স্বদেশভ্রমণ -কে আমি আমার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘সুন্নতে’র অংশ বলে জানি ও মানি। কবি জীবনানন্দ দাশও একদা বলেছিলেন, বাংলার যে মুখ তিনি দেখেছেন, সেখানে পৃথিবীর রূপ না দেখলেও চলবে। কী নেই আমাদের এই ছোট্ট ভূখন্ডে? সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সভ্যতা সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বঙ্গ জনপদ। সভ্যতার বিবর্তন ও কালের গর্ভে হারিয়ে বা ধ্বংস হয়ে যায় পুরো শহর, প্যালেস, মসজিদ কিংবা শিক্ষাকেন্দ্র। তবে যুগ- শতাব্দীর পরিক্রমায় ‘ Cross Discipline ‘ এর জোরে কিন্তু ঠিকই মানুষ মাটির বুক চিরে তাদের গোড়াপত্তন নিয়ে বিশ্লেষণ করে আসছে দিনকে দিন। আর আমাদের মতো সাধারণ সত্তারাও এ যুগে এসে স্বচক্ষে দেখতে পারছি ও অমিয় সুধা টেনে নিচ্ছি। এবারে বাংলার ‘ভূষণ’ : সোমপুর মহাবিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার
উত্তরের বরেন্দ্র জনপদ নওগাঁ জেলা শুধু নিজেদের সীমানার হিসেবে বলছি না, বিশ্বজুড়ে সোনালী ঐতিহ্যের এক অপার বিস্ময়ের নাম। প্রাচীন জমিদারি, প্রাকৃতিক নৈসর্গ, বরেন্দ্রভূমির জীবনবৈচিত্র্য ও প্রাক বাংলার গঠনতন্ত্র এ যাবতীয় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলেই এর সুখ্যাতি আছে। নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত তথাকথিত পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম বৌদ্ধবিহার হলো ‘সোমপুর মহাবিহার’; যাকে নিয়েই ক্ষুদ্র পরিসরে আজ লিখতে বসা। বাইশ সালে শীতের শেষ দিকে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় সেখানে গিয়েছিলাম একবার, বেশ ভালোলাগার কিছু সময় অতিবাহিত করেছিলাম আমরা সেখানে।
সোমপুর মহাবিহার বা পাহাড়পুর বিহারের নামকরন :
প্রথমে একটু আক্ষেপ নিয়েই শুরু করি, ঐতিহাসিক কোনো গুরুত্ব অনুধাবন না করেই আবিষ্কৃত বিহারের নামকরণ করা হয়েছে ‘পাহাড়পুর বিহার’ । প্রাচীন লিপিতে বিহারের নাম ‘সোমপুর মহাবিহার’ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও শুধু স্থান নাম বিবেচনায় পাহাড়পুর বিহার নামকরণ করা হয়েছে, যা মোটেও যৌক্তিক নয়। এর সুবিস্তীর্ণ ইতিহাস লিখতে গেলে কলমের কালি ফুরোবে, তারপরও ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু মৌলিক তথ্য আমি পেশ করছি।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল দেব (৭৮১-৮২১) অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। এপিগ্রাফিক রেকর্ডগুলি সাক্ষ্য দেয় যে এই মহান বিহারের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবন, বোধগয়া এবং নালন্দার খ্যাতি এবং ইতিহাসের সমসাময়িক বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল, অনেক বৌদ্ধ গ্রন্থ পাহাড়পুরে সম্পন্ন হয়েছিল, একটি কেন্দ্র যেখানে মহাযান বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান ধারা চর্চা করা হয়েছিল।


তিব্বতীয় সূত্রে জানা যায়, সোমপুর ছাড়াও জগদ্বিখ্যাত নালন্দা, ওদন্তপুর, বিক্রমশীল ও জগদ্দল মহাবিহার পরিচালিত হতো পাল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এসব বৌদ্ধবিহারে দেশ-বিদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন ছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষিপ্রযুক্তি, গণিত প্রভৃতি চর্চা করতেন। কিন্তু ১২ শতক থেকে নানা কারণে সোমপুর মহাবিহারের যশ ও খ্যাতি কমতে শুরু করে এবং আস্তে আস্তে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায় প্রতিষ্ঠানটি।
মজার ব্যাপার হলো, সমতল ভূমিতে প্রায় ৮০ ফুট উঁচু ঢিবি স্থানীয় লোকজনের কাছে পাহাড় সমতুল্য মনে হতো, তাই তাঁদের কাছে এর আধুনিক নাম হয় পাহাড়পুর। গ্রামের মধ্যে প্রায় ০.১০ বর্গ কিলোমিটার (১০ হেক্টর) অঞ্চল জুড়ে এই পুরাকীর্তিটি বিস্তৃত। এই নিদর্শনটির ভূমি পরিকল্পনা চতুর্ভূজ আকৃতির। এটি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের প্লাবন সমভূমিতে অবস্থিত, প্লাইস্টোসীন যুগের বরেন্দ্র নামক অনুচ্চ এলাকার অন্তর্ভুক্ত। মাটিতে লৌহজাত পদার্থের উপস্থিতির কারণে মাটি লালচে। অবশ্য বর্তমানে এ মাটি অধিকাংশ স্থানে পললের নিচে ঢাকা পড়েছে। পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০.৩০ মিটার উচুতে অবস্থিত পাহাড় সদৃশ স্থাপনা হিসেবে এটি টিকে রয়েছে।
সোমপুর মহাবিহার স্থাপত্যশৈলী
কি আছে সোমপুর মহাবিহারে?
