Bari Siddiqui বারী সিদ্দিকী x bfa x fxyz

বাংলার বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী: লোকগানের এক অমর অধ্যায়

হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে বারী সিদ্দিকী বাঁশিবাদক থেকে লোকগান এবং আধ্যাত্মিক গানের জন্য পরিচিতি পেয়েছিলেন। বারী সিদ্দিকী সবসময় নিজেকে . . .

Bari
Siddiqui

শুয়া চাঁন পাখি আমার,
আমি ডাকিতাছি,
তুমি ঘুমাইছ নাকি . . .

‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘আমি একটা জিন্দা লাশ’, ‘রজনী’, ‘সাড়ে তিন হাত কবর’, ‘ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া’, ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’সহ অসংখ্য গানের শ্রষ্টা বারী সিদ্দিকী ছিলেন বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তি লোকশিল্পী, বাঁশিবাদক এবং গায়ক, যিনি মূলত তার হৃদয়গ্রাহী গান ও মুগ্ধকর বাঁশি সুরের জন্য পরিচিত। তিনি ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোনা সদরের কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বারী সিদ্দিকী। সংগীতের প্রতি বারীর যে অনুরাগ, তা পরিবার থেকেই শুরু হলেও তিনি নিজের প্রচেষ্টায় সেটিকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়।

বাঁশি বাজানো দিয়ে সঙ্গীত জীবনের শুরু হলেও পরে তিনি গান গেয়ে অনেক বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন। মূলত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে বারী সিদ্দিকী বাঁশিবাদক থেকে লোকগান এবং আধ্যাত্মিক গানের জন্য পরিচিতি পেয়েছিলেন। বারী সিদ্দিকি বাংলা গানের একটা ভিন্ন ধারা একটা ভিন্ন প্রকৃতি প্রবর্তন করেছেন। যা লোকায়ত গানের সঙ্গে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সফল সংমিশ্রণ করে তিনি তার গানকে মাটির কাছাকাছি নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। বারী সিদ্দিকী সবসময় নিজেকে একজন বংশীবাদক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। বাঁশির প্রতি তার ভালোবাসা এবং দক্ষতা তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যায়। তিনি বিভিন্ন দেশে বাঁশি বাজিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন।

হৃদরোগ এবং কিডনির অসুখের সাথে লড়াই করে ৬৩ বছর বয়সে ২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। 

ব্যক্তিজীবন ও সঙ্গীতজীবন

তার পূর্ণ নাম আবদুল বারী সিদ্দিকী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে বারী সবার ছোট। তার বাবা মহরম আলী এবং মা প্রয়াত জহুর-উন-নিসা। শৈশবে তার সংগীতের প্রতি আগ্রহের শুরু হয় মায়ের কাছ থেকে। মাত্র তিন-চার বছর বয়সে তিনি মায়ের কণ্ঠে শোনা প্রথম গান ‘শ্বাশুড়িরেও কইয়ো গিয়া’ শুনে মুগ্ধ হন। মায়ের কাছ থেকেই তিনি প্রথম গান শেখা শুরু করেন এবং ছোটবেলায় তার গানের অনুপ্রেরণা পান। সাত-আট বছর বয়সে তিনি মায়ের কাছ থেকে সংগীতের প্রাথমিক তালিম নেন এবং সুর বাঁশিতে তোলার অনুশীলন শুরু করেন।

হুমায়ূন আহমেদ এবং বারী সিদ্দিকী

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং সহযোগিতা তার সংগীতজীবনে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের মাধ্যমে বারী সিদ্দিকী লোকগানের জগতে কিংবদন্তির আসনে আসীন হন।

অর্জন ও সম্মাননা

বারী সিদ্দিকী তার অসামান্য সঙ্গীত প্রতিভার জন্য বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। যদিও অনেক পুরস্কার তিনি জীবিত অবস্থায় পাননি, তার কর্ম তাকে চিরকাল সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে বাঁচিয়ে রাখবে।

১৯৯৯ সালে ফ্রান্সে ওয়ার্ল্ড ফ্লুট সম্মেলনে এই উপমহাদেশ থেকে তিনিই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট অর্জন।

প্রবাস প্রজন্ম জাপান সম্মাননা (২০১৪)

সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস



বারী সিদ্দিকীর মৃত্যুবরণ

২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে যেখানে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ২৪ নভেম্বর তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।

বারী সিদ্দিকীর গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলো

. শুয়াচান পাখি
. আমার গায়ে যত দুঃখ সয়
. পুবালী বাতাসে
. আমি একটা জিন্দা লাশ
. রজনী
. সাড়ে তিন হাত কবর
. ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া
. মানুষ ধরো মানুষ ভজো

