তৈরি করার পর হাতের সাহায্য কলা পাতার এক পাশে কিছুটা পরিমাণ খামি নিয়ে রুটি তৈরি করার মতন আকৃতি দিয়ে আরেকপাশ থেকে ঢেকে দিতে হবে। তারপর রুটি যেভাবে ভাজে ঠিক সেভাবেই কড়াইতে কলা পাতায় মোড়ানো চাপড়িগুলো একে একে দিয়ে ভেজে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি পুড়ে না যায়। দুইপাশ কিছুটা হয়ে আসলে কলা পাতা সড়িয়ে ভালো করে ভেজে নেয়া যেতে পারে। তবে কলা পাতার একটা ফ্রেশ ফ্লেবার আছে যা তাল চাপড়ি স্বাধ বাড়িয়ে দেয় দ্বীগুন ।





৬. খেজুর গুড়ের জাম পিঠা | JAAM PITHA
শীত জুড়েই থাকে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে খেজুর গুড়ের পিঠা বানানোর উৎসব। তেমনি একটি পিঠার নাম হচ্ছে জাম পিঠা। যার প্রধান উপকরন খেজুরের গুড়। শীতের সকালের রস দিয়ে বানানো গুড় দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে এ পিঠা।
জাম পিঠা তৈরিতে প্রয়োজন চালের গুঁড়া, দুধ, কোরানো নারিকেল, খেজুরের গুড়, কালিজিরা, তেজপাতা, এলাচ, দারুচিনি, লবন ও তেল।
জাম পিঠা তৈরিতে প্রথমেই পাতিলে দুধ ঢেলে তাতে কিছুটা পরিমাণ কালিজিরা দিয়ে দিতে হবে। এরপর তেজপাতা, এলাচ দিয়ে ভালো করে দুধ জাল দিতে হবে। দুধ ভালো করে জাল দেয়া হয়ে গেলে তাতে কোরানো নারকেল দিয়ে ভালো করে নেড়ে নিতে হবে। এরপর খেজুরের গুড় এবং পরিমান মতন লবণ দিয়ে পূণরায় ভালো করে নেড়ে নিতে হবে। কিছুক্ষণ পর তাতে আস্তে আস্তে চালের গুঁড়া দিয়ে কাই করে নিতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে যেন লেগে না যায়। পরবর্তীতে নামিয়ে কিছুটা ঠান্ডা হয়ে আসলে ভালো করে ডলে মন্ড তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে মন্ড যত ভালো হবে পিঠা ততই সুন্দর হবে।
মন্ড বানানো হয়ে গেলে কিছুটা পরিমাণ মন্ড হাতে নিয়ে অনেকটা জামের মতন শেপ তৈরি করে নিতে হবে পিঠা। এরপর পিঠাগুলো ডুবু তেলে ভেজে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে মজাদার জাম পিঠা। জামের মতন দেখতে বলেই একে বলা হয় জাম পিঠা। গ্রাম-বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী পিঠা বিভিন্ন জেলায় তৈরি করা হয়ে থাকে।
৭. ভাপা পিঠা | BHAPA PITHA
গ্রামীন হাট কিংবা শহরের গলির মুখে ভাপা পিঠা বানানো হচ্ছে মানে শীত দরজায় কড়া নাড়ছে । বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠার মধ্যে অন্যতম হল ভাপা পিঠা । এই পিঠা অনেক অঞ্চলে ধুপি নামেও পরিচিত । ঐতিহ্যগত দিক থেকে মিষ্টি ভাপা হলেও বর্তমানে ঝাল ভাপাও বেশ কদর ।
প্রধানত চালের গুঁড়া দিয়ে জলীয় বাষ্পের আঁচে তৈরী করা হয় ভাপা পিঠা। মিষ্টি করার জন্য দেয়া হয় গুড়। স্বাদ বৃদ্ধির জন্য নারকেলের শাঁস দেয়া হয়।
প্রথমে চালের গুঁড়া (হালকা দানা দানা থাকবে ) একটু লবণ ও হালকা গরম পানি দিয়ে মেখে চালুনি দিয়ে চেলে রেখে দিতে হবে ঘন্টা কানেক । এর পর একটা হাড়িতে পানি ফটাতে দিয়ে তার উপর পাতলা সাদা কাপড় দিয়ে হাড়িটি মুখ মুড়িয়ে দিতে হবে । যেখান থেকে বাষ্প বের হবে ।
