ব্যক্তিজীবন ও সঙ্গীতজীবন
তার পূর্ণ নাম আবদুল বারী সিদ্দিকী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে বারী সবার ছোট। তার বাবা মহরম আলী এবং মা প্রয়াত জহুর-উন-নিসা। শৈশবে তার সংগীতের প্রতি আগ্রহের শুরু হয় মায়ের কাছ থেকে। মাত্র তিন-চার বছর বয়সে তিনি মায়ের কণ্ঠে শোনা প্রথম গান ‘শ্বাশুড়িরেও কইয়ো গিয়া’ শুনে মুগ্ধ হন। মায়ের কাছ থেকেই তিনি প্রথম গান শেখা শুরু করেন এবং ছোটবেলায় তার গানের অনুপ্রেরণা পান। সাত-আট বছর বয়সে তিনি মায়ের কাছ থেকে সংগীতের প্রাথমিক তালিম নেন এবং সুর বাঁশিতে তোলার অনুশীলন শুরু করেন।
বারীর সংগীতচর্চার প্রতি আকর্ষণের আরও একটি উৎস ছিল তার পরিবারের সদস্যরা। বড় ভাইয়ের বাঁশি বাজানো দেখে তার বাঁশির প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। যদিও নেত্রকোণায় বাঁশি শেখার সেভাবে সুযোগ ছিল না, তিনি নিজের আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় তা রপ্ত করেন। তার নানা শেখ সাবির ছিলেন একজন সরোদ বাদক এবং একটি সংগীত দলের নেতা, যা ছোটবেলা থেকেই বারীকে প্রভাবিত করেছিল।
বারী সিদ্দিকীর সংগীত শিক্ষার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় হাইস্কুলে পড়ার সময়। তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে গান শেখা শুরু করেন এবং ওস্তাদ শ্রী গোপাল দত্তের কাছে তালিম নেন। পাশাপাশি তিনি রফিক মাহমুদ, বিপুল চৌধুরী, দুলাল দত্তনবীশ এবং হযরত আলীর কাছ থেকেও সঙ্গীতে দীক্ষা লাভ করেন।
পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে তিনি ভারতের পুনেতে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে বাঁশির উচ্চতর তালিম নেন। দেশে ফিরে এসে তিনি লোকগীতির সঙ্গে ক্লাসিক মিউজিকের সম্মিলনে একটি নতুন ধারার গান পরিবেশন শুরু করেন।
বারীর মায়ের কাছ থেকে শেখা একটি বিশেষ শ্যাম বিচ্ছেদ সুর ছিল তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি। পরে সেই সুরটি তিনি হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। এটি ছিল তার মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রতিফলন। তার জীবনের প্রতিটি ধাপে মায়ের অবদান ছিল অসামান্য।
বারী সিদ্দিকী ১৯৮৬ সালে ফরিদা ইয়াসমিনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক কন্যা ও দুই ছেলের বাবা।
হুমায়ূন আহমেদ এবং বারী সিদ্দিকী
হুমায়ূন আহমেদ যখন বারী সিদ্দিকীকে গান গাইতে বলছিলেন, তখন তিনি হেসে বলেছিলেন, আমি বারী, বাঁশি ওয়ালা; বাঁশী বাজিয়ে যা কামাই করি তা দিয়ে সংসার চলে যায়। আমাকে গান গাইতে বইলেন না। এতে করে বাঁশীও বাজানো হবে না। আমার গানও কেউ শুনবে না। আমার এ কুল ঐ কুল দুই কুলই যাবে।
হুমায়ূন আহমেদ নাকি তখন তাকে ‘জোর’ করেছিলেন। বলেছিলেন, আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের মানুষ তোমার গান পছন্দ করবে, তুমি গান গাও!
সেই ছিল শুরু। গান গাইতে শুরু করলেন বারী সিদ্দিকী-
তারপরতো ইতিহাস! ( তথ্যসূত্র: BMSOB ফেসবুক পেইজ থেকে )
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং সহযোগিতা তার সংগীতজীবনে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের মাধ্যমে বারী সিদ্দিকী লোকগানের জগতে কিংবদন্তির আসনে আসীন হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামে ইতিহাসে স্নাতক পাশ করে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন সংগীতের সাথে। তখন প্রথম তিনি নিজেকে বাঁশিবাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একসময় বারী শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে বাংলাদেশ রেডিও-টেলিভিশনসহ সম্মিলিত একটি যন্ত্রসংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এর পরপরই তিনি দক্ষিণ এশীয় সার্ক ফেস্টিভ্যালে যান বাঁশি বাজাতে। এরপর ধীরে ধীরে আরো পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলেন।
একদিন হুমায়ূন আহমেদের এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তিনি বাঁশি বাজানোর আমন্ত্রণ পান। অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি তিনি গান পরিবেশন করেন। তার গান শুনে মুগ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ এবং তাকে আরো গান গাইতে বলেন। সেই মুহূর্ত থেকে হুমায়ূন আহমেদ বারী সিদ্দিকীর প্রতিভাকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করেন।
১৯৮০ সালে বারী সিদ্দিকী পেশাগতভাবে বাঁশি বাজানো শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম বিটিভিতে ‘সৃজন’ অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজান। ১৯৯৫ সালে হুমায়ূন আহমেদের উদ্যোগে বারী সিদ্দিকী প্রথম বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে গান করেন। এটি ছিল বিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘রং-এর বারৈ’। এই অনুষ্ঠানেই তিনি সঙ্গীতপ্রেমীদের নজর কাড়েন। পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদ তাকে নিজের পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ (১৯৯৯) এর জন্য গান গাইতে বলেন। এই চলচ্চিত্রে তার গাওয়া গানগুলো ছিল মাইলফলক।
চলচ্চিত্রের গানগুলো, বিশেষত ‘শুয়াচান পাখি’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ এবং ‘পুবালী বাতাসে’, জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়। এ গানগুলো তাকে শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিতি এনে দেয়। এই চলচ্চিত্রে তার গাওয়া গানগুলোতে বাংলার লোকসংগীতের মর্ম স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর বারী সিদ্দিকীর দুটি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়— ‘দুঃখ রইলো মনে’ এবং ‘অপরাধী হইলেও আমি তোর’। এই অ্যালবামগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং শ্রোতারা উকিল মুন্সীর লেখা গানগুলোকে ভালোবেসে গ্রহণ করেন। বারী সিদ্দিকী এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন, “হুমায়ূন স্যার আমার গাওয়ার পেছনে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলেন। মূলত তার সাহস নিয়েই সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস পেয়েছি।”
আপনার একটি শেয়ার আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ

বাংলার বাঘ: শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক
bdfashion archive
চন্দ্রাবতী: বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি
rajon ahmed
জীবন্ত কিংবদন্তি বাউল শাহ আবদুল করিম: ভাটি বাংলার মাটির মানুষ
bdfashion archive
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন । Zainul Abedin
bdfashion archive
কবিতায় আগুন জ্বালিয়ে রাখা এক কবি: হেলাল হাফিজ
bdfashion archive
হাসন রাজা: আধ্যাত্মিক চেতনার বাউল কবি
bdfashion archiveলোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নাই আমারকি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝারভালা কইরা ঘর…