প্রকাশিত একক অ্যালবাম

দুঃখ রইলো মনে
অপরাধী হইলেও আমি তোর
সরলা
ভাবের দেশে চলো
সাদা রুমাল
মাটির মালিকানা
মাটির দেহ
মনে বড় জ্বালা
প্রেমের উৎসব
ভালোবাসার বসত বাড়ি
নিলুয়া বাতাস
দুঃখ দিলে দুঃখ পাবি

মিশ্র অ্যালবাম
আসমান সাক্ষী (২০০৯)
চন্দ্রদেবী (২০০৯)

বারী সিদ্দিকীর গানের লিরিক্স

শুয়াচান পাখি

এই গানের একটা করুন ইতিহাস আছে। এইটা আসলে “শোয়া চান পাখি”, মানে যে পাখি শুয়া (শুয়ে)আছে ৷ গানটির লেখক “উকিল মুন্সী”।

উকিল মুন্সীর স্ত্রী অসুস্থ ৷ অসুস্থ বৌ ঘরে রাইখাই দূরের গ্রামে গান করতে গেছেন ৷ গানের অনুষ্ঠান চলাকালীন খবর আইলো উনার স্ত্রী মারা গেছেন ৷ দূরের পথ, ফিরতে ফিরতে কয়েকদিন লাগলো ৷ ততদিনে কবর দেয়া হয়া গেছে ৷ গুরু উকিল মুন্সী বাড়ি ফিরা কবরের সামনে বৈসা পড়লেন ৷ সেইখানে বৈসাই গানটা লিখলেন।

শুয়াচান পাখি আমার শূয়াচান পাখি
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।।
তুমি আমি জনম ভরা
ছিলাম মাখামাখি,
আজ কেন হইলে নীরব
মেলো দুটি আঁখি।।
বুলবুলি আর তোতা ময়না
কত নামে ডাকি,
তোরে কত নামে ডাকি
শিকল ভেঙ্গে চলে গেলে কারে লইয়া থাকি।।
তোমার আমার এই পিরিতি
চর্ন্দ্র সূর্য্য সাক্ষী,
হঠাত করে চলে গেলে
বুঝলাম না চালাকিরে পাখি
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।।

আমার গায়ে যত দুঃখ সয়

আমার গায়ে যত দুঃখ সয়
বন্ধুয়া রে করো তোমার মনে যাহা লয়..
নিঠুর বন্ধু রে, বলেছিলে আমার হবে
মন দিয়াছি এই ভেবে
সাক্ষী কেউ ছিলনা সেসময়.
সাক্ষী শুধু চন্দ্র-তারা,
একদিন তুমি পড়বে ধরা রে বন্ধু
ত্রিভুবনের বিচার যেদিন হয়..
নিঠুর বন্ধু রে, দুঃখ দিয়া হিয়ার ভিতর
একদিনও না লইলে খবর
এইকি তোমার প্রেমের পরিচয় ও বন্ধুরে.
মিছামিছি আশা দিয়া
কেন বা প্রেম শিখাইলা রে বন্ধু
দূরে থাকা উচিত কি আর হয়..
(পাষাণ বন্ধুরে) নিঠুর বন্ধুরে, বিচ্ছেদের বাজারে গিয়া
তোমার প্রেম বিকি দিয়া
করব না প্রেম আর যদি কেউ কয় ও বন্ধুরে.
উকিলের হয়েছে জানা
কেবলই চোরের কারখানা রে বন্ধু
চোরে চোরে বেয়াই আলা হয়..

মরমী গানের পথিকৃৎ: উকিল মুন্সীর জীবন ও সাধনা

আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়;, সুয়া চান পাখি; পুবালি বাতাসে আমি বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি, আমার নি কেই আসেরে; উকিল মুন্সীর উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় গান

বাংলা সাহিত্যে স্বপ্ন ও সংলাপের জনক: হুমায়ূন আহমেদ

এখন যাবো অচিন দেশে, অচিন কোনো গাঁয়
চন্দ্র কারিগরের কাছে ধবল পঙ্খী নায়
ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়
চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয় । বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক, নাট্যকার, এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ তার গানের মত করেই অচিন দেশে, অচিন কোনো গাঁয়ে চলে গেছেন ২০১২ সালের ১৯ জুলাই এক অমাবস্যা রাতে। যদিও তার আকুতি ছিলো এক চাঁদনী পসর রাইতের।


তথ্যসূত্র:

দেশ রুপান্তর

বিবিসি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Instagram did not return a 200.
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Your share and comment are an inspiration to us

X (Twitter)
Post on X
Pinterest
fb-share-icon
Instagram
FbMessenger
Copy link
URL has been copied successfully!