পুরো বিহার জ্যামিতিক প্যাটার্ন ও ২৭৪ মি.×২৭৪ মি. বর্গাকৃতি পরিকল্পনায় চারটি বাহুতে ১৭৭টি ভিক্ষুকোঠা নির্মিত হয়েছিল সোমপুর মহাবিহারে। বৌদ্ধ বিহারটির ভূমি-পরিকল্পনা চতুষ্কোনাকার। এর চারদিক চওড়া সীমানা দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। সীমানা দেয়াল বরাবর অভ্যন্তর ভাগে সারিবদ্ধ ছোট ছোট কক্ষ ছিল। উত্তর দিকের বাহুতে ৪৫টি এবং অন্য তিন দিকের বাহুতে রয়েছে ৪৪টি করে কক্ষ। এই কক্ষগুলোর তিনটি মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিটি মেঝে বিছানো ইঁটের ওপর পুরু সুরকী দিয়ে অত্যন্ত মজবুত ভাবে তৈরি করা হয়েছিলো। সর্বশেষ যুগে ৯২টি কক্ষে মেঝের ওপর বিভিন্ন আকারের বেদী নির্মাণ করা হয়। অধিকাংশ ভিক্ষুকোঠার মেঝেতে নিরেট মঞ্চ, মূর্তিধারক ফোকর ও কুলুঙ্গি ছিল।

ভিক্ষুকোঠাগুলোর সামনে লম্বা টানা বারান্দাও ছিল। মাঝখানে ছিল অসাধারণ এক মন্দির। ক্রুশাকৃতির মন্দির ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্র ও শিল্পশাস্ত্রে সর্বতোভদ্র মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরের তলপত্তন ৬৩টি প্রস্তরমূর্তি দ্বারা সুশোভিত ছিল। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে এদের মধ্যে মাত্র একটি মূর্তি বৌদ্ধ, বাকি ৬২টি হিন্দুধর্মাবলম্বীর। বিহারের উত্তর বাহুর মাঝ বরাবর রয়েছে প্রধান ফটক। এর বাইরের ও ভেতরের দিকে একটি করে স্তম্ভ সম্বলিত হলঘর এবং পাশে ছোট ছোট কুঠুরি আছে। এই কুঠুরিগুলো বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হত। প্রধান ফটক এবং বিহারের উত্তর-পূর্ব কোনের মাঝামাঝি অবস্থানে আরও একটি ছোট প্রবেশ পথ ছিলো। এখান থেকে ভেতরের উন্মুক্ত চত্বরে প্রবেশের জন্য যে সিঁড়ি ব্যবহৃত হত তা আজও বিদ্যমান। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম বাহুতেও অনুরূপ সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিলো। এদের মাঝে কেবল পশ্চিম বাহুর সিঁড়ির চিহ্ন আছে।
সোমপুর মহাবিহার টেরাকোটা নকশা
এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে এদের মধ্যে মাত্র একটি মূর্তি বৌদ্ধ, বাকি ৬২টি হিন্দুধর্মাবলম্বীর। মন্দিরের দেয়ালের ঊর্ধ্বাংশ ও নিম্নাংশে সারিবদ্ধভাবে তুখোড় কারুকাজ খচিত টেরাকোটা বা প্রস্তর ফলক খচিত আছে। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের অর্ধনগ্ন দেবীর মূর্তি, জীবজন্তুর অবয়ব,মৎস্য আকৃতির সদৃশ কিংবা ঘরোয়া আসবাবপত্রের মত পোড়ামাটির অদ্ভুত সব খোদাইচিত্র দেখা গেছে দেয়াল জুড়ে।




এবার বর্তমানে এর সামগ্রিক পরিবেশ সম্পর্কে একটু বলি। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বিহারটিকে
কে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক আইনের আওতায় ১৯১৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষণা দেয়। সুবিশাল আয়তনের বিহারটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও চারদিকে সীমানাপ্রাচীরে ঘেরা আছে। পর্যটকবান্ধব বিহারটির প্রবেশ পথেই হাতের বামে আছে পাহাড়পুর জাদুঘর ও সুসজ্জিত ফুলের বাগান। দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার একটি হিসেবে জায়গাটিতে পুরাতত্ত্ব অধিদপ্তরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল প্রশংসনীয়।