এর পর ছোট বাটিতে প্রথমে চালের গুঁড়া তারপর গুড় সাথে নারিকেল দিয়ে আবার চালের গুঁড়া দিয়ে দুই লেয়ারে ঢেকে দিয়ে হাড়ির উপর থাকা সাদা কাপড়ে আস্তে করে ছোট বাটিটি বসিয়ে দিতে হবে। উপরে একটা ঢকনা দিয়ে ২/৩ মিনিট পর পিঠা নামিয়ে নিলেই হয়ে যাবে ভাপা পিঠা ।
৮. পাটিসাপটা পিঠা | PATISHAPTA PITHA
সাধারণত পাটিসাপটা পিঠা দুই-ই রকমে তৈরি করা যায়। এক হলো ভিতরে ক্ষীর দিয়ে এবং দ্বীতিয়টি হবো ক্ষীর ছাড়া ।
পাটিসাপটা পিঠা বানাতে দরকার হয় নারিকেল কুরানো , চিনি, দুধ, ময়দা, চালের গুড়ি ও সুষি ইত্যাদি । পিঠা তৈরি করার জন্য ক্ষীর আগে রেডি করে নিতে হবে।
ময়দা, চালের গুড়ি ও সুষি একসাথে মাখিয়ে পিঠার ডো তৈরি করে নিতে হবে । তারপর সমতল কড়াই বা প্যান এ হালকা তেল দিয়ে চামুচ দিয়ে পরিমান মত ডো কড়াইয়ে ঢেলে চামুচ দিয়ে পাতলা করে পুরো কড়াই লেপ্টে দিতে হবে । এবার হালকা হয়ে আসলে আগে তৈরী করা ক্ষীর পিঠার উপর দিয়ে দুই পাশ দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে এপাশ ওপাশ করে হালকা ভেজে নামিয়ে ফেলতে হবে ।
সুস্বাদু এই পিঠা আবার নানান প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন ডিমের পাটিসাপটা, ক্ষীরের পাটিসাপটা, ছানার পাটিসাপটা প্রভৃতি। প্রতিটি পাটিসাপটারই আলাদা আলাদা স্বাদ। পাটিসাপটা পিঠা বাংলাদেশের সব জেলাই পাওয়া যায় । বিশেষ করে বড় বড় মিষ্টান্ন দোকান গুলোতেও কিনতে পাওয়া যায় পাটিসাপটা পিঠা ।
৯. মেরা পিঠা | MERA PITHA
বাংলাদেশে বিশেষ করে সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলাগুলোতে বেশ জনপ্রিয় মেরা বা দৌল্লা। কোন কোন অঞ্চলে এটিকে গোটা পিঠা বা ভাপা ছান্নাই নামেও ডাকা হয়
মেরা পিঠা হলো একধরনের শীতকালীন পিঠা । এটি ময়দা বা চালের গুঁড়ো, লবণ, চিনি, নারকেল ইত্যাদি দিয়ে তৈরী করা হয়ে থাকে। এ পিঠা সবধরনের তরকারি দিয়ে খাওয়া যায় কিন্তু চেপা শুটকি ও ভর্তা দিয়ে খেতে খুবই সুসাধ্য এবং লোভনীয় একটি খাবার।
চালের গুড়া, লবণ ও পানি দিয়ে তৈরি করা হয় মেরা পিঠা । প্রথমে হাড়িতে পানি, লবন এবং স্বাদ বারাতে নারিকেল কুচি পানি ফুটে আসলে চালের গুড়া সিদ্ধ করে কাই বানাতে হবে। কাই হালকা শক্ত হয়ে আসলে , অল্প পরিমান কাই হাতের তালুতে নিয়ে মিষ্টির মত শেপ দিতে হবে । পছন্দ মত যে কোন শেপ দেয়া যেতে পারে ।
এবার অন্য একটা হাড়িতে পানি ফুটিয়ৈ তার উপর চালনি দিয়ে পিঠাগুলো ভাঁপে দিতে হবে। ১৫/২০ মি: এর মত রেখে নামিয়ে ফেলতে হবে । এ পিঠা তৈরি করে ৩/৪ দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
মেরা বা ম্যারা পিঠা সাধারণত শুঁটকি ভর্তা, গুড় বা মাংস দিয়ে খাওয়া হয় । অনেক সময় কড়াইয়ে তেলে বা তেলছাড়া ভেজে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া হয়।