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করে।
আরো অনেক তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস আছে বিহারটির, যা সম্পর্কে জানাতে গেলে একটা লম্বা বিশ্বকোষ লিখা হয়ে যাবে আমার। এখন তো ‘তাড়াহুড়ো প্রজন্ম’ চলছে আমাদের, সেখানে অনেকের সময়ই হবে না ভালো কোনো একটা টাস্ক নিয়ে একটু ঘেঁটে দেখবার বা সময় করে বেড়িয়ে গিয়ে নিজেদের শিকড়ের খোঁজ নেবার কিংবা কারো একটু লিখাতে চোখ বুলাবার। তবুও মনের খোরাক জাগিয়ে দু কলম লিখতে পারা অন্তত আমার কাছে সৌখিন একটা ব্যাপার, ফ্যাশন আর্কাইভ আমাকে সে সুযোগ করে দিয়েছে আর্কাইভড হবার।
হ্যাঁ, এবার দু:খ নিয়ে একটা কথা বলি, মনে করি বলাও জরুরি। পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক ও সংরক্ষণবিদের অভাবে সোমপুর মহাবিহারের সংরক্ষণ ‘যথাবস্থায় মেরামত’ প্রত্নতত্ত্বের নীতিমালা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়নি। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কোর ৯ম অধিবেশন সম্মানসূচক বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তির পর পাহাড়পুর বিহারের সংরক্ষণ কাজে অনেক অর্থ ব্যয় করা হয়েছে সত্য, কিন্তু সার্বিক অবস্থার উন্নতির চেয়ে অবনতি হয়েছে আরও। সিমেন্ট, নয়া ইট, নয়া পোড়ামাটির ফলক ইত্যাদি যোগ করে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের আদি বৈশিষ্ট্য খর্ব করা হয়েছে অনেকাংশে। জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা প্রভৃতি সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। মিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ হয় ঠিকই কিন্তু কাজের কাজ হয় না মোটেও। প্রজেক্ট বিবেচনায় অনেকের কাছে পাহাড়পুর বিহার যেন শিয়ালের কাছে কুমিরের বাচ্চা।
সোমপুর মহাবিহার আরও ছবি
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার কিভাবে যাবেন
সহজ মাধ্যম বাসে করে গেলে ঢাকা হতে বগুড়া হয়ে সরাসরি নওগাঁ যাওয়া যায়। নওগাঁ জেলার বালুডাঙা বাসস্ট্যান্ড থেকে বদলগাছী বাজার হয়ে সহজেই যাওয়া যায়। নওগাঁ শহর থেকে আনুমানিক দূরুত্ব ৩২ কিঃমিঃ । বাস ভাড়া ৩০ থেকে ৪০টাকা। নিজেদের ব্যক্তিগত পরিবহন থাকলে তো কোনো কথাই নেই, আর ট্রেনে গেলে জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ স্টেশন থেকে মাত্র ৫ কি.মি. পশ্চিমে গেলেই এই পাহাড়পুর।
প্রজন্মান্তরের প্রক্রিয়ায় আমরা বাঙ্গালীরা মোটামুটি শিশুকাল থেকেই পাঠ্যপুস্তকে ও সাধারণ জ্ঞানে লিখে পড়ে আসছি সোমপুর মহাবিহার সম্পর্কে। তবে প্রত্যেকেরই উচিৎ তত্ত্বীয় শিক্ষার পাশাপাশি এটি সহ দেশীয় পুরাকীর্তিগুলোতে ব্যবহারিক দর্শনদারী হওয়ার।
এক নজরে সোমপুর মহাবিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার
ভালো থাকুন,
ফজলে ওয়াহিদ রাব্বি।
Facebook link : Fazle Wahid Rabbee