১০. কাচি পোড়া পিঠা | KACHI PORA
চালের গুড়া মিশ্রণ মাটির সাচে ঢেলে দেয়ার পর ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। একটু পর সরা উঠিয়ে কাচি দিয়ে খুঁচিয়ে পিঠা নামিয়ে নেয়া হয়। কাচি দিয়ে খুঁচিয়ে খোল থেকে পিঠা তোলা হয় বলে যশোরের মানুষ একে কাচি পোড়া পিঠা বলে।
আরেকটু সহজ করে বললে, আমরা যাকে চিতই পিঠা বলি সেটাই যশোরে কাচিপোড়া পিঠা। আর এর জন্য যশোরে আলাদা সাচ বানানো হয় মাটির যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, সেটা ব্যবহার করেই বানানো হয় কাচিপোড়া পিঠা। একটি সাচে ৪/৫ টি পিঠা ধরে।
চালের গুড়া পানিতে ভালো ভাবে গুলিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দেয়। তারপর সেই মিশ্রন গোল চামুচ কিংবা নারিকেল এর মালাই দিয়ে তৈরী চামুচ দিয়ে সাচে পিঠার মিশ্রণ আন্দাজ মতো ঢেলে দেয়। মাঝারি আচে জ্বাল দিয়ে মাটির সাচ এ মাটির ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়। হালকা হয়ে আসলে কাচি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটির সাচ থেকে আলাদা করে উঠিয়ে আনে ।
কাচিপোড়া পিঠা শুকনো অবস্থায় বিভিন্ন ভর্তা দিয়ে বা রস/ দুধে ভিজিয়ে খাওয়া যায়। তবে, যশোর আর খেজুরের রস এর কথা না বললেই নয়। যশোর বাসী এই পিঠা খায় রসে ভিজিয়ে।
চুলার পাশেই রাখা হয় হাড়ি। পিঠা হয়ে এলে, একটু পর সরা উঠিয়ে কাচি দিয়ে খুঁচিয়ে পিঠা নামিয়ে পাশে রাখা হাঁড়িতে গরম রসের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়া হয়। অনেক সময় এই রসের মধ্যে নারকেল কুচি করে দেয়া হয়। এভাবে তৈরি হয় রসের কাচিপোড়া পিঠা।





বাংলাদেশে কত শত রকমের ঐতিহ্যবাহী পিঠা যে তৈরি হয় তার সুনির্দিষ্ট তালিকায়ন করা আজও সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয়, এ দেশে শতাধিক রকমের পিঠা তৈরি হয়। এর প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ পিঠা তৈরি হয় শীতকালে।
অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী পিঠা
নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর, মাগুরা, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর তথাপি সারা বাংলাদেশেই পিঠা তৈরি হয়। সব অঞ্চলের পিঠাতেই নিজস্ব লোকঐতিহ্য আছে।
ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের অঞ্চল যেমন- নবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ এলাকায় ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য পিঠার মধ্যে মুখশলা পিঠা, চাপড়ি পিঠা, গুলগুলা পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের ঝাল পুয়া, কলা পিঠা, তিল পুলি, সাবুর পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, মুঠি পিঠা, ছিটরুটি, জামাই পিঠা অন্যতম।
নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলের নিজস্ব পিঠা হলো খোলাজা পিঠা, ডিমের বিস্কুট পিঠা, নারিকেল পুলি পিঠা, গোলাপ পিঠা, সুজির পিঠা, ডিমের পানতোয়া, ঝাল পানতোয়া, ঝুনঝুনি পিঠা ও নারিকেলের চিড়া।
চট্টগ্রামে আতিক্কা পিঠা, যা স্থানীয় ভাষায় পরিচিত হাফাইন্না পিঠা বা গোইজ্জা পিঠা নামে।
শরীয়তপুর বিখ্যাত বিবিখান পিঠার জন্য। জামালপুরের রোট পিঠা বা ওট পিঠা ।
সিলেটের গ্রামাঞ্চলের একটি পিঠা হলো চুঙ্গাপুড়া পিঠা। বাঁশের মধ্যে কলাপাতা দিয়ে তার মধ্যে ভেজানো বিন্নি চাল ভরে খের দিয়ে মুখ আটকে চুলায় পোড়াতে হয়। এছাড়া সিলেটের আরেকটি জনপ্রিয় পিঠা নোনতা বা নুনগড়া পিঠা।
খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় পিঠা হাত সেমাই পিঠা।
উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্যবাহী পিঠার নাম
চিতোই পিঠা, পাকানো পিঠা, পাকোয়ান পিঠা, পক্কন পিঠা, পাটিসাপটা, কুশলি পিঠা, ভাপা পিঠা, ভাত পিঠা, কাটা পিঠা, নকশি পিঠা, পুলি পিঠা, দুধ পিঠা, লাউ পায়েস, ছিট পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, গোকুল পিঠা, গড়গড়া পিঠা, ম্যারা পিঠা, মুঠা পিঠা, সিদ্ধ পিঠা, পুতুল পিঠা, লরি পিঠা, চাছি পিঠা, সাগুদানা, ঝুড়িসীতা, তারাজোড়া, জামাই পিঠা, জামদানি পিঠা, হাদি পিঠা, পাটা পিঠা, তেজপাতা পিঠা, তেলেভাজা পিঠা, ঝুরি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, চষি পিঠা, খান্দেশা, গোলাপফুল পিঠা, পাতা পিঠা, সবুজ পিঠা, কেক পিঠা, গুলগুলা, ফুলকুচি, সেওই পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, ক্ষীরডুবি, খাস্তা পিঠা, পেঁপের সন্দেশ, কড়ি পিঠা, সিরিনচ পিঠা, ঝিকমিক পিঠা, পয়সা পিঠা, সংসার পিঠা, শিঙাড়া পিঠা, বিবিখানা পিঠা, চান্দ পাকোড়, ঝালপোয়া পিঠা, মালপোয়া পিঠা, মালভোগ, ক্ষীরকুলি, মালাই পিঠা, নারকেল ভাজা পুলি, নারকেল সিদ্ধ পুলি, নারকেল ঝুরি পিঠা, পাকোন পিঠা, সাজ পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, ঝাল পিঠা, বিস্কুট পিঠা, খাস্তা পিঠা, গজা, রুটি পিঠা, দুধ পায়েস, কুলি পিঠা, দুধকুলি পিঠা, জামাই কুলি পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চুটকি পিঠা, রসপুলি, কাটা পিঠা, মুরালি পিঠা, খান্দাশ, পয়সা পিঠা, চুষি পিঠা ইত্যাদি অন্যতম।
- বাংলাদেশি সেরা দশ রকমের ঐতিহ্যবাহী পিঠা
- ১. বিন্নি চালের আতিক্কা পিঠা বা কলা পিঠা | ATIKKHA PITHA
- ২. সিরিঞ্জ পিঠা | SIRINJ PITHA
- ৩. নকশী পিঠা | NAKSHI PITHA
- ৪. পাকন পিঠা | PAKON PITHA
- ৫. তাল চাপড়ি | TAL CHAPRI PITHA
- ৬. খেজুর গুড়ের জাম পিঠা | JAAM PITHA
- ৭. ভাপা পিঠা | BHAPA PITHA
- ৮. পাটিসাপটা পিঠা | PATISHAPTA PITHA
- ৯. মেরা পিঠা | MERA PITHA
- ১০. কাচি পোড়া পিঠা | KACHI PORA
- অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী পিঠা
- উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্যবাহী পিঠার নাম
- আরও পড়ুন
সোর্